কথা (১৯১২)/মস্তক বিক্রয়

মস্তক বিক্রয়

(মহাবস্ত্ববদান )

কোশল নৃপতির তুলনা নাই,
 জগৎ জুড়ি যশােগাথা;
ক্ষীণের তিনি সদা শরণ ঠাই,
 দীনের তিনি পিতামাতা।
সে কথা কাশীরাজ শুনতে পেয়ে
 জ্বলিয়া মরে অভিমানে;—
“আমার প্রজাগণ আমার চেয়ে
 তাহারে বড় করি মানে!

আমার হতে যার আসন নীচে
 তাহার দান হল বেশি!
ধর্ম্ম দয়া মায়ী সকলি মিছে,
 এ শুধু তার রেষারেষি।”
কহিলা “সেনাপতি, ধর কৃপাণ,
 সৈন্য কর সব জড়!
আমার চেয়ে হবে পুণ্যবান্,
 স্পর্ধা বাড়িয়াছে বড়।”
চলিল কাশীরাজ যুদ্ধসাজে,
 কোশলরাজ হারি রণে
রাজ্য ছাড়ি দিয়া ক্ষুব্ধ লাজে
 পলায়ে গেল দূরবনে।
কাশীর রাজা হাসি কহে তখন
 আপন সভাসদ মাঝে-
“ক্ষমতা আছে যার রাখিতে ধন
 তারেই দাতা হওয়া সাজে।”


সকলে কাঁদি বলে—“দারুণ রাহু।
 এমন চাঁদেরেও হানে!
লক্ষ্মী খোঁজে শুধু বলীর বাহু।
 চাহে না ধর্ম্মের পানে।”-
“আমরা হইলাম পিতৃহারা”—
 কাঁদিয়া কহে দশদিক্‌-

“সকল জগতের বন্ধু যারা।
 তাঁদের শত্রুরে ধিক!”
শুনিয়া কাশীরাজ উঠিল রাগি'
 “নগরে কেন এত শােক!
আমি ত আছি তবু কাহার লাগি
 কাঁদিয়া মরে যত লােক!
আমার বাহুবলে হারিয়া তবু
 আমারে করিবে সে জয়!
অরির শেষ নাহি রাখিবে কভু
 শাস্ত্রে এই মত কয়।
মন্ত্রী রটি দাও নগর মাঝে,
 ঘােষণা কর চারিধারে—
যে ধরি আনি দিবে কোশলরাজে
 কনক শত দিব তারে।”
ফিরিয়া রাজদূত সকল বাটি
 রটনা করে দিনরাত।
যে শােনে, আঁখি মুদি রসনা কাটি
 শিহরি কানে দেয় হাত।


রাজ্যহীন রাজা গহনে ফিরে
 মলিন চীর দীনবেশে।
পথিক একজন অশ্রুনীরে
 একদা শুধাইল এসে,—

“কোথা গো বনবাসী বনের শেষ,
 কোশলে যাব কোন্ মুখে!”
শুনিয়া রাজা কহে, “অভাগা দেশ,
 সেথায় যাবে কোন্ দুখে?”
পথিক কহে “আমি বণিকজাতি,
 ডুবিয়া গেছে মাের তরী।
এখন্ দ্বারে দ্বারে হস্ত পাতি
 কেমনে রব প্রাণ ধরি।
করুণা-পারাবার কোশলপতি
 শুনেছি নাম চারিধারে,
অনাথনাথ তিনি দীনের গতি,
 চলেছে দীন তাঁরি দ্বারে।”
শুনিয়া নৃপসুত ঈষৎ হেসে
 রুধিলা নয়নের বারি,
নীরবে ক্ষণকাল ভাবিয়া শেষে
 কহিলা নিশ্বাস ছাড়ি,—
“পান্থ যেথা তব বাসনা পূরে
 দেখায়ে দিব তারি পথ।
এসেছ বহু দুখে অনেক দূরে
 সিদ্ধ হবে মনােরথ।”


বসিয়া কাশীরাজ সভার মাঝে;
 দাঁড়াল জটাধারী এসে।

“হেথায় আগমন কিসের কাজে?”
 নৃপতি শুধাইল হেসে।
“কোশলরাজ আমি, বন ভবন”
 কহিলা বনবাসী ধীরে,—
“আমার ধরা পেলে যা দিবে পণ
 দেহ তা মাের সাথীটিরে।”
উঠিল চমকিয়া সভার লােকে,
 নীরব হল গৃহতল,
বর্ম্ম-আবরিত দ্বারীর চোখে
 অশ্রু করে ছলছল।
মৌন রহি রাজা ক্ষণেক তরে
 হাসিয়া কহে—“ওহে বন্দী,
মরিয়া হবে জয়ী আমার পরে
 এমনি করিয়াছ ফন্দী!
তােমার সে আশায় হানিব বাজ,
 জিনিব আজিকার রণে,
রাজ্য ফিরি দিব, হে মহারাজ,
 হৃদয় দিব তারি সনে।”
জীর্ণ-চীর-পরা বনবাসীরে
 বসাল নৃপ রাজাসনে,
মুকুট তুলি দিল মলিন শিরে,
 ধন্য কহে পুরজনে।

২১শে কার্তিক, ১৩০৪