কলিকাতার ইতিহাস/একাদশ অধ্যায়

একাদশ অধ্যায়।
হিন্দু-সমাজ।

 অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়টি যেরূপ গুরুতর এবং ইহার সকল তত্বের সম্যক্ অনুধাবন অধুনা যেরূপ আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে, অন্য কোন বিষয় সেরূপ নহে। দুঃখের বিষয় এই যে, এ বিষয়ের গুরুত্ব সাধারণতঃ স্বীকৃত হয় না। সর্ব্বপ্রকার কুসংস্কার-বর্জ্জিত হইয়া সামাজিক প্রশ্নসমুহের আলোচনা একান্ত আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। আমাদের সামাজিক গঠন এরূপ অবস্থায় উপনীত হইয়াছে যে, আমরা যত শীঘ্র এই সমস্ত বিষয়ের ও বর্ত্তমান অবস্থার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইব, আমাদের সকলের পক্ষে ততই মঙ্গল। ভাবী ঘটনাবলী পূর্ব্বাহ্নেই আপনাদের ছায়া নিক্ষেপ করিয়া থাকে। ঐ সমস্ত ছায়া হইতে বিচার করিয়া দেখিলে, যে সকল ইতোমধ্যেই প্রকাশ পাইয়াছে, সেগুলি বস্তুতই অত্যন্ত ভীতিজনক। তাহাতে উন্নতির আভাস কিছুই পাওয়া যায় না। একটা ইংরেজী প্রবাদবাক্য আছে,—চকচক করিলেই সোণা হয় না। এই বাক্যটি বর্তমান হিন্দুসমাজ সম্বন্ধে বেশ খাটে। আরামদায়ক বর্তমান অবস্থা আপাত-মনোরম ও সুখকর বোধ হইতে পারে, কিন্তু ইহার ভাবী ফল শুভজনক হইবে না। সমাজের বর্তমান অবস্থার গুরুতর ভাব সকলেরই হৃদয়ঙ্গম করা কর্তব্য। পাশ্চাত্য দেশের তথাকথিত উৎকৃষ্ট সভ্যতার আড়ম্বর ও প্রখর দীপ্তি আমাদের নয়নকে এমন অন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে এবং মনোহর বর্তমান ভাবে আমরা এতদূর বিমুগ্ধ হইয়া পড়িয়াছি যে, আমাদের সামাজিক জীবনের যাবতীয় গুরুতর প্রশ্নই আমরা নিতান্তু তাচ্ছীল্যের সহিত মীমাংসা করিয়া ফেলি। হিন্দুসমাজ যে উত্তরোত্তর ভাঙ্গিয়া যাইতেছে, সে বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। দিন দিন ইহার সংগঠন প্রবল ধাক্কা খাইতেছে। যে বিষম ঝঞ্ঝাবাতে ইহা পর্য্যুদস্ত হইবার সম্ভাবনা হইয়া উঠিয়াছে, তাহা কাটাইয়া উঠিতে পারিবে কি না, সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহ। আমাদের পশ্চাদ্ভাগে নীরবে এক বিষম বিপ্লব চলিতেছে, এবং অতি পুরাকালে যাহা কিছু সংগঠিত ও যুগে যুগে দৃঢ়ীভূত হইয়াছে, এই বিষম বিপ্লবের প্রবল স্রোতে তাহা ভাঙ্গিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে। এই বিপ্লবের প্রকৃতি এবং ইহার অন্তর্নিহিত দার্শনিক তত্ব পরীক্ষা করিয়া দেখা যাক। এক কথায় বলিতে হইলে, ইহাকে অরাজকতা বলা যাইতে পারে, এবং ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল বিনাশ।

