কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/চতুর্থ খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

কৃতসঙ্কেতে।

——————"I will have grounds
More relative than this."

Hamlet.

কপালকুণ্ডলা সে দিন সন্ধ্যা পর্য্যন্ত অনন্যচিন্তা হইয়া কেবল ইহাই বিবেচনা করিতেছিলেন যে, ব্রাহ্মণবেশীর সহিত সাক্ষাৎ বিধেয় কি না। পতিব্রতা যুবতীর পক্ষে রাত্রিকালে নির্জ্জনে অপরিচিত পুৰুষের সহিত সাক্ষাৎ যে অবিধেয় ইহা ভাবিয়া তাঁহার মনে সঙ্কোচ জন্মে নাই; তদ্বিষয়ে যে তাঁহার স্থির সিদ্ধান্তই ছিল যে সাক্ষাতের উদ্দেশ্য দূষ্য না হইলে এমত সাক্ষাতে দোষ নাই—পুৰুষে পুৰুষে বা স্ত্রীলোকে স্ত্রীলোকে যেরূপে সাক্ষাতের অধিকার, স্ত্রী পুৰুষে সাক্ষাতের উভয়েরই সেই রূপ উচিত বলিয়া তাঁহার বোধ ছিল; বিশেষ ব্রাহ্মণবেশী পুৰুষ কি না তাহাতে সন্দেহ। সুতরাং সে সঙ্কোচ অনাবশ্যক, কিন্তু এ সাক্ষাতে মঙ্গল কি অমঙ্গল জন্মিবে তাহাই অনিশ্চিত বলিয়া কপালকুণ্ডলা এত দূর সঙ্কোচ করিতেছিলেন। প্রথমে ব্রাহ্মণবেশীর কথোপকথন, পরে কাপালিকের দর্শন, তৎপরে স্বপ্ন, এই সকল হেতুতে কপালকুণ্ডলার হৃদয়ে আত্মসম্বন্ধে মহাভীতি সঞ্চার হইয়াছিল; নিজ অমঙ্গল যে অদূরবর্ত্তী এমত সন্দেহ প্রবল হইয়াছিল। সেই অমঙ্গল যে কাপালিকের আগমন সহিত সম্বন্ধমিলিত, এমত সন্দেহও অমূলক বোধ হইল না। এই ব্রাহ্মণবেশীকে তাহারই সহচর বোধ হইতেছে—অতএব তাহার সহিত সাক্ষাতে সেই আশঙ্কার বিষয়ীভূত অমঙ্গলে পতিতও হইতে পারেন। সে ত স্পষ্টই বলিয়াছে যে কপালকুণ্ডলা সম্বন্ধেই পরামর্শ হইতেছিল। কিন্তু এমতও হইতে পারে যে ইহা হইতে তন্নিরাকরণ সূচনা হইবে। ব্রাহ্মণকুমার এক ব্যক্তির সহিত গোপনে পরামর্শ করিতেছিল, সে ব্যক্তিকে এই কাপালিক বলিয়া বোধ হয়। সেই কথোপকথনে কাহারও মৃত্যুর সঙ্কল্প প্রকাশ পাইতেছিল; নিতান্ত পক্ষে চিরনির্ব্বাসন। সে কাহার? ব্রাহ্মণবেশীত স্পষ্ট বলিয়াছে যে কপালকুণ্ডলা সন্ধন্ধেই কুপরামর্শ হইতেছিল। তবে তাহারই মৃত্যু বা তাহারই চিরনির্ব্বাসন কল্পনা হইতেছিল। তবে যখন এই সকল ভীষণ অভিসন্ধিতে ব্রাহ্মণবেশী সহকারী, তখন তাঁহার নিকট রাত্রিকালে একাকিনী দুর্গম কাননে গমন করা কেবল বিপদেরই কারণ হইতে পারে। কিন্তু কালি রাত্রে স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন; সে স্বপ্ন,—সে স্বপ্নের তাৎপর্য্য কি? স্বপ্নে ব্রাহ্মণবেশী মহাবিপত্তি কালে আসিয়া তাঁহাকে রক্ষা করিতে চাহিয়াছিলেন, কার্য্যেও তাহাই ফলিতেছে, ব্রাহ্মণবেশী সকল ব্যক্ত করিতে চাহিতে ছেন। তিনি স্বপ্নে বলিয়াছিলেন “নিমগ্ন কর।” কার্য্যেও কি সেইরূপ বলিবেন? ব্রাহ্মণবেশীর সাহায্য ত্যাগ করিয়া বিপদ সাগরে ডুবিবেন? না―না―ভক্তবৎসল। ভবানী অনুগ্রহ করিয়া স্বপ্নে তাঁহার রক্ষা হেতু উপদেশ দিয়াছেন, ব্রাহ্মণবেশী আসিয়া তাঁহাকে উদ্ধার করিতে চাহিতেছেন; তাহার সাহায্য ত্যাগ করিলে নিমগ্ন হইবেন। অতএব কপালকুণ্ডলা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করাই স্থির করিলেন। বিজ্ঞ ব্যক্তি এইরূপ সিদ্ধান্ত করিত কি না তাহাতে সন্দেহ; কিন্তু বিজ্ঞ ব্যক্তির সিদ্ধান্তের সহিত আমাদিগের সংস্রব নাই। কপালকুণ্ডলা বিশেষ বিজ্ঞ ছিলেন না—সুতরাং বিজ্ঞের ন্যায় সিদ্ধান্ত করিলেন না। কৌতূহলপরবশ রমণীর ন্যায় সিদ্ধান্ত করিলেন, ভীমকান্ত রূপরাশিদর্শনলোলুপ যুবতীর ন্যায় সিদ্ধান্ত করিলেন, নৈশবনভ্রমণবিলাসিনী সন্ন্যাসিপালিতার ন্যায় সিদ্ধান্ত করিলেন, ভবানীভক্তি ভাববিমোহিতার ন্যায় সিদ্ধান্ত করিলেন; জ্বলন্ত বহ্নিশিখায় পতনোন্মুখ পতঙ্গের ন্যায় সিদ্ধান্ত করিলেন।

