ইতিহাস/শিবাজী ও গুরু গোবিন্দসিংহ

শিবাজী ও গুরু গােবিন্দসিংহ

শিখ-ইতিহাসের সহিত মারাঠা-ইতিহাসের প্রধান প্রভেদ এই যে, যিনি মারাঠা-ইতিহাসের প্রথম ও প্রধান নায়ক সেই শিবাজী হিন্দুরাজ্য স্থাপনের উদ্দেশ্যকে মনের মধ্যে সুপরিস্ফুট করিয়া লইয়াই ইতিহাসের রঙ্গক্ষেত্রে মারাঠা জাতির অবতারণা করিয়াছিলেন। তিনি দেশজয়, শত্রুবিনাশ, রাজ্যবিস্তার প্রভৃতি যাহা কিছু করিয়াছেন সমস্তই ভারতব্যাপী একটি বৃহৎ সংকল্পের অঙ্গ ছিল।

 আর, গোড়ায় ধর্মের ইতিহাসরূপে শিখ-ইতিহাসের আরম্ভ হইয়াছিল। বাবা নানক যে স্বাধীনতা অন্তরে উপলব্ধি করিয়াছিলেন তাহা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নহে; যে দেবপূজা কেবল দেশবিশেষের, জাতিবিশেষের কল্পনা ও অভ্যাসের দ্বারা সীমাবদ্ধ, পৃথিবীর সকল মানুষের চিত্ত যাহার মধ্যে অধিকার পায় না এবং বাধা পায়, নানকের ধর্মবুদ্ধি তাহার মধ্যে আপনাকে সংকুচিত করিতে পারে নাই; এই-সকল সংকীর্ণ পৌরাণিক ধর্মের বন্ধন হইতে তাঁহার হৃদয় মুক্তিলাভ করিয়াছিল এবং সেই মুক্তি তিনি সকলের কাছে প্রচার করিবার জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন।

 নানকের উপদেশে আকৃষ্ট হইয়া যাহারা তাঁহার নিকটে ধর্মদীক্ষা গ্রহণ করিয়াছিল তাহারাই শিখ অর্থাৎ শিষ্য বলিয়া গণ্য হইয়াছিল।

 জাতিনির্বিচারে সকলেই শিষ্যত্ব গ্রহণ করিতে পারিত। অতএব নানকের অনুবর্তীদিগকে লইয়া কোনো জাতিগত ইতিহাস যে গড়িয়া উঠিবে, এরূপ লক্ষণ প্রথমে দেখা যায় নাই।

 কিন্তু মোগলদিগের নিকট হইতে অত্যাচার পাইয়া এই নানক-শিষ্যের দল একটি বিশেষ সম্প্রদায়ে সংহত হইয়া দাঁড়াইল এবং সেই কারণেই সর্বসাধারণের নিকট ধর্মপ্রচার অপেক্ষা আত্মদলকেই বিনাশ ও উপদ্রব হইতে রক্ষা করাই তাহাদের প্রধান চেষ্টা হইল। এইরূপে বাহির হইতে 'চাপ পাইয়াই শিখ একটি ঘনিষ্ঠ জাতি হইয়া দাঁড়াইল।

 শিখদের যিনি শেষ গুরু ছিলেন এই কাজেই তিনি বিশেষভাবে লাগিলেন। সর্বমানবের মধ্যে ধর্মপ্রচার কার্যকে সংহৃত করিয়া লইয়া শিখদিগকে বলিষ্ঠ করিয়া তোলাই তাঁহার জীবনের ব্রত ছিল।

 এ কাজ প্রকৃতপক্ষে ধর্মপ্রচারকের নহে; ইহা প্রধানত সেনানায়ক এবং রাজনীতিজ্ঞের কাজ। গুরু গোবিন্দের মধ্যে সেই গুণ ছিল। তিনি অসাধারণ অধ্যবসায়ে দল বাধিয়া তুলিয়া বৈরনির্যাতনের উপযুক্ত যোদ্ধা ছিলেন। তিনিই ধর্মসম্প্রদায়কে বৃহং সৈন্যদলে পরিণত করিলেন এবং ধর্মপ্রচারক গুরুর আসনকে শূন্য করিয়া দিলেন।

 গুরু নানক যে মুক্তির উপলব্ধিকে সকলের চেয়ে বড়ো করিয়া জানিয়াছিলেন, গুরু গোবিন্দ তাহার প্রতি লক্ষ স্থির রাখিতে পারেন নাই। শহস্ত হইতে মুক্তিকামনাকেই তিনি তাহার শিষ্যদের মনে একান্তভাবে মুদ্রিত করিয়া দিলেন।