 হিন্দুসমাজ আমাদের সম্মুখে যে আদর্শ সংস্থাপন করিয়াছেন, আমরা তাহাতে আর সন্তুষ্ট নহি। যে কোন বৈদেশিক আদর্শ দেখিয়া আমরা তৎক্ষণাৎ বিমুগ্ধ হইয়া পড়ি, তাহারই অনুসরণ করিবার নিমিত্ত আমরা সর্বপ্রকার কৌশল সাগ্রহে আলোচনা করিতে প্রবৃত্ত হই ও নানাপ্রকার উপায় অবলম্বন করি। আমাদের মনের ভাবসকল যেন কেমন গুলাইয়া গিয়াছে। সমাজের বন্ধন দিন দিন শিথিল হইতেছে। পরন্তু সাহসের সহিত এই অনিষ্টকর অবস্থার গতিরোধ করিতে হইবে। যে দিন সামাজিক বন্ধনসমূহ অন্তর্হিত হয় এবং লোকে সমাজের প্রতি অনুরাগবিহীন ও সমাজের হিতার্থে কার্য করিবার প্রবৃত্তিহীন হইয়া পড়ে, সে দিন মানুষের সুখের পক্ষে বড়ই দুর্ভাগ্যের দিন। আমাদের এখন সেই দিন আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে চতুর্দিকে উচ্ছৃঙ্খল ভাবের প্রাবল্য দৃষ্ট হইতেছে। সমাজের একতা ব্যাহত হইয়াছে। স্বাধীনবলম্বনপ্রবৃত্তির নিন্দা করা আমাদের অভিপ্রায় নহে। সময়ে সময়ে উহাদ্বারা মহৎ কার্য সাধিত হইয়া থাকে। কিন্তু সেই সঙ্গে মনুষ্যমাত্রেরই স্বদেশের প্রতি প্রীতি এবং স্বসমাজের আচারব্যবহারের প্রতি অনুরাগ থাকা আবশ্যক। কোন ব্যক্তিই প্রকৃতার্থে বিশ্বাসী হইতে পারে না। প্রত্যেক জাতিরই কতকগুলি বিশেষ ভাব ও প্রকৃতি আছে, তদ্বারা উহাকে অন্যান্য জাতি হইতে পৃথক্ করিয়া চিনিয়া লওয়া যায়। বিশাল মানবজাতির এক মহান্ উদ্দেশ্য সাধন সকল জাতিরই চরম লক্ষ্য বটে এবং তাহারই প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া সকল জাতি কার্য্য করিতেছে বটে, তথাপি কিন্তু প্রত্যেক জাতি আপনার অবস্থা ও জ্ঞানের পরিমাণ ও উৎকর্ষাপকর্ষ অনুসারে এক এক নির্দ্দিষ্ট পথে কাজ করিয়া যাইতেছে। এই জন্যই পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকার আচার-ব্যবহার দৃষ্ট হইয়া থাকে। যে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য পাশ্চাত জগতে একটি মহৎ গুণ, এ দেশে তাহাই অনেক সময়ে ঘোর স্বার্থপতায় পরিণত হইয়াছে। যে ভোগবিলাসময় জীবনযাপন প্রণালী পাশ্চাত্য জগতে বহু উৎকর্ষসাধক গুণের উত্তেজক বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে, আমাদের সমন্ধে তাহাই বিপরীত ফল প্রসব করিয়াছে। বিভিন্ন জাতির বিশেষ বিশেষ ভাব কিরূপে উৎপন্ন ও পরিপুষ্ট হইয়াছে, তাহা ইতিহাস পাঠে অবগত হওয়া যায়। উহারা যুগযুগান্তর ধরিয়া নীরবে উৎপন্ন হইয়া আসিয়াছে। এক এক জাতির ধর্ম্ম, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি ও বৃত্তিব্যবসায় দ্বারা উহারা নির্ধারত হইয়াছে। উহাদের নির্ধারণ পক্ষে দেশের জলবায়ুর অবস্থাও সামান্য কারণ নহে। বক্‌ল সাহেবও ইহা প্রতিপন্ন করিয়াছেন।

