আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/‘জয় হিন্দ’ অভিবাদন

 ভারতে হিন্দু ও মুসলমানে—আবার হিন্দুর মধ্যে জাতিতে জাতিতে বিভেদ রহিয়াছে। কিন্তু যুগে যুগে পুঞ্জীভূত সাম্প্রদায়িক ও শ্রেণীগত সেই ভেদাভেদ এখানে যেন এক যাদুমন্ত্র বলে অদৃশ্য হইয়াছে। আজাদ হিন্দ্ বাহিনীর সৈনিকগণ ভুলিয়া গিয়াছে—তাহারা হিন্দু, মুসলমান, শিখ বা খৃষ্টান—তাহারা এক দেশ-মাতার সন্তান—পরম্পর ভাই-ভাই।

 সেনাবাহিনীর মধ্যে ছোট বড় ভেদ নাই। সাধারণ সৈনিক ও অফিসার সকলেই আহার করেন এক জায়গায়। নেতাজীর বেশ সাধারণ সৈনিকের ন্যায়; সকলের সঙ্গে তিনি সমান ভাবে মিশেন।

 সৈনিকদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস নেতাজীর নেতৃত্বে তাহারা দেশকে মুক্ত করিতে পারিবে—জয় তাহাদের হইবেই। আমরা পরস্পরকে অতিবাদন করি—নমস্তে বা সেলাম বলিয়া নয়; বলি—‘জয় হিন্দ’— হিন্দুস্থানের জয়। এই শব্দ দুইটির মধ্যে লুকানো আছে পরাধীন ভারতবাসীর অন্তরের কামনা—সমস্ত আশা ও আকাঙ্ক্ষা।

 আজ পথে দেখা হইল জানকীর সঙ্গে— মিলিটারী বেশে চলিয়াছে একটি যুবক সৈনিকের বাহুপাশে বদ্ধ হইয়া। আমাকে দেখিয়া সে বলিল—‘রেঙ্গুনে আসিয়াই তোমাকে খুঁজিয়াছিলাম। আজ হঠাৎ দেখা হইয়া গেল। কয়দিন এখানেই আছি—দেখা হইবে। এখন একটু কাজ আছে।’

 মুখে জোর করিয়া হাসি ফুটাইয়া তাহাকে বিদায় দিলাম।

 জানকী বলিয়াছিল—সে আমায় প্রাণের অপেক্ষা ভালবাসে—চিরদিনই সে আমার থাকিবে। এখনো এক মাস হয় নাই। ভারাক্রান্ত দুঃস্বপ্নের মতো তাহার স্মৃতি মনের মধ্যে নাড়া দিয়া উঠিল। ব্যথাভারানত একটি দীর্ঘশ্বাস কখন অজ্ঞাতে বাহির হইয়া গেল।

২৯শে জানুয়ারী ১৯৪৪:

 আজ পর্য্যন্ত অনেকগুলি রাষ্ট্র আজাদ হিন্দ্ গভর্ণমেণ্টকে স্বীকার করিয়া লইয়াছেন; তাহার মধ্যে আছে জার্মানী, ইটালী, ক্রোশিয়া, জাপান, মাঞ্চুকুয়ো, ন্যাংকিং (চীন), ফিলিপাইন, শ্যাম ও ব্রহ্ম গভর্ণমেণ্ট। আন্তর্জাতিক রাজনীতিক্ষেত্রে আজ প্রথম ভারত তাহার স্থান লাভ করিল। ব্রহ্মের প্রধান মন্ত্রী ডাক্তার বা ম আজাদ হিন্দ্ গভর্ণমেণ্টের সঙ্গে সহযোগিতা করিতেছেন। আয়ার ও স্পেনও আজাদ হিন্দ্ গভর্ণমেণ্টকে মানিয়া লইবেন বলিয়া শুনিলাম।

 আজ একজন বার্মীজ ব্যবসায়ীর বাড়ীতে নিমন্ত্রণ আছে—ফ্রণ্টে যাত্রার পূর্বে তিনি আমাদের ছয়জন সঙ্গীকে একটি ছোট পার্টি দিবেন। খাবার শুনিলাম বর্মী রীতিতে তৈয়ারী হইবে।

 ভাত, ডাল ও তরকারী। তরকারিগুলির মধ্যে নাপ্পি ব্যবহৃত হওয়ায় আমার সাথীরা খাইতে পারিলেন না। আমার অভ্যাস থাকায় অসুবিধা হইল না। নাপ্পি পচা মাছে তৈয়ারী হয়। একটা হাঁড়ির মধ্যে অনেক দিন রাখিয়া দিলে যখন পচিয়া গলিয়া যায়, তখন মাছের কাঁটাগুলি বাছিয়া ফেলিয়া দেওয়া হয়। তখন উহা দেখিতে হয় অনেকটা ঘি-এর মত তরল। রান্নার সময় সকল ব্যঞ্জনেই নাপ্পি ব্যবহার করা হয়। যখন রান্না হয় তখন বিদেশীরা উহার দুর্গন্ধে পলায়ন করে। রান্নার পর কিন্তু গন্ধ খুব কমই থাকে।