 ইহাতে ক্ষণকালের জন্য ইতিহাসে শিখদের পরাক্রম উজ্জ্বল হইয়াছিল সন্দেহ নাই, ইহাতে তাহাদিগকে রণনৈপুণ্য দান করিয়াছে তাহাও সত্য, কিন্তু বাবা নানক যে পাথেয় দিয়া তাহাদিগকে একটি উদার পথে প্রেরণ করিয়াছিলেন সেই পাথেয় তাহারা এইখানেই খরচ করিয়া ফেলিল এবং তাহাদের যাত্রাও তাহারা এইখানেই অবসান করিয়া দিল।

 ইহার পর হইতে কেবল লড়াই এবং রাষ্ট্রবিস্তারের ইতিহাস। এ দিকে মোগল শক্তিও ক্ষীণ হইয়া আসিতেছিল এবং শিখদল তাহাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যতই কৃতকার্য হইতে লাগিল ততই আত্মরক্ষার চেষ্টা ঘুচিয়া গিয়া ক্ষমতাবিস্তারের লোলুপতা বাড়িয়া উঠিতে লাগিল।

 যতদিন বিরুদ্ধপক্ষ প্রবল থাকাতে আত্মরক্ষার চেষ্টাই একান্ত হইয়া উঠে ততদিন এক বিপদের তাড়নায় নিজেদের মধ্যে ঐক্যবন্ধন দৃঢ় থাকে। বাহিরের সেই চাপ সরিয়া গেলে এই বিজয়মদমত্ততাকে কিসে ধারণ করিয়া রাখিতে পারে? আত্মরক্ষাচেষ্টায় যে যুদ্ধশক্তি সঞ্চিত হইয়া উঠে অন্যকে আঘাত করিবার উদ্যম হইতে নিবৃত্ত করিয়া নিজেকে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টায় সেই শক্তিকে কে নিযুক্ত করিতে পারে?

 যে শক্তি তাহা পারিত আশু-প্রয়োজন-সাধনের অতিলোলুপতায় গুরু গোবিন্দ তাহাকে খর্ব করিয়াছিলেন। গুরুর পরিবর্তে তিনি শিখদিগকে তরবারি দান করিলেন। তিনি যখন চলিয়া গেলেন তখন নানকের প্রচারিত মহাসত্য গ্রন্থসাহেবের মধ্যে আবদ্ধ হইল, তাহা গুরুপরম্পরায় জীবনপ্রবাহে ধাবিত হইয়া মানবসমাজকে ফলবান্ করিবার জন্য অপ্রতিহত গতিতে সম্মুখে অগ্রসর হইতে থাকিল না; এক জায়গায় তাহা অবরুদ্ধ হইয়া গেল।

 শক্তি তখন দেখিতে দেখিতে লুব্ধ এবং অসংযত হইয়া উঠিল। তখন দেবতার তিরোধানে অপদেবতার প্রাদুর্ভাব হইল, কাড়াকাড়ি ও দলাদলি উদ্দাম হইয়া উঠিল।

 এই উচ্ছৃঙ্খল আত্মঘাতসাধনের মধ্যে রণজিৎসিংহের অভ্যুদয় হইল। তিনি কিছুদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন শিখদিগকে এক করিয়াছিলেন, কিন্তু সে কেবলমাত্র বলের দ্বারা। তিনি সকলের চেয়ে বলশালী বলিয়া সকলকে দমন করিয়াছিলেন।

 বলের দ্বারা যে লোক এক করে সে অন্যকে দুর্বল করিয়াই এক করে; শুধু তাই নয়, ঐক্যের যে চিরন্তন মূলতত্ত্ব প্রেম তাহাকেই পরাস্ত করিয়া পঙ্গু করিয়া নিজের প্রয়োজন সাধন করে। রণজিৎসিংহ স্বার্থপুষ্টির জন্যই সমস্ত শিখকে ছলে-বলে-কৌশলে নিবিড় করিয়া বাঁধিয়াছিলেন।

 শিখ সম্প্রদায়ের চিত্তে তিনি এমন কোনো মহৎ ভাবের সঞ্চার করেন নাই যাহাতে তাঁহার অবর্তমানেও তাহাদিগকে একত্র ধারণ করিয়া রাখিতে পারে। কেবলমাত্র অপ্রতিহত চাতুরী-প্রভাব এবং স্বার্থসাধন সম্বন্ধে সতর্ক অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত তিনি দেখাইয়াছিলেন।