 সন্ধ্যার পরে গৃহকর্ম্ম কতক কতক সমাপন করিয়া কপালকুণ্ডলা পূর্ব্বমত বনাভিমুখে যাত্রা করিলেন। কপালকুণ্ডলা যাত্রাকালে শয়নাগারে প্রদীপটী উজ্জ্বল করিয়া গেলেন। তিনি যেমন কক্ষ্যা হইতে বাহির হইলেন, অমনি গৃহের প্রদীপ নিবিয়া গেল।

 যাত্রা কালে কপালকুণ্ডলার এক কথা বিস্মৃত হইলেন। ব্রাহ্মণবেশী কোন স্থানে সাক্ষাৎ করিতে লিখিয়া ছিলেন? এই জন্য লিপি পুনর্ব্বার পাঠের আবশ্যক হইল। গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া যে স্থানে প্রাতে লিপি রাখিয়া ছিলেন, সে স্থানে অন্বেষণ করিলেন, সে স্থানে লিপি পাইলেন না। স্মরণ হইল যে কেশবন্ধন সময়ে, ঐ লিপি সঙ্গে সঙ্গে রাখিবার জন্য, কবরী মধ্যে বিন্যস্ত করিয়াছিলেন। অতএব কবরী মধ্যে অঙ্গুলি দিয়া সন্ধান করিলেন। অঙ্গুলিতে লিপি স্পর্শ না হওয়াতে কবরী আলুলায়িত করিলেন, তথাপি সে লিপি পাইলেন না। তখন গৃহের অন্যান্য স্থানে তত্ত্ব করিলেন। কোথাও না পাইয়া, পরিশেষে পূর্ব্ব সাক্ষাৎ স্থানেই সাক্ষাৎ সম্ভব সিদ্ধান্ত করিয়া পুনর্যাত্রা করিলেন। অনবকাশ প্রযুক্ত সে বিশাল কেশরাশি পুনর্বিন্যস্ত করিতে পারেন নাই, অতএব আজি কপালকুণ্ডলা অনূঢ়া কালের মত কেশমণ্ডলমধ্যবর্ত্তিনী হইয়া চলিলেন।