 জাতিমাত্রেরই নিজের একটা ধর্ম্ম আছে, সে ধর্ম্মটি তাহার বিশেষ উপযোগী এবং তাহাতেই সেই জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি। আদি নিবাসীদিগের মধ্যে খ্রীষ্টধর্ম্মের প্রচারেও তাহাদের মধ্যে সভ্যতাবিস্তার হয় নাই। তাহাতে ঐ সকল অসভ্যজাতির নৈতিক অবস্থা বা জ্ঞান-বুদ্ধি উন্নত করিতে পারে নাই। এই সমস্ত অসভ্যজাতির মধ্যে কেহ কেহ ইউরোপীয়দিগের আচারব্যবহারের অনুকরণ করিয়াছে, কিন্তু তাহারা তদনুসারে কোনবিশেষ উপকার লাভ করিতে পারিয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। কথিত আছে যে, ভগবানের আদেশ পালন করিবার নিমিত্ত,—কোনও মহান ভাব কর্য্যে পরিণত করিবার জন্য,—জতিসমুহের জন্ম হইয়াছে,—থবা প্রকৃত কথা বলিতে হইলে, তাহারা সেই ভগবান কর্ত্তৃক এই সংসারে প্রেরিত হইয়াছে। সেই সুমহান্ উদ্দেশ্য তাহাদের যাবতীয় জাতীয় মনোভাব ও কার্য্যের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হয় এবং বিশেষ বিশেষ গুরুতর ব্যাপার উপলক্ষে জাতীয় জীবনে প্রকাশ পায়। হিন্দুর পক্ষে ধর্ম্মই ভগবানের সেই মহদুদ্দেশ্য। এই ধর্ম্ম কথাটার ইংরেজী প্রতিশব্দ নাই, কারণ ‘ধর্ম্ম’ বলিলে হিন্দু যাহা বুঝে, ইংরেজী কোন শব্দদ্বারাই তাহা প্রকাশ করা যায় না। হিন্দুর ধর্ম্ম শব্দে যে ভাব বুঝায়, তাহা মানুষের চিন্তায়, বাক্যে ও কার্য্যে প্রকাশ পায়, এবং যতকাল আত্মার মুক্তি না ঘটে, ততকাল জন্মজন্মান্তর ব্যাপিয়া তাহা প্রকৃতির কার্যকরী শক্তিরুপে তাহার ক্রিয়াসমূহকে নিয়মিত করে। হিন্দুজাতির বিশেষ গৌরবের বিষয় এই যে, মানুষের মুক্তিলাভের নিমিত্ত ভগবান যে শক্তি প্রদান করিয়াছেন, তদনুসারে তাহারা আপনাদের নির্দিষ্ট কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়াছে। মানুষ যে আত্মোন্নতিসাধনে ভগবান্‌কে আত্মার ভিতর উপলব্ধি করিতে পারে, ইহা তাহারা আপনাদের জীবনে প্রতিপন্ন করিয়াছে, এবং যে পথে চলিলে ভগবানের নিকট উপস্থিত হওয়া যায়, সে পথ তাহারা উন্মুক্ত করিয়াছে; তাহাদের চরম লক্ষ্য সাধন কল্পে চেষ্টা করিতে করিতে হিন্দুজাতি এমন একটি দার্শনিক তত্ব ও ধর্ম্মের আবিষ্কার করিয়াছে যে, তাহা জগতে অদ্বিতীয়। বাহ্যেন্দ্রিয়সমুহ দ্বারা পর্য্যবেক্ষণ করিয়াই তাহারা সন্তুষ্ট হয় নাই, প্রত্যুত তাহারা আপনাদের মনোবৃত্তিনিচয় যথাসম্ভব বিকশিত করিয়াছে, এবং সাধারণতঃ 'যোগ' নামে খ্যাত বিশেষ প্রণালী দ্বারা সুস্পষ্ট অন্তর্দর্শনশক্তি মা করিয়াছে! এই যোগবলে তাহারা কাল ও স্থানের দূরত্ব বিলুপ্ত করিতে সমর্থ হইয়াছে,—ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান তাহাদের নিকট মধ্যাহ্নকালীন সূর্য্যের ন্যায় প্রতিভাত হইয়াছে।