 তাঁহার লোভের সীমা ছিল না এবং তাহার ভোগস্পৃহা অসংযত ছিল। একটিমাত্র তাঁহার প্রশংসার বিষয় এই যে, তিনি যাহা চাহিয়াছিলেন তাহা পাইয়াছিলেন, কিছুতেই তাহাকে ঠেকাইতে পারে নাই। একটিমাত্র স্থানে তিনি আপনার দুর্দম ইচ্ছাকে সংযত করিয়াছিলেন– অত্যন্ত লুব্ধ হইয়াও ভারত-মানচিত্রে তিনি ইংরাজের রক্তগণ্ডীকে লঙ্ঘন করেন নাই, তাঁহার স্বার্থবুদ্ধি এইখানে তাঁহাকে টানিয়া রাখিয়াছিল।

 যাহা হউক, তিনি কৃতকার্য হইয়াছিলেন। কৃতকার্যতার দৃষ্টান্ত মানুষকে যত বিপদে ফেলিয়াছে এমন আর কিছুতেই না। এই দৃষ্টান্তে মানুষের মঙ্গলবুদ্ধিকে পরাস্ত এবং তাহার লুব্ধ প্রবৃত্তিকে অশান্ত করিয়া তোলে— ইহা অপঘাত মৃত্যুরই পথ।

 যাহা হইতে শিখ সম্প্রদায় আরম্ভ হইয়াছিল সেই নানক অকৃতকার্যতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এইজন্য তিনি তাহার বণিকপিতার কাছে যথেষ্ট লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছিলেন। লবণের কারবারে নানক কিরূপ লাভ করিয়াছিলেন সে কথা সকলেরই জানা আছে। তিনি দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু যে শক্তিতে জাঠ কৃষকেরা প্রাণকে তুচ্ছ করিয়া দুঃখকে অবজ্ঞা করিয়া বড়ো হইয়া উঠিয়াছিল সে শক্তি এই কাণ্ডজ্ঞানহীন অকিঞ্চন তাপসই সঞ্চার করিয়াছিলেন।

 আর, যে মহারাজ কৃতকার্যতার আদর্শস্থল— শিখদের চিরন্তন শত্রুকে যিনি দমন করিয়াছিলেন, কোনো পরাভবেই যাহার ইচ্ছাকে নিরস্ত করিতে পারে নাই— এক দিকে মোগলরাজ্যাবসান ও অন্য দিকে ইংরেজ-অভ্যুদয়ের সন্ধ্যাকাশকে যাহার আকস্মিক প্রতাপ রক্তরশ্মিতে রঞ্জিত করিয়া তুলিয়াছিল, তিনি শিখদের মধ্যে কী রাখিয়া গেলেন? অনৈক্য, অবিশ্বাস, উচ্ছৃঙ্খলতা।

 শিখদের যাহারা নায়ক ছিল তাহারা এই কৃতকার্য রাজার দৃষ্টান্তে ইহাই শিখিয়াছিল, জোর যার মুলুক তার। তাহারা ত্যাগ শিখিল না, আত্মসমর্পণ শিখিল না, ‘যতোধর্মস্ততোজয়ঃ’ এ মন্ত্র ভুলিয়া গেল, অর্থাৎ দীনহীন নানক যে শক্তি দ্বারা তাহাদিগকে বাঁধিয়াছিলেন, মহাপ্রতাপশালী মহারাজ তাহাতে আগুন লাগাইয়া দিলেন এবং ইতিহাসের আকাশে শিখ-জ্যোতিষ্ক ক্ষণকালের জন্য জ্বলিয়া ক্ষণকালের মধ্যে নিবিয়া গেল।

 আজ শিখের মধ্যে আর কোনো অগ্রসর-গতি নাই। তাহারা একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ে বাঁধিয়া গেছে; তাহারা আর বাড়িতেছে না; তাহাদের মধ্যে বহু শতাব্দকালেও আর কোনো মানবগুরুর আবির্ভাব হইল না— জ্ঞানে ধর্মে কর্মে মানবের ভাণ্ডারে তাহারা কোনো নূতন সম্পদ সঞ্চিত করিল না।

 নানক-শিষ্যেরা আজ যুদ্ধ করিতে পারে তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার শিষ্যদল ফৌজে ঢুকিয়া কখনো কাবুলে, কখনো চীনে, কখনো আফ্রিকায় লড়াই করিয়া বেড়াইবে, নানকের ধর্মতেজে উদ্দীপ্ত উত্তরবংশীয়দের এই পরিণামই যে গৌরবজনক, এমন কথা আমরা মনে করিতে পারি না। মনুষ্যত্বের উদার ক্ষেত্রে তাহার কেবল বারিকে বসিয়া কুচকাওয়াজ করিবে এজন্য নানক জীবন উৎসর্গ করেন নাই।

