কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/দ্বিতীয় খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

পান্থনিবাসে।

“ক্বৈষা যোষিৎ প্রকৃতিচপলা।

উদ্ধবদূত।

আমি বলিয়াছি নবকুমারের সঙ্গিনী অসামান্যা রূপসী। এ স্থলে, যদি প্রচলিত প্রথানুসারে তাঁহার রূপবর্ণনে প্রবৃত্ত না হই, তবে পুৰুষ পাঠকেরা বড়ই ক্ষুণ্ন হইবেন। আর যাঁহারা স্বয়ং সুন্দরী তাঁহারা পড়িয়া বলিবেন, “তবে বুঝি মাগী পাঁচপাঁচি!” সুতরাং এই কামিনীর রূপ বর্ণনে আমাকে প্রবৃত্ত হইতে হইল। কিন্তু কি লইয়াই বা তাঁহার বর্ণনা করি? কখন কখন বটতলার মা সরস্বতী আমার স্কন্ধে চাপিয়া থাকেন। তাঁহার অনুগ্রহে কতকগুলিন ফলমূলের ডালি সাজাইয়া রূপ বর্ণনার কার্য্য এক প্রকার সাধন করিতে পারি, কিন্তু পাছে দাড়িম্ব রম্ভা ইত্যাদি নাম শুনিয়া পাঠক মহাশয়ের জঠরানল জ্বলিয়া উঠে, এই আশঙ্কায় সে চেষ্টায় বিরত রহিলাম।

 যদি এই রমণী নির্দ্দোষসৌন্দর্য্যবিশিষ্টা হইতেন, তবে বলিতাম, “পুৰুষ পাঠক! ইনি আপনার গৃহিণীর ন্যায় সুন্দরী। আর সুন্দরি পাঠকারিণি! ইনি আপনার দর্পণস্থ ছায়ার ন্যায় রূপবতী।” তাহা হইলে রূপ বর্ণনার এক শেষ হইত। দুর্ভাগ্যবশতঃ ইনি সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী নহেন, সুতরাং নিরস্ত হইতে হইল।

 ইনি যে নির্দ্দোষ সুন্দরী নহেন তাহা বলিবার কারণ এই যে, প্রথমতঃ ইহার শরীর মধ্যমাকৃতির অপেক্ষা কিঞ্চিৎ দীর্ঘ; দ্বিতীয়তঃ অধরৌষ্ঠ কিছু চাপা; তৃতীয়তঃ প্রকৃত পক্ষে ইনি গৌরাঙ্গিণী নহেন।

 শরীর ঈষদ্দীর্ঘ বটে, কিন্তু হস্তপদ হৃদয়াদি সর্ব্বাঙ্গ সুগোল এবং সম্পূর্ণীভূত। বর্ষাকালে বিটপীলতা যেমন আপন পত্ররাশির বাহুল্যে দলমল করে, ইহার শরীর তেমনি আপন পূর্ণতায় দলমল করিতেছিল; সুতরাং ঈষদ্দীর্ঘ দেহও পূর্ণতাহেতুক অধিকতর শোভার কারণ হইয়াছিল। যাহাদিগকে প্রকৃতপক্ষে গৌরাঙ্গিণী বলি, তাঁহাদিগের মধ্যে কাহারও বর্ণ পূর্ণচন্দ্র কৌমুদীর ন্যায়, কাহারও কাহারও ঈষদারক্তবদনা উষার ন্যায়। ইহার এতদুভয়বর্জ্জিত, সুতরাং ইহাকে প্রকৃত গৌরাঙ্গিণী বলিলাম না বটে, কিন্তু মুগ্ধকরী শক্তিতে ইহার বর্ণ ন্যূন নহে। ইনি শ্যামবর্ণা। “শ্যামা মা” বা “শ্যামসুন্দর” যে শ্যামবর্ণের উদাহরণ এ সে শ্যামবর্ণ নহে। তপ্ত কাঞ্চনের যে শ্যামবর্ণ এ সেই শ্যাম। পূর্ণচন্দ্রকরলেখা, অথবা হেমাম্বুদকিরিটিনী উষা, যদি গৌরাঙ্গিণীদিগের বর্ণপ্রতিমা হয়, তবে বসন্তপ্রসূত নবচূতদলরাজির শোভা এই শ্যামার বর্ণের অনুরূপ বলা যাইতে পারে। পাঠক মহাশয়দিগের মধ্যে অনেকে গৌরাঙ্গিণীর বর্ণের প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন, কিন্তু যদি কেহ এরূপ শ্যামার মন্ত্রে মুগ্ধ হয়েন তবে তাঁহাকে বর্ণজ্ঞানশূন্য বলিতে পারিব না। এ কথায় যাঁহার বিরক্তি জন্মায়, তিনি এক বার, নবচূতপল্লববিরাজী ভ্রমরশ্রেণীর ন্যায়, সেই উজ্জ্বলশ্যামললাটবিলম্বী অলকাবলি মনে কৰুন; সেই সপ্তমীচন্দ্রাকৃতললাটতলস্থ অলকস্পর্শী ভ্রূযুগ মনে কৰুন; সেই পক্বচূতোজ্জ্বল কপোলদেশ মনে কৰুন; তন্মধ্যবর্ত্তী ঘোরারক্ত ক্ষুদ্র ওষ্ঠাধর মনে কৰুন তাহা হইলে এই অপরিচিতা রমণীকে সুন্দরীপ্রধানা বলিয়া অনুভূত হইবে। চক্ষু দুইটি অতি বিশাল নহে, কিন্তু সুবঙ্কিমপল্লবরেখাবিশিষ্ট—আর অতিশয় উজ্জ্বল। তাঁহার কটাক্ষ স্থির, অথচ মর্ম্মভেদী। তোমার উপর দৃষ্টি পড়িলে তুমি তৎক্ষণাৎ অনুভূত কর, যে এ স্ত্রীলোক তোমার মনঃ পর্য্যন্ত দেখিতেছে। দেখিতে দেখিতে সে মর্ম্মভেদী দৃষ্টির ভাবান্তর হয়; আবার চক্ষু সুকোমল স্নেহময় রসে গলিয়া যায়। আবার কখন বা তাহাতে কেবল সুখাবেশজনিত ক্লান্তিপ্রকাশ মাত্র, যেন সে নয়ন মন্মথের স্বপ্নশয্যা। কখন বা লালসাবিস্ফারিত, মদনরসে টলমলায়মান। আবার কখন লোলাপাঙ্গে ক্রূর কটাক্ষ—যেন মেঘমধ্যে বিদ্যুদ্দাম। মুখকান্তি মধ্যে দুইটি অনির্ব্বচনীয় শোভা; প্রথম সর্ব্বত্রগামিনী বুদ্ধির প্রভাব, দ্বিতীয় মহান্ আত্মগরিমা। তৎকারণে যখন তিনি মরালগ্রীবা বঙ্কিম করিয়া দাঁড়াইতেন, তখন সহজেই বোধ হইত ইনি রমণীকুলরাজ্ঞী।