 উচ্চতর নীতিজ্ঞান সহ এই অদ্ভুত শক্তি বিকাশ করতে সমর্থ হওয়ায় ঋষিরা অবিমিশ্র সুখময় স্থান যে স্বর্গ তাহও ত্যাগ করিয়াছেন এবং মানবজাতির গুরু অর্থাৎ আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা হইয়াছেন। তাঁহারাই আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতিসাধনের উপযোগী করিয়া ভারতবর্ষের সমাজ ও ধর্মের বাহ্যাবয়ব সংগঠিত করিয়াছেন। বিশ্বের সমস্তই যে এক ও অদ্বিতীয়, ইহাই হিন্দুদের বিশ্বাস। তাহারা মানুষ ও খনিজ ধাতুতে প্রকৃত পক্ষে কোনও প্রভেদ দেখিতে পায় না, কারণ বিশ্বের তাবৎ বস্তুই সেই অদ্বিতীয় পুরুষের বিকাশমাত্র। এইরূপ জ্ঞানবশতঃ হিন্দুরা সামান্য কীট পতঙ্গ ও বৃক্ষের প্রতি সমভাবে দয়া ও সহানুভূতি প্রকাশ করিয়া থাকে। সুতরাং হিন্দুদের লক্ষ্য অতি উচ্চ হইলেও তাহারা অতি নীচের প্রতি লক্ষ্য রাখারও অত্যাবশ্যকতা উপলব্ধি করিয়াছে, এবং তদনুসারে যে ধর্ম্মের আবিস্কার করিয়াছে, তাহা 'সনাতন ধর্ম্ম’ অর্থাৎ সর্বকালের উপযোগী ধর্ম্ম নামে অভিহিত হইয়াছে; এই ধর্ম্ম সর্ব্বাবস্থাতেই মানুষের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করিতে সমর্থ: হিন্দুরা ইহাও বিশ্বাস করে যে, মানুষ আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া ভগবান্‌কে প্রাপ্ত ও সম্পূর্ণ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে যে অসংখ্য জীবন অতিক্রম করিতে হইবে, বর্ত্তমান জীবন সেই সুদীর্ঘ জীবনশৃঙ্খলের একটী কড়া মাত্র। এই হেতু তাহারা সাংসারিক তাবৎ বিষয়কে অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করে, এবং চিত্তের প্রশান্ততা রক্ষা করিয়া,— অর্থাৎ সৌভাগ্যগর্ব্বে স্ফীত বা দুর্ভাগ্যদুঃখে ভগ্নোদ্যম না হইয়া-ক্রমাগত আপনাদের আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনে যত্নশীল থাকে। হিন্দুদের পাপপূণ্যের ধারণা কিছু বিশেষ রকমের। মানুষের ধর্ম্মের সহিত সংস্রব না থাকিলে কোন কার্য্যই তাহাদের নিকট পুণ্যজনক বা পাপজনক বলিয়া বিবেচিত হয় না। মানুষের ধর্ম্মই তাহার উন্নতির অবস্থার পরিচায়ক। ইহা সর্ব্বজনবিদিত যে, জাতিবিশেষ ও ব্যক্তিবিশেষ তাহাদের উন্নতির ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হইয়া থাকে; আর যে কাজ একের পক্ষে হিতকর তাহাই অন্যের পক্ষে অহিতকর বিবেচিত হইয়া থাকে। ক্রমোন্নতির এই নীতিসূত্র অবগত থাকায় প্রাচীন ঋষিরা সমগ্র হিন্দুজাতিকে চারি প্রধান ভাগে অর্থাৎ জাতিতে বিভক্ত করিয়াছেন,—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।