 নানক তাঁহার শিষ্যদিগকে স্বার্থপরতা হইতে, ধর্মবোধের সংকীর্ণতা হইতে, আধ্যাত্মিক অসাড়তা হইতে মুক্ত হইবার জন্য আহ্বান করিয়াছিলেন তিনি তাহাদের মনুষ্যত্বকে বৃহদভাবে সার্থক করিতে চাহিয়াছিলেন। গুরুগোবিন্দ এই শিখদিগকে বিশেষ একটি প্রয়োজনের উপযোগী করিয়া বাঁধিয়া দিলেন, এবং যাহাতে তাহারা সেই প্রয়োজনকে কিছুতে বিস্মৃত না হয় সেইজন্য তাহাদের নামে বেশে ভূষায় আচারে নানা প্রকারে সেই প্রয়োজনটিকে তাহাদের চিত্তের মধ্যে বিশেষরূপে মুদ্রিত করিয়া দিলেন। এইরূপে শিখদের মনুষ্যত্বের উদ্যমধারাকে অন্য সকল দিক হইতে প্রতিহত করিয়া তিনি একটা বিশেষ দিকে প্রবাহিত করিলেন। ইহার দ্বারা একটা প্রয়োজনের ছাঁচের মধ্যে শিখ জাতি বদ্ধ হইয়া শক্ত হইয়া তৈরি হইল।

 যখন শিখেরা মুক্ত মানুষ না হইয়া বিশেষ প্রয়োজনযোগ্য মানুষ হইল তখন প্রবল রাজা তাহাদিগকে নিজের প্রয়োজনে লাগাইলেন এবং এইরূপে আজ পর্যন্তও তাহারা প্রবলকর্তৃক বিশেষ প্রয়োজনেই লাগিতেছে। স্পার্টায় গ্রীস যখন নিজের মানবত্বকে বিশেষ প্রয়োজনের অনুসারে সংকুচিত করিয়াছিল তখন সে যুদ্ধ করিতে পারিত বটে, কিন্তু আপনাকে খর্ব করিয়াছিল; কারণ, যুদ্ধ করিতে পারাই মানুষের শেষ লক্ষ্য নহে। এইরূপে মানুষ আশু প্রয়োজনের জন্য নিজের শ্রেয়কে নষ্ট করে এমন উদাহরণ অনেক আছে, এবং আজ পর্যন্ত এই অদূরদর্শী লুব্ধতার তাড়নায় সকল সমাজেই মনুষ্যবলি চলিতেছে। যে নররক্তপিপাসু অপদেবতা এই বলি গ্রহণ করে সে কখনো সমাজ, কখনো রাষ্ট্র, কখনো ধর্ম এবং কখনো তৎকালপ্রচলিত কোননা-একটা সর্বজনমোহকর নাম ধরিয়া মানুষকে নষ্ট করিয়া থাকে।

 শিখ-ইতিহাসের পরিণাম আমার কাছে অত্যন্ত শোকাবহ ঠেকে। যে নদী সমুদ্রে যাইবে বলিয়া অভ্রভেদী পর্বতের পবিত্র শুভ্রশিখর হইতে নিঃসৃত হইয়াছিল সে যখন পথের মধ্যে বালুকারাশির অভ্যন্তরে লুপ্ত হইয়া তাহার গতি হারায়, তাহার গান ভুলিয়া যায়, তখন সেই ব্যর্থতা যেমন শোচনীয়, তেমনি ভক্তের হৃদয় হইতে যে শুভ্র নির্মল শক্তিধারা বিশ্বকে পবিত্র ও উর্বর করিতে বাহির হইয়াছিল আজ তাহা যখন সৈন্যের বারিকে রক্তবর্ণ পঙ্কের মধ্যে পরিশোষিত হইয়া গেল তখন মানুষ ইহার মধ্যে কোনো গৌরব বা আনন্দ অনুভব করিতে পারে না।

 এই শিখ-ইতিহাস একদিন প্রতিজিঘাংসা অথবা অন্য কোনো সংকীর্ণ অভিপ্রায়ের আকর্ষণে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া মানব-সফলতার ক্ষেত্র হইতে স্খলিত হইয়াছে, কিন্তু তাহা অপেক্ষা নিম্নতর যে জাতীয় সফলতার ক্ষেত্র সেখানেও কোনো গৌরবলাভ করিতে পারে নাই। রণজিৎসিংহ যে রাজ্য বাঁধিয়াছিলেন তাহা রণজিৎসিংহেরই রাজ্য, গোবিন্দসিংহ মোগলদের সঙ্গে যে সংগ্রাম করিয়াছিলেন তাহা কেবলমাত্র শিখ সম্প্রদায়েরই সংগ্রাম। নিজের শিষ্যদলের বাহিরে তিনি সংকল্পকে প্রসারিত করেন নাই।

