কবিতাবলী (হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭১)/বিধবা রমণী

বিধবা রমণী।



ভারতের পতিহীনা নারী বুঝি অই রে!
না হলে এমন দশা নারী আর কই রে?
মলিন বসন-খানি অঙ্গে আচ্ছাদন,
আহা দেখ অঙ্গে নাই অঙ্গের ভূষণ!
রমণীর চির-সাধ চিকুর বন্ধন,
হ্যাদে দেখ সে সাধেও বিধি-বিড়ম্বন!
আহাঁ, কি চাঁচরকেশ পড়েছে এলায়ে!
আহা, কি রূপের ছটা গিয়েছে মিলায়ে!
কি নিতম্ব কিবা ঊরু, কিবা চক্ষু কিবা ভুরু,
কি যৌবন মরি মরি শোকে দগ্ধ হয় রে!


কুসুম চন্দনে আর নাহি অভিলাষ;
তাম্বুল কর্পূরে আর নাহি সে বিলাস;
বদনে সে হাসি নাই, নয়নে সে জ্যোতিঃ;
সে আনন্দ নাই আর মরি কি দুর্গতি!

হরিষ বিষাদ এবে তুল্য চিরদিন;
বসন্ত শরত ঋতু সকলি মলিন!
দিবানিশি একি বেশ, বারমাস সেই ক্লেশ;
বিধবার প্রাণে হায় এতই কি সয় রে!


হায় রে নিষ্ঠুর জাতি পাষাণ-হৃদয়,
দেখে শুনে এ যন্ত্রণা তবু অন্ধ হয়;
বালিকা যুবতী ভেদ করে না বিচার,
নারী বধ করে তুষ্ট করে দেশাচার।
এই যদি এ দেশের শাস্ত্রের লিখন,
এ দেশে রমণী তবে জন্মে কি কারণ?
পুরুষ দুদিন পরে, আবার বিবাহ করে,
অবল রমণী বলে এতই কি সয় রে?


কেঁদেছি অনেক দিন কাঁদিব না আর;
পূরাইব হৃদয়ের কামনা এবার।—
ঈশ্বর থাকেন যদি করেন বিচার
করিবেন এ দৌরাত্ম্য সমুলে সংহার;
অবিলম্বে হিন্দুধর্ম্ম ছারখার হবে
হিন্দুকুলে বাতি দিতে কেহ নাহি রবে!

দেখ্‌ রে দুর্ম্মতি যত চিরম্লেচ্ছপদানত—
বিধবার শাপে হায় এ দুর্গতি হয় রে।


হায় রে আমার যদি থাকিত সম্পদ,
মিটাতাম চিরদিন মনের যে সাধ;
সোণার প্রতিমা গড়ে বিধবা নারীর
রাখিতাম স্থানে স্থানে ভারতভূমির;
বিদেশের স্ত্রী পুরুষ এদেশে আসিত,
পতিব্রতা বলে কারে নয়নে হেরিত।
লিখিতাম নিম্নদেশে, “কি স্বদেশে কি বিদেশে,
রমণী এমন আর ধরাতলে নাই রে”


সে ধন সম্পদ নাই দরিদ্র কাঙ্গাল,
অনাথ-বিধবা-দুঃখ রবে চিরকাল
আমার অন্তরে গাঁথা; যখনি দেখিব
সুগন্ধ কুসুমে কীট তখনি কাঁদিব;
রাহুগ্রাসে শশধর, নক্ষত্র পতন
যখনি দেখিব, হায়, করিব স্মরণ
বিধবা নারীর মুখ! হায় রে বিদরে বুক,
ইচ্ছা করে জন্মশোধ দেশত্যাগী হই রে।
ভারতের পতিহীনা নারী বুঝি আই রে॥