ইন্দিরা (১৮৭৩)/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 তাহার পরেই মনেই বলিলাম, “এইবার সোণার চাঁদ, আর কোথায় যাইবে? তবে নাকি আমাকে গ্রহণ করিবে না?” যে অভিপ্রায়ে, আমার এত জাল পাতা, তাহা সিদ্ধই ইল। এখন আমি তাঁহার স্ত্রী বলিয়া পরিচয় দিলে, তিনি। যদি গ্রহণ না করেন, তবে তাঁহাকে সর্ব্বত্যাগী হইতে হইবে।

 আমার পিতা নাম রাখিয়াছিলেন “ইন্দিরা”—মাতা নাম রাখিয়াছিলেন “কুমুদিনী।” শ্বশুর বাড়ীতে ইন্দিরা নামই জানিত, কিন্তু পিত্রালয়ে অনেকেই আমাকে কুমুদিনী বলিত। রাম রাম দত্তের বাড়ীতে আমি কুমুদিনী নাম ভিন্ন ইন্দিরা নাম বলি নাই। ইঁহার কাছে আমি কুমুদিনী ভিন্ন ইন্দিরা নাম প্রকাশ করি নাই। কুমুদিনী নামেই লেখা পড়া হইয়াছিল।

 কিছু দিন আমরা কলিকাতায় সুখে সচ্ছলে রহিলাম। আমি এপর্য্যন্ত পরিচয় দিলাম না। ইচ্ছা ছিল, একেবারে মহেশপুরে গিয়া পরিচয় দিব। ছলে কৌশলে স্বামীর নিকট হইতে মহেশপুরের সম্বাদ সকল জানিয়াছিলাম-সকলে কুশলে ছিলেন, কিন্তু তাঁহাদের দেখিবার জন্য বড় মন ব্যস্ত হইয়াছিল।

 আমি স্বামীকে বলিলাম, “আমি একবার কালাদীঘি যাইয়া পিতামাতাকে দেখিয়া আসিব। আমাকে পাঠাইয়া দাও।”

 স্বামী ইহাতে নিতান্ত অনিচ্ছুক। আমাকে ছাড়িয়া দিয়া কি প্রকারে থাকিবেন? কিন্তু এদিকে আমার আজ্ঞাকারী, “না” বলিতে পারিলেন না। বলিলেন, “কালাদীঘি যাইতে আসিতে এখান হইতে পনের দিনের পথ; এতদিন তোমাকে না দেখিতে পাইলে আমি মরিয়া যাইব। আমি তোমার সঙ্গে যাইব।”

 আমি বলিলাম, “আমিও তাই চাই। কিন্তু তুমি কালাদীঘি গিয়া কোথায় থাকিবে?”

 তিনি চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কালাদীঘিতে কতদিন থাকিবে?”

 আমি বলিলাম, “তোমাকে যদি না দেখিতে পাই, তবে পাঁচদিনের বেশী থাকিব না।

 তিনি বলিলেন, “সেই পাঁচদিন আমি বাড়ীতে থাকিব। পাঁচদিনের পর তোমাকে কালাদীঘি হইতে লইয়া আসিব।”

 এইরূপ কথা বার্ত্তা হইলে পর আমরা যথাকালে উভয়ে শিবিকারোহণে কলিকাতা হইতে যাত্রা করিলাম। তিনি আমাকে কালাদীঘি নামাক সেই হতভাগ্য দীঘি পার করিয়া গ্রামের মধ্য পর্য্যন্ত পঁহুছিয়া দিয়া নিজালয় অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

 তিনি পশ্চাৎ ফিরিলে, আমি বাহ কদিগকে বলিলাম, “আমি আগে মহেশপুর যাইব—তাহার পর কালদীঘি আসিব। তোমরা আমাকে মহেশপুর লইয়া চল। যথেষ্ট পুরস্কার দিব।”  তাহারা আমাকে মহেশপুর লইয়া গেল। গ্রামের বাহিরে বাহক ও রক্ষকদিগকে অবস্থিতি করিতে বলিয়া দিয়া আমি পদব্রজে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। পিতার গৃহ সম্মুখে দেখিয়া, এক নির্জ্জন স্থানে বসিয়া অনেক রোদন করিলাম। তাহার পর গৃহমধ্যে প্রবেশ করলাম। সম্মুখেই পিতাকে দেখিয়া প্রণাম করিলাম। তিনি আমাকে চিনিতে পারিয়া আহ্লাদে বিবশ হইলেন। সে সকল কথা এস্থানে বলিবার অবসর নাই।

 আমি এত দিন কোথায় ছিলাম, কি প্রকারে আসিলাম—তাহা কিছুই বলিলাম না। পিতা মাতা জিজ্ঞাসা করিলে বলিলাম, “এর পরে বলিব।”

 পর দিন পিতা আমার শ্বশুর বাড়ী লোক পাঠাইলেন। পত্রবাহককে বলিয়া দিলেন, “জামাতা যদি বাড়ী না থাকেন, তবে যেখানে থাকেন, সেইখানে গিয়া এই পত্র দিয়া আসিবি।”

 আমি মাতাকে বলিলাম, “আমি আসিয়াছি, এ কথা তাঁহাকে জানাইও না। আমি এতদিন ঘরে ছিলাম না, কি জানি, তিনি যদি গ্রহণ করিতে অনিচ্ছুক হন, তবে আসিবেন না। অন্য কোন ছলে এখানে তাঁহাকে আনাও। তিনি এখানে আসিলে আমি সন্দেহ মিটাইব।”  মাতা এ কথা পিতাকে বলিলে তিনি সম্মত হইলেন। পত্রে লিখিলেন, “আমি উইল করিব। তুমি আমার জামাতা এবং পরমাত্মীয়, আর সদ্বিবেচক। অতএব তোমার সঙ্গে পরামর্শ করিয়া উইল করিব। তুমি পত্র পাঠ এখানে আসিবে।” তিনি পত্র পাঠ আসিলেন। তিনি এখানে আসিলে পিতা তাঁহাকে যথার্থ কথা জানাইলেন।