 এইখানে মারাঠা-ইতিহাসের সঙ্গে শিখ-ইতিহাসের প্রভেদ লক্ষিত হয়। শিবাজী যে চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তাহা কোনো ক্ষুদ্র দলের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। তাহার প্রধান কারণ, তিনি যে হিন্দুজাতি ও হিন্দুধর্মকে মুসলমান-শাসন হইতে মুক্তিদান করিবার সংকল্প করিয়াছিলেন তাহা আয়তনে শিখ জাতি ও ধর্ম অপেক্ষা অনেক বেশি ব্যাপক, সুতরাং সমগ্র ভারতের ইতিহাসকেই নূতন করিয়া গড়িয়া তোলাই তাহার লক্ষের বিষয় ছিল ইহাতে সন্দেহ নাই।

 গুরু গোবিন্দ এবং শিবাজী উভয়েই প্রায় সমসাময়িক। তখন ৬৭ আকবরের উদার রাষ্ট্রনীতির অবসান হইয়াছিল এবং সেইজন্যই মোগলশাসন তখন ভারতবর্ষের অমুসলমান ধর্ম ও সমাজকে আত্মরক্ষায় জাগরূক করিয়া তুলিয়াছিল।

 বস্তুত তখন ভিতরে বাহিরে আঘাত পাইয়া সমস্ত ভারতবর্ষে নানা স্থানেই একটা যেন ধর্মচেষ্টার উদ্বোধন হইয়াছিল। হিন্দুধর্মসমাজে তখন যে-একটি জীবনচাঞ্চল্য ঘটিয়াছিল, বিশেষভাবে দাক্ষিণাত্যে তাহা নানা সাধুভক্তকে আশ্রয় করিয়া নব নব ধর্মোৎসাহে প্রকাশ পাইয়াছিল। সেইরূপ সচেতন অবস্থায় ঔরঙ্গজেবের অত্যাচারে শিবাজীর ন্যায় বীরপুরুষ যে ভারতবর্ষে স্বধর্মকে জয়যুক্ত করিবার জন্য ব্রত গ্রহণ করিবেন, ইহা স্বাভাবিক।

 আবার ভারতবর্ষের পশ্চিমপ্রান্তে এই সময়ে নবভাবোদ্দীপ্ত শিখধর্মের প্রভাবে শিখ সম্প্রদায়ের চিত্ত ও প্রাণ পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। সেই কারণেই মোগল-শাসনের পীড়ন তাহাকে দমন করিতে পারে নাই, বরঞ্চ তাড়নাপ্রাপ্ত অগ্নির ন্যায় তাহাকে উদ্যত করিয়া তুলিয়াছিল।

 কিন্তু যদিচ ভিতরকার প্রভাব ও বাহিরের আঘাত উভয়েরই পক্ষে একইরকম ছিল, তথাপি তাহার ক্রিয়া গুরু গোবিন্দ এবং শিবাজীর মধ্যে এক ভাবে প্রকাশ পায় নাই।

 গুরু গোবিন্দ মোগলদের সঙ্গে অনেক লড়াই করিয়াছেন, কিন্তু তাহা কেমন খাপছাড়া-মতো। প্রতিহিংসা এবং আত্মরক্ষা -সাধনই তাহার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।

 কিন্তু শিবাজী যে-সকল যুদ্ধবিগ্রহে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তাহা সোপানপরম্পরার মতো; তাহা রাগারাগি লড়ালড়ি মাত্র নহে। তাহা সমস্ত ভারতবর্ষকে এবং দূর কালকে লক্ষ্য করিয়া একটি বৃহৎ আয়োজন বিস্তার করিতেছিল, তাহার মধ্যে একটি বিপুল আনুপূর্বিকতা ছিল। তাহা কোনো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রকাশ নহে, তাহা একটি বৃহৎ অভিপ্রায়সাধনের উদ্যোগ।

 কিন্তু তৎসত্ত্বেও দেখা যাইতেছে, শিখ ও মারাঠা উভয় জাতিরই ইতিহাস একই সময়ে একই প্রকার ব্যর্থতার মধ্যে সমাপ্ত হইয়াছে।

