আখ্যানমঞ্জরী (প্রথম ভাগ)/পিতৃভক্তি

পিতৃভক্তি।

আয়র্লণ্ডের অন্তঃপাতী লণ্ডনডরি নগরে বেকনর নামে এক ব্যক্তি ছিল। সে জাহাজে নাবিকের কর্ম্ম করিত। তাহার পুত্রও, দ্বাদশ বৎসর বয়সে, ঐ ব্যবসায় অবলম্বন করিয়াছিল। পিতা পুত্রে এক জাহাজে কর্ম্ম করিত। বেকনর আপন পুত্রকে উত্তমরূপ সন্তরণ শিক্ষা করাইয়াছিল। মৎস্য যেমন অবলীলাক্রমে জলে সন্তরণ করিয়া বেড়ায়, বেকনরের পুত্রও সন্তরণ বিষয়ে সেইরূপ দক্ষ হইয়াছিল। সে প্রতিদিন, কর্ম্মে অবসর পাইলেই, জাহাজ হইতে ঝম্পপ্রদান করিয়া সমুদ্রে পড়িত এবং জাহাজের চতুর্দিকে সন্তরণ করিয়া বেড়াইত, ক্লান্তিবোধ হইলে, লম্বমান রজ্জু অবলম্বন করিয়া জাহাজে উঠিত।

 এক দিবস, বায়ুবেগ-বশে সহসা জাহাজ আন্দোলিত হইলে, কোনও আরোহীর অতি অল্পবয়স্কা কন্যা সমুদ্রে পতিত হইল। বেকনর, দেখিবামাত্র, লম্ফ দিয়া সমুদ্রে পড়িল এবং তৎক্ষণাৎ সেই কন্যার বস্ত্র ধরিয়া, তাহাকে জল হইতে ঊর্দ্ধে তুলিল। অনন্তর, সে কন্যাকে বক্ষঃস্থলে লইয়া সন্তরণ করিয়া জাহাজের প্রায় নিকটে আসিয়াছে, এমন সময় দেখিতে পাইল, একটা ভয়ানক হাঙ্গর তাহাকে আক্রমণ করিতে আসিতেছে। দেখিবা মাত্র, বেকনর ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। জাহাজের উপরিস্থ সমস্ত লোক অত্যন্ত ব্যাকুল হইল, এবং বন্দুক লইয়া, হাঙ্গরকে লক্ষ্য করিয়া, গুলি চালাইতে লাগিল, কিন্তু কেহই সাহস করিয়া, তাহার সাহায্যের নিমিত্ত, জলে অবতীর্ণ হইতে পারিল না, সকলেই হায় কি হইল বলিয়া, কোলাহল করিতে লাগিল।

 জাহাজ হইতে যত গুলি মারিয়াছিল, তাহাদের একটিও হাঙ্গরের গায়ে লাগিল না। হাঙ্গর ক্রমে ক্রমে সন্নিহিত হইয়া, মুখব্যাদানপূর্ব্বক বেকনরকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইল। তাহার পুত্র অত্যন্ত পিতৃভক্ত ছিল। সে তাহার প্রাণনাশের উপক্রম দেখিয়া, এক তীক্ষ্ণধার তরবারি গ্রহণপূর্ব্বক, সমুদ্রে ঝম্প প্রদান করিল, এবং দ্রুত বেগে হাঙ্গরের দিকে গমন করিয়া, উহার উদরে তরবারি প্রবেশ করাইয়া দিল। তখন হাঙ্গর, কুপিত হইয়া, তাহাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইল। কিন্তু সে, সন্তরণকৌশলে উহার আক্রমণ অতিক্রম করিয়া, উহাকে উপর্য্যূপরি আঘাত করিতে লাগিল।

 এই অবকাশে, জাহাজের উপরিস্থ লোকেরা কতিপয় রজ্জু নিক্ষেপ করিল। পিতা পুত্র এক এক রজ্জু অবলম্বন করিল, তাহারা টানিয়া উহাদিগকে জল হইতে কিঞ্চিৎ ঊর্দ্ধে উঠাইল। এই সময়ে সকলে, উহাদের প্রাণরক্ষা হইল ভাবিয়া, আনন্দধ্বনি করিতে লাগিল। কিন্তু সেই দুর্দান্ত জন্তু মুখব্যাদান ও ঊর্দ্ধে লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক, বেকনরের পুত্রের কটিদেশ পর্য্যন্ত গ্রাস করিল, এবং তৎক্ষণাৎ তীক্ষ্ণ দন্ত দ্বারা গ্রস্ত অংশ ছেদন করিয়া লইয়া, জলে পতিত হইল। বালকের কলেবরের অর্দ্ধ অংশ মাত্র রজ্জুতে ঝুলিতে লাগিল।

 এই হৃদয়বিদারণ ভয়ঙ্কর ব্যাপার দর্শনে, ব্যক্তি মাত্রেই, হতবুদ্ধি ও জড়প্রায় হইয়া, কিয়ৎক্ষণ দণ্ডায়মান রহিল, অনন্তর সকলেই, শোকে বিকলচিত্ত হইয়া, হাহাকার করিতে লাগিল। বেকনর, জাহাজে উত্তোলিত হইয়া, পুত্রের তাদৃশী দশা দেখিয়া শোকে নিতান্ত বিহ্বল হইল। পার্শ্ববর্ত্তী লোকেরা বলপূর্ব্বক ধরিয়া না রাখিলে, সে নিঃসন্দেহ, সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়া, প্রাণত্যাগ করিত। তাহার পুত্র যতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত ছিল, একদৃষ্টে পিতাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। আমার প্রাণ যাউক, কিন্তু, পিতার প্রাণ রক্ষা করিয়াছি, এই আনন্দ অনুভব করিতে করিতে, সে প্রাণত্যাগ করিল। তাহার মুখের ভাব দর্শনে, সন্নিহিত ব্যক্তি মাত্রেরই এরূপ বোধ ও বিশ্বাস জন্মিয়াছিল।