 সুন্দরীর বয়ঃক্রম সপ্তবিংশতি বৎসর—ভাদ্র মাসের ভরা নদী। ভাদ্র মাসের নদীজলের ন্যায়, ইহার রূপরাশি টলটল করিতেছিল—উছলিয়া পড়িতেছিল। বর্ণাপেক্ষা, নয়নাপেক্ষা, সর্ব্বাপেক্ষা, সেই সৌন্দর্য্যের পারিপ্লব মুগ্ধকর। পূর্ণযৌবনভরে সর্ব্ব শরীর সতত ঈষচ্চঞ্চল; বিনা বায়ুতে নব শরতের নদী যেমন ঈষচ্চঞ্চল, তেমনি চঞ্চল; সে চাঞ্চল্য মুহুর্ম্মুহু নূতন নূতন শোভাবিকাশের কারণ। নবকুমার নিমেষশূন্য চক্ষে সেই নূতন নূতন শোভা দেখিতেছিলেন।

 সুন্দরী, নবকুমারের চক্ষু নিমেষশূন্য দেখিয়া কহিলেন, “আপনি কি দেখিতেছেন?”

 নবকুমার ভদ্রলোক; অপ্রতিভ হইয়া মুখাবনত করিলেন। নবকুমারকে নিৰুত্তর দেখিয়া অপরিচিতা পুনরপি হাসিয়া কহিলেন,

 “আপনি কখন কি স্ত্রীলোক দেখেন নাই, না আপনি আমাকে বড় সুন্দরী মনে করিতেছেন?”

 সহজে এ কথা কহিলে, তিরস্কার স্বরূপ বোধ হইত, কিন্তু রমণী যে হাসির সহিত বলিলেন, তাহাতে ব্যঙ্গ ব্যতীত আর কিছুই বোধ হইল না। নবকুমার দেখিলেন, এ অতি মুখরা; মুখরার কথায় কেন না উত্তর করিবেন? কহিলেন,

 “আমি স্ত্রীলোক দেখিয়াছি; কিন্তু এরূপ সুন্দরী দেখি নাই।”

 রমণী সগর্ব্বে জিজ্ঞাসা করিলেন, “একটীও না?”

 নবকুমারের হৃদয়ে কপালকুণ্ডলার রূপ জাগিতেছিল; তিনিও সগর্ব্বে উত্তর করিলেন, “একটীও না এমত বলিতে পারি না।”

 প্রস্তরে লৌহের আঘাত পড়িল। উত্তরকারিণী কহিলেন—“তবু ভাল। সেটী কি আপনার গৃহিণী?”

 নব। “কেন? গৃহিণী কেন মনে ভাবিতেছ?”

 স্ত্রী। “বাঙ্গালীরা আপন গৃহিণীকে সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দরী দেখে।”

 নব। “আমি বাঙ্গালি; আপনিও ত বাঙ্গালির ন্যায় কথা কহিতেছেন, আপনি তবে কোন্ দেশীয়?”

 যুবতী আপন পরিচ্ছদের প্রতি দৃষ্টি করিয়া কহিলেন, “অভাগিনী বাঙ্গালী নহে। পশ্চিন প্রদেশীয়া মুসলমানী।” নবকুমার পর্য্যবেক্ষণ করিয়া দেখিলেন, পরিচ্ছদ পশ্চিমপ্রদেশীয়া মুসলমানীর ন্যায় বটে। ক্ষণপরে তৰুণী বলিতে লাগিলেন, “মহাশয়, বাক্‌বৈদগ্ধে আমার পরিচয় লইলেন;—আপন পরিচয় দিয়া চরিতার্থ কৰুন। যে গৃহে সেই অদ্বিতীয়া রূপসী গৃহিণী সে গৃহ কোথায়?”

 নবকুমার কহিলেন, “আমার নিবাস সপ্তগ্রাম।”

 বিদেশিনী কোন উত্তর করিলেন না। সহসা তিনি মুখাবনত করিয়া, প্রদীপ উজ্জ্বল করিতে লাগিলেন।

 ক্ষণেক পরে মুখ না তুলিয়া বলিলেন, “দাসীর নাম মতি। মহাশয়ের নাম কি শুনিতে পাই না?”

 নবকুমার বলিলেন, “নবকুমার শর্ম্মা।”

 প্রদীপ নিবিয়া গেল।