 ইহার কারণ কী? কারণ এই যে, যে উদ্দেশ্য সমস্ত দেশকে অধিকার করিতে চাহে তাহা কেবল একজন বা কয়েকজন মাত্র মনস্বী লোককে আশ্রয় করিয়া সফল হইতে পারে না। স্ফুলিঙ্গকে শিখা করিয়া তুলিতে হইলে কেবল প্রবল শক্তিতে চক্‌মকি ঠুকিলেই চলে না, উপযুক্ত পলিতারও আবশ্যক হয়। শিবাজীর চিত্ত সমস্ত দেশের লোকের সহিত আপনার যোগ স্থাপন করিতে পারে নাই। এইজন্য শিবাজীর অভিপ্রায় যাহাই থাক্‌-না, তাহার চেষ্টা সমস্ত দেশের চেষ্টারূপে জাগ্রত হইতে পারে নাই। এইজন্যই মারাঠার এই উদ্যোগ পরিণামে ভারতের অন্যান্য জাতির পক্ষে বগির উপদ্রব-রূপে নিদারুণ হইয়া উঠিয়াছিল।

 যে মঙ্গল সকলের তাহাকে সকলের চিত্তের মধ্যে যদি প্রতিষ্ঠিত না করা হয়, যদি তাহা কেবল আমার বা আমার দলের কয়েক জনের মধ্যেই বদ্ধ থাকে, তবে তাহার মঙ্গলরূপ ঘুচিয়া যায় এবং অন্যের পক্ষে ক্রমে তাহা উৎপাত হইয়া উঠে।

 শিবাজীর মনে যাহা বিশুদ্ধ ছিল, পেশওয়াদের মধ্যে তাহা ক্রমে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা-রূপে কলুষিত হইয়া উঠিল। এমন বিকার কদাচ ঘটিত না যদি এই ভাবটি দেশের সর্বসাধারণের মনে প্রসারিত হইবার পথ প্রশস্ত থাকিত। তাহা হইলে বৃহৎ আধারের মধ্যে বৃহৎ ভাব আপনার স্থান এবং খাদ্য পাইত; তাহা হইলে একটা কাঠ যখন নিবিবার মত হইত তখন কোথা হইতে আর-একটা কাঠ আপনি জ্বলিয়া উঠিত।

 আমাদের দেশে বারম্বার ইহাই দেখা গিয়াছে যে, এখানে শক্তির উদ্ভব হয় কিন্তু তাহার ধারাবাহিকতা থাকে না। মহাপুরুষেরা আসেন এবং তাঁহারা চলিয়া যান— তাহাদের আবির্ভাবকে ধারণ করিবার, পালন করিবার, তাহাকে পূর্ণ পরিণত করিয়া তুলিবার স্বাভাবিক সুযোগ এখানে নাই।

 ইহার কারণ আমাদের বিচ্ছিন্নতা। যে মাটিতে আঠা একেবারেই নাই সেখানেও বায়ুর বেগে বা পাখির মুখে বীজ আসিয়া পড়ে, কিন্তু তাহা অঙ্কুরিত হয় না, অথবা দু-চারটি পাতা বাহির হইয়া মুষ্‌ড়িয়া যায়। কারণ, সেখানকার আলগা মাটি রস ধারণ করিয়া রাখিতে পারে না। আমাদের সমাজের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার আর অন্ত নাই; ধর্মে কর্মে, আহারে বিহারে, আদানে প্রদানে সর্বত্রই বিচ্ছিন্নতা। এইজন্য ভাবের বন্যা নামে, কিন্তু বালুর মধ্যে শুষিয়া যায়; তেজের স্ফুলিঙ্গ পড়ে, কিন্তু ইতস্তত সামান্য ধোওয়া জাগাইয়া নিবিয়া যায়। এইজন্য মহৎ চেষ্টা বৃহৎ চেষ্টা হইয়া উঠে না এবং মহাপুরুষ দেশের সর্বসাধারণের অক্ষমতাকে সমুজ্জ্বল ভাবে সপ্রমাণ করিয়া নির্বাণ লাভ করেন।


 যাহা হউক, মারাঠা ও শিখের অভ্যুত্থান ও পতনের কারণ সম্বন্ধে তুলনা করিয়া বলিতে হইলে এই বলা যায় যে, শিখ একদা একটি অত্যন্ত বৃহৎ ভাবের আহ্বানে একত্র হইয়াছিল– এমন একটি সত্যধর্মের বার্তা তাহারা শুনিয়াছিল যাহা কোনো স্থানবিশেষের চিরাগত প্রথার মধ্যে বদ্ধ নহে এবং যাহা কোনো সময়বিশেষের উত্তেজনা হইতে প্রসূত হয় নাই– যাহা চিরকালের এবং সকল মানবের, যাহা ছোটো বড়ো সকলেরই অধিকারকে প্রশস্ত করে, চিত্তকে মুক্তি দেয় এবং যাহাকে স্বীকার করিলে প্রত্যেক মানুষই মনুষ্যত্বের পূর্ণতম গৌরবকে উপলব্ধি করে। নানকের এই উদার ধর্মের আহ্বানে বহু শতাব্দী ধরিয়া শিখ বহু দুঃখ সহ্য করিয়া ক্রমশ প্রসার লাভ করিতেছিল। এই ধর্মবোধ ও দুঃখভোগের গৌরবে শিখদের মধ্যে অলক্ষ্যে একটি মহৎ ঐক্যের ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল।