 জন্মদ্বারাই মানুষের জাতি নির্দ্ধারিত হয়; আর হিন্দুর দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, মানুষের ‘কর্ম্ম’ (অর্থাৎ পূর্বজন্মের কার্য্যাবলী অনুসারে বিধাতা তাহার জাতি নির্ধারণ করিয়া দেন। হিন্দু জানে, কর্ম্মানুসারে ফলভোগ-নীতি কেবল সংসারিক বিষয়ে নহে, আধ্যাত্মিক বিষয়েও তুল্যরূপ সত্য। সুতরাং এই কর্ম্মনীতিই হিন্দুধর্মের মূল সূত্র। এই নীতির মর্ম্ম এই যে, কর্ম্ম-মাত্রেই (মনের চিন্তা এবং অভিলাষও কর্ম্মের অন্তর্গত) উপযুক্ত ফল প্রসব করে, এবং যত দিন মানুষের কন্মে আসক্তি থাকে, তত দিন সেই ফল তাহাকে ছাড়ে না,—ইহজন্মেই হউক বা পরজন্মেই হউক, সেই কর্ম্মফল তাহাকে ভোগ করিতে হইবে। মানুষ ইহজন্মে সুখ বা দুঃখ যাহা কিছু ভোগ করে, তাহার যথোপযুক্ত কারণ আপাততঃ দেখা না গেলেও বুঝিতে হইবে, তাহা উহার পূর্ব্ব জন্মের কৃতকর্ম্মের ফল। যত দিন কর্ম্মফলে মানুষের আসক্তি থাকে, তত দিন সেই কর্মের ফলভোগ করিবার নিমিত্ত তাহাকে পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ করিতে হইবে; আসক্তিশূন্য হইয়া অর্থাৎ ফলের প্রতি লক্ষ্য না রাখিয়া যখন কর্ম্ম করিতে পারা যাইবে, তখনই কর্ম্ম এবং কর্ম্মকর্ত্তার সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হইবে। আর ইহা করিবার একমাত্র উপায়, নিজের স্বাতন্ত্র-জ্ঞানবর্জিত হওয়া ও আত্মজ্ঞান লাভ করা। এইভাবে কর্ম্ম করিলে তাহার ফল মানুষের নিজের উপর না পড়িয়া সমস্ত বিশ্বের উপর পতিত হয়, সুতরাং অধিকতর কার্য্যকর হয়। এইরূপ মুক্তিলাভই হিন্দুর চরম লক্ষ্য, এবং হিন্দুশাস্ত্রসমূহ এই মুক্তিলাভের পথ প্রদর্শন করিতেছে। এ বিষয়ের যথোচিত উপদেশদানই ব্রাহ্মণদিগের প্রধান কর্তব্য, কারণ তাঁহারা যে ভাবে জীবন যাপন করিতে আদিষ্ট হইয়াছেন, তাহাতে তাঁহারাই এই কার্য্যের সম্পূর্ণ উপযুক্ত। কর্ম্মফলে বিশ্বাসের দৃষ্ট ফল সন্তোষ, কারণ হিন্দুমাত্রেই জানে যে, তাহার অদৃষ্ট সে নিজেই করিয়া লইয়াছে। হিন্দুধর্ম্মের প্রধান কয়েকটি ভাবের কথাই এস্থলে সক্ষেপে উল্লিখিত হইল।

 শ্রীযুক্ত এন্, এন্, কোষ স্বপ্রণীত মহারাজ নবকৃষ্ণের জীবনচরিতে লিখিয়াছেন;—“হিন্দু ধর্ম্ম কেবল কতকগুলি নীতির সংগ্রহমাত্র নহে, প্রত্যুত ইহা অদৃষ্টের ব্যাখ্যা। ইহা মানুষের উৎপত্তি ও চরম লক্ষ্য সম্বন্ধে অনেক বিশেষ কথাই আমাদিগকে বলিয়া দেয়। ইহা আমাদিগকে আধ্যাত্মিক তত্ত্বসমূহ লাভ করিবার ও পরলোকের সহিত সংযোগসাধন করিবার উপায় প্রদর্শন করে।” হিন্দুর চরম লক্ষ্য সুখ নহে,—মুক্তি; সুতরাং