 শুনিয়া স্বামী মৌনাবলম্বন করিলেন। পরে বলিলেন, “আপনি পূজ্য ব্যক্তি। যে ছলেই হউক, এখানে আসিয়া যে আপনার দর্শন লাভ করিলাম, ইহাই যথেষ্ট। কিন্তু আপনার কন্যা এতদিন গৃহে ছিলেন না—কোথায় কি চরিত্রে কাহার গৃহে ছিলেন, তাহা কেহ জানে না। অতএব তাহাকে আমি গ্রহণ করিব না।”

 পিতা মর্ম্মান্তিক পীড়িত হইলেন। এ কথা মাতাকে বলিলেন, মা আমাকে বলিলেন। আমি সমবয়স্কাদিগকে বলিলাম, “তোমরা উঁহাদিগকে চিন্তা করিতে মানা কর। তাঁকে একবার অন্তঃপুরে আন—তাহা হইলেই আমি উহাকে গ্রহণ করাইব।”

 কিন্তু অন্তঃপুরে আসিতে কোন মতেই স্বীকৃত হইলেন না। বলিলেন, “আমি যে স্ত্রীকে গ্রহণ করিব না, তাহাকে সম্ভাষণও করি না।” শেষে মাতার রোদন এবং আমার সমবয়স্কাদিগের ব্যঙ্গের জ্বালায় সন্ধ্যার পর অন্তঃপুরে জল খাইতে আসিলেন।

 তিনি জলযোগ করিতে আসনে বসিলেন। কেহ তাঁহার নিকটে দাঁড়াইল না—সকলেই সরিয়া গেল। তিনি অন্য মনে, মুখ নত করিয়া, আহার করিতেছিলেন, এমত সময়ে আমি নিঃশব্দে তাঁহার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহার চক্ষু টিপিয়া ধরিলাম। তিনি হাসিতে২ বলিলেন,

 “হাঁ দেখ্‌, কামিনি, তুই আরও কি কচি খুকী যে আমার ঘাড়ের উপর পড়িস্‌?”

 কামিনী আমার কনিষ্ঠা ভগিনীর নাম।

 আমি বলিলাম, “আমি কামিনী নই, কে বল, তবে ছাড়িব।”

 আমার কণ্ঠ-স্বর শুনিয়া তিনি চমকিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “এ কি এ?”

 আমি তাঁহার চক্ষু ছাড়িয়া সম্মুখে দাঁড়াইলাম। বলিলাম, “চতুর চূড়ামণি! আমার নাম ইন্দিরা—আমি হরমোহন দত্তের কন্যা, এই বাড়ীতে থাকি। আপনাকে প্রাতঃপ্রণাম —আপনার কুমুদিনীর মঙ্গল ত?”

 তিনি অবাক্ হইলেন। আমাকে দেখিয়াই যে তাঁহার আহ্লাদ হইল, তাহা বুঝিতে পারিলাম। বলিলেন, “এ আবার কোন্ রঙ্গ কুমুদিনি? তুমি এখানে কোথা হইতে?”

 আমি বলিলাম, “কুমুদিনী আমার আর একটি নাম। তুমি বড় গোবর গণেশ, তাই এত দিন আমাকে চিনিতে পার নাই। কিন্তু তোমাকে যখন রাম রাম দত্তের বাড়ী ভোজন করিতে দেখিয়াছিলাম, আমি তখনই তোমাকে চিনিয়াছিলাম। নচেৎ সে দিন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতাম না। প্রাণাধিক—আমি কুলটা নহি।”

 তিনি ককটু আত্ম বিস্মৃতের মত হইলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে এতদিন এত ছলনা করিয়াছিলে কেন?”

 আমি বলিলাম, “তুমি প্রথম সাক্ষাতের দিনে বলিয়াছিলে যে তোমার স্ত্রীকে পাইলেও গ্রহণ করিবে না। নচেৎ সেই দিনেই পরিচয় দিতাম।” আমার অঞ্চলে বাঁধিয়া আনিয়াছিলাম। তাহা খুলিয়া দেখাইয়া বলিলাম “সেই রাত্রেই আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যে ‘হয় তুমি আমায় গ্রহণ করিবে, নচেৎ আমি প্রাণত্যাগ করিব।’ সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্যই এই খানি লেখাইয়া লইয়াছি। কিন্তু ইহা আমি ভাল করি নাই। তোমার সঙ্গে শঠতা করিয়াছি। তোমার অভিরুচি হয়, আমায় গ্রহণ কর; না অভিরুচি হয়, আমি তোমার উঠান ঝাঁট দিয়া খাইব—তাহা হইলেও তোমাকে দেখিতে পাইব, দান পত্র আমি এই নষ্ট করিলাম।”

 এই বলিয়া সেই দান পত্র তাঁহার সম্মুখে খণ্ড২ করিয়া ছিন্ন করিলাম।

 তিনি গাত্রোত্থান করিয়া——আমাকে আলিঙ্গন করিলেন। বলিলেন, “তুমি আমার সর্ব্বস্ব। তোমায় ত্যাগ করিলে আমি প্রাণে মরিব। তুমি আমার গৃহে গৃহিণী হইবে চল।”


সমাপ্ত।