 গুরু গোবিন্দ শিখদের এই ধর্মবোধের ঐক্যানুভূতিকে কর্মসাধনার সুযোগে পরিণত করিয়া তুলিলেন। তিনি একটি বিশেষ সাময়িক প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ধর্মসমাজের ঐক্যকে রাষ্ট্রীয় উন্নতি-লাভের উপায়রূপে খর্ব করিলেন। কিন্তু এই উপলক্ষ্যে সম্প্রদায়কে সংকীর্ণ করিয়া লইয়া তিনি তাঁহার ঐক্যকে ঘনিষ্ঠ করিয়া লইলেন; যে জাতিভেদ তাহার প্রবল অন্তরায় ছিল তাহাকে সমূলে উৎপাটিত করিলেন।

 গুরু গোবিন্দ তাহার শিষ্যসমাজের মধ্য হইতে এই-যে ভেদবিভাগকে এক কথায় দূর করিতে পারিয়াছিলেন তাহার প্রধান কারণ এই যে, নানকের উদার ধর্মের প্রভাবে পরস্পরের মধ্যে ভেদবুদ্ধির ব্যবধান আপনিই তলে তলে ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছিল। গুরু গোবিন্দ তাহাকে আঘাত করিবামাত্র তাহা শতখণ্ড হইয়া পড়িয়া গেল। পূর্ব হইতে গভীরতররূপে যদি ইহার আয়োজন না থাকিত তবে সহস্র প্রয়োজন হইলেও গুরু গোবিন্দ কিছুই করিতে পারিতেন না। শুধু তাই নয়, সকল কর্মনাশা এই ভেদকে দূর করিতে হইবে এই সংকল্পমাত্রও তাঁহার মনে আকার গ্রহণ করিতে পারিত না।

 কিন্তু গুরু গোবিন্দ কী করিলেন? ঐক্যকেই পাকা করিলেন, অথচ যে মহাভাবের শক্তির সহায়তায় তাহা করা সম্ভব হইল তাহাকে সিংহাসনচ্যুত করিলেন, অন্তত তাহার সিংহাসনে আর-একজন প্রবল শরিক বসাইয়া দিলেন।

 ঐক্যই ভাবের বাহন। এই কারণে মহৎ ভাব মাত্রই সেই বাহনকে সৃষ্টি করিবার জন্য আপনার শক্তিকে নিযুক্ত করে! বাহনের গৌরব তাহার আরোহীর মাহাত্ম্যে। গুরু গোবিন্দ সাময়িক ক্রোধের উত্তেজনায় ও প্রয়োজন-বোধে বাহনকে প্রবল করিয়া তুলিলেন বটে, কিন্তু আরোহীকে খর্ব করিয়া দিলেন।

 তাহা হইতে ফল এই হইল, উপস্থিতমত কিছু কিছু কার্যসিদ্ধি ঘটিল, কিন্তু যাহা মুক্তির দিকে অগ্রসর হইতেছিল তাহা বন্ধনে পড়িল; শিখদের মধ্যে পরস্পরকে নিবিড় করিবার ব্যবস্থা রহিল, কিন্তু অগ্রসর করিয়া দিবার বেগ রহিল না। এইজন্য বহু শতাব্দী ধরিয়া যে শিখ পরম গৌরবে মানুষ হইবার দিকে চলিয়াছিল তাহারা হঠাৎ এক সময়ে থামিয়া সৈন্য হইয়া উঠিল— এবং ঐখানেই তাহাদের ইতিহাস শেষ হইয়া গেল।

 শিবাজী যে উদ্দেশ্য সাধনে তাহার জীবন প্রয়োগ করিয়াছিলেন তাহা কোনো সংকীর্ণ সাময়িক প্রয়োজন-মূলক ছিল না এবং পূর্ব হইতেই দাক্ষিণাত্যের ধর্মগুরুদের প্রভাবে তাহার ক্ষেত্র কতকটা প্রস্তুত হইয়াছিল। এইজন্য তাহার উৎসাহ কিছুকালের জন্য যেন সমস্ত মারাঠা জাতির মধ্যেই সঞ্চারিত হইতে পারিয়াছিল।

