আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/সৌজন্য ও সদ্বিবেচনা

সৌজন্য ও সদ্বিবেচনা

রোম নগরীতে বহুকাল অবধি এই প্রথা প্রচলিত ছিল, পাঁচ বৎসর অন্তর একটি সভা হইত। যে সকল ব্যক্তি কাব্যরচনা করিতেন, তাঁহাবা স্বরচিত কাব্য ঐ সভায় উপস্থিত করিতেন। যাঁহার কাব্য সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া বিবেচিত হইত, তিনি সোণার মেডাল[১] ও হাতীর দাঁতের বীণা পুরস্কার পাইতেন।

 সুপ্রসিদ্ধ সম্রাট্ ট্রেজানের রাজত্বসময়ে অনেকের রচিত কাব্য পঞ্চবার্ষিক সভা সমর্পিত হইত। লুশিয়স্ বেলিরিয়স্ নামক এক ত্রযোদশবর্ষীয় বালক, একখানি কাব্য লিখিয়াছিলেন, সেই কাব্যখানিও ঐ সভায় সমর্পিত হইযাছিল। সভ্যদিগের বিবেচনায়, এই অল্পবয়স্ক বালকের রচিত কাব্যখানি, সে বৎসর সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া স্থিরীকৃত হইল। সুতরাং তিনি নিরূপিত পুরস্কার প্রাপ্ত হইলেন।

 রোমীয়দিগেব এই রীতি ছিল, কোনও ব্যক্তি অসাধারণ গুণপ্রকাশ করিলে, লোকের উৎসাহবর্দ্ধনার্থে তদীয় ধাতুময়ী প্রতিমূর্ত্তি নির্ম্মিত করাইয়া, নগরের সর্ব্বাপেক্ষা প্রকাশ্য স্থানে স্থাপিত করিতেন। এই প্রতিমূর্ত্তির মস্তকে একটী মুকুট অর্পিত হইত। এরূপ অল্পবয়স্ক বালক সর্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট কাব্যের রচনা করিযাছেন, এজন্য সকলে, যৎপুরোনাস্তি আহ্লাদিত হইয়া, তদীয় প্রতিমূর্ত্তি নির্ম্মিত করাইলেন।

প্রকাশ্য স্থানে প্রতিমূর্ত্তি-স্থাপনের দিনস্থির হইল। নিরূপিত সময়ে, বহুসংখ্যক লোক ঐ স্থানে উপস্থিত হইলেন। যাঁহারা কাব্যরচনা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যেও অনেকে ঐ স্থানে সমাগত হইয়াছিলেন। প্রতিমূর্ত্তি যথাস্থানে সন্নিবেশিত হইল। অনন্তর, প্রধান রাজপুরুষ, প্রতিমূর্ত্তির মস্তকে মুকুটস্থাপনের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। এই সময়ে, বেলিরিয়স্, এক যুবা পুরুষকে দেখিতে পাইলেন। এই যুবাপুরুষ, পুরস্কারপ্রাপ্তির আশয়ে, স্বরচিত কাব্য পাঞ্চবার্ষিক সভায় সমর্পিত করিয়াছিলেন। তাঁহার রচিত কাব্য, অনেকের বিবেচনায়, অত্যুৎকৃষ্ট হইয়াছিল, কিন্তু বেলিরিয়সের রচিত কাব্য অপেক্ষা কিছু নিকৃষ্ট, এজন্য, পুরস্কার না পাওয়াতে, তাঁহার মনে অত্যন্ত ক্ষোভ জন্মিয়াছিল।

 বেলিরিয়স্, তদীয় আকারে ক্ষোভ ও বিষাদের স্পষ্ট লক্ষণ লক্ষ্য করিয়া বুঝিতে পারিলেন, পুরস্কার পান নাই বলিয়া, ইনি এত ক্ষুব্ধ ও বিষণ্ন হইয়াছেন। ফলতঃ, তাঁহার ভাব দর্শনে, তদীয় অন্তঃকরণে অতিশয় দুঃখ উপস্থিত হইল। তখন তিনি, রাজপুরুষের হস্ত হইতে মুকুট লইয়া, স্বীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখবর্ত্তী হইয়া বলিলেন, দেখুন, আপনি যে কাব্যের রচনা করিয়াছেন, তাহা সর্ব্বোৎকৃষ্ট হইয়াছে, তাহার সন্দেহ নাই, সুতরাং, আপনিই পুরস্কার পাইবার যথার্থ যোগ্য পাত্র। কিন্তু, আমার বয়স অতি অল্প, এত অল্প বয়সে কাব্যরচনা করিতে পারিয়াছি, এজন্য, বিচারকেরা আমার উৎসাহবর্দ্ধনের নিমিত্ত, আমায় পুরস্কার দিয়াছেন, গুণ অনুসারে, বিবেচনা করিলে, আপনকারই পুরস্কার পাওয়া উচিত।

 এইরূপ বলিয়া, সেই বালক আপন প্রাপ্য মুকুট, হর্ষোৎফুল্ল লোচনে, প্রীতিপ্রফুল্ল বদনে, স্বীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর মস্তকে স্থাপিত করিলেন। সমবেত সমস্ত লোক ত্রয়োদশবর্ষীয় বালকের ঈদৃশ অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব্ব সৌজন্য ও সদ্বিবেচনা দর্শনে, মোহিত ও চমৎকৃত হইয়া, মুক্তকণ্ঠে তাঁহার প্রশংসা কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন।

  1. মেডাল—অসাধারণ গুণের পুরস্কারার্থে ধাতুনির্মিত মূদ্রাবিশেষ।