 ফুটা পাত্রে জল ভরিয়া উঠিতে পারে, কিন্তু তাহাতে জল থাকে না। ক্ষণকালের ভাবোচ্ছ্বাসের প্রাবল্যে মনে হয় সমস্ত বুঝি ছাপাইয়া এক হইয়া গেল, কিন্তু ছিদ্রের কাজ ভিতরে ভিতরে চলিতে থাকে। ভারতবর্ষের সমাজ ছিদ্রে পূর্ণ, কোনো ভাবকে তাহা ধরিয়া রাখিতে পারে না, এইজন্য সমাজে প্রাণময় ভাবের পরিবর্তে শুষ্ক নির্জীব আচারের এমন নিদারুণ প্রাদুর্ভাব।

 শিবাজী তাহার সমসাময়িক মারাঠা-হিন্দু সমাজে একটা প্রবল ভাবের প্রবর্তন এতটা পর্যন্ত করিয়াছিলেন যে, তাঁহার অভাবেও কিছুদিন পর্যন্ত তাহার বেগ নিঃশেষিত হয় নাই। কিন্তু শিবাজী সেই ভাবের আধারটিকে পাকা করিয়া তুলিতে পারেন নাই, এমন-কি, চেষ্টামাত্র করেন নাই। সমাজের বড়ো বড়ো ছিদ্রগুলির দিকে না তাকাইয়া তাহাকে লইয়া ক্ষুব্ধ সমুদ্রে পাড়ি দিলেন। তখনই পাড়ি না দিলে নয় বলিয়া এবং পাড়ি দিবার আর-কোনো উপায় ছিল না বলিয়াই যে অগত্যা এই কাজ করিয়াছেন তাহা নহে। এই ছিদ্রকেই পার করা তাহার লক্ষ্য ছিল। শিবাজী যে হিন্দুসমাজকে মোগল-আক্রমণের বিরুদ্ধে জয়যুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, আচারবিচারগত বিভাগ-বিচ্ছেদ সেই সমাজেরই একেবারে মূলের জিনিস। সেই বিভাগমূলক ধর্মসমাজকেই তিনি সমস্ত ভারতবর্ষে জয়ী করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ইহাকেই বলে বালির বাঁধ বাধা, ইহাই অসাধ্য সাধন।

 শিবাজী এমন কোনো ভাবকে আশ্রয় ও প্রচার করেন নাই যাহা হিন্দু সমাজের মূলগত ছিদ্রগুলিকে পরিপূর্ণ করিয়া দিতে পারে। নিজের ধর্ম বাহির হইতে পীড়িত অপমানিত হইতেছে এই ক্ষোভ মনে লইয়া তাহাকে ভারতবর্ষের সর্বত্র বিজয়ী করিবার ইচ্ছা স্বাভাবিক হইলেও তাহা সফল হইবার নহে; কারণ, ধর্ম যেখানে ভিতর হইতেই পীড়িত হইতেছে, যেখানে তাহার ভিতরই এমন-সকল বাধা আছে যাহাতে মানুষকে কেবলই বিচ্ছিন্ন ও অপমানিত করিতেছে, সেখানে সে দিকে দৃষ্টিপাতমাত্র না করিয়া, এমন-কি, সেই ভেদবুদ্ধিকেই মুখ্যত ধর্মবুদ্ধি বলিয়া জ্ঞান করিয়া সেই শতদীর্ণ ধর্মসমাজের স্বারাজ্য এই সুবৃহৎ ভারতবর্ষে স্থাপন করা কোনো মানুষেরই সাধ্যায়ত্ত নহে; কারণ, তাহা বিধাতার বিধানসংগত হইতে পারে না। কেবল আঘাত পাইয়া, ক্রুদ্ধ হইয়া, অভিমান করিয়া, কোনো জাতি বড়ে হইতে, জয়ী হইতে পারে না— যতক্ষণ তাহার ধর্মবুদ্ধির মধ্যেই অখণ্ডতার তত্ত্ব কাজ করিবার স্থান না পায়, যতক্ষণ মিলনের শক্তি কোনো মহৎ ভাবের অমৃতরসে চিরসঞ্জীবিত হইয়া সকল দিক দিয়াই অন্তরে বাহিরে তাহাকে এক করিবার অভিমুখে না লইয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত বাহিরের কোনো আঘাতে ও প্রতিভাশালী ব্যক্তিবিশেষের কোনো বীরত্বেই তাহাকে দৃঢ়ঘনিষ্ঠ, তাহাকে সজীবসচেতন করিয়া তুলিতে পারে না।