হিন্দুর নিকট ইহজীবন সেই পরিমাণে মূল্যবান্, যে পরিমাণে ইহা তাহাকে মুক্তিলাভকাল পর্যন্ত জন্মজন্মান্তর ব্যাপিয়া সেই মহাযাত্রার জন্য প্রস্তুত করিতে সমর্থ হয়। চারি জাতির কর্ত্তব্য ও জীবনযাপনের নিয়মাবলী প্রধানতঃ, মনুসংহিতাসমুদয়ে নিবদ্ধ আছে। যে সকল ঋষি ঐ সকল সংহিতা প্রচার করিয়াছেন, তাঁহাদের নামানুসারে উহাদের নামকরণ ইয়াছে, কিন্তু সাধারণভাবে উহারা 'স্মৃতি' নামে পরিচিত।

 কখন কি ভাবে জাতিভেঙ্গ প্রথম প্রচলিত হইঘাছে, তাহা নির্ণয় করিবার উপায় নাই।[১] হিন্দুধর্ম্ম-কর্ম্মসাধন বিষয়ে বর্ণাশ্রম ধর্ম্ম নামে অভিহিত। শ্রীযুক্ত এন, এন, ঘোৰ লিখিয়াছেন;—“হিন্দুজাতির প্রথম চারি শ্রেণী বিভাগের সময় ব্যবসায়ের বিভিন্নতা অপেক্ষা নৈতিকপ্রকৃতির বিভিন্নতার উপরই অধিক নির্ভর করা হইয়াছিল। জাতিভেদের বাহ্যভাব দেখিলে, ব্যবসায় ভেদই ইহার মুল বলিয় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি ও চরিত্রের ভিন্নতাই ইহার মুল। বিভিন্ন জাতির ভেদসূচক রেখা অতীব দৃঢ়তার সহিত নির্ধারিত হইয়াছে। পিতার জাতিই পুত্রের জাতি। পুরাকালে যখন হিন্দু রাজারা রাজত্ব করিতেন, এবং ঋষিরা বিধিপ্রণয়ন ও প্রয়োগ করিতেন, এস সময়ে যাহাই ঘটিয়া থাকুক না কেন, ইহা নিশ্চিত যে, আজি কেহই এক জাতি হইতে অন্য জাতিতে নীত হইতে পারে না, বা কেহ স্বয়ং ইচ্ছা বা চেষ্টা করিয়া এক জাতি হইতে অন্য জাতিতে যাইতে পারে না। হিন্দুরা মনে করে, মানুষের জাতি তাহার পূর্ব্বজন্মকৃত কর্ম্মের অবশ্যম্ভাবী ফল, এবং তাদের বিশ্বাস এই যে, মানুষ ইহজন্মে যে ভাবে জীবন যাপন করিবে, তদনুসারে পরজন্মে তার জাতি নির্দ্ধারিত হইবে। জাতিভেদই হিন্দু-সমাজনীতির মুল।  মোটামুটি বলিতে হইলে, এমন কোনও রাজ্য এ পর্যন্ত দেখা যায় নাই, যেখানকার অধিবাসীর কিয়ৎপরিমাণে জ্ঞান ও সভ্যতা লাভ করিয়া পরিণামে আপনাদের শ্রেণীবিভাগের বা জাতিভেদের উপকারিতা উপলব্ধি করে নাই। ধর্ম্মই সকল স্থলে এরূপ শ্রেণীভেদের মূল নহে। মূল যাহাই হউক না কেন, শ্রেণীবিভাগ বা জাতিভেদ সর্বত্রই যে হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। লোকের প্রবৃত্তি বা অবলম্বিত বৃত্তিই এই শ্রেণীবিভাগের প্রধান কারণ। রাজাও এই শ্রেণীবিভাগের সামান্য কারণ নহে, যেহেতু স্বীয় প্রজাবর্গের সামাজিক ভাবের পরিবর্ত্তন করিবার রাজার বিশিষ্টরূপ ক্ষমতা আছে। রাজার এই বিশেষ ক্ষমতার পরিচালন দ্বারা ইউরোপীয়সমূহের কিরূপ অবস্থান্তর ঘটিয়াছে, তাহার তত্ত্বানুসন্ধান ও বর্ণনা করিতে হইলে বর্ত্তমান প্রবন্ধের আকার আয়তন বহু পরিমাণে বাড়িয়া যাইবে। সেইজন্য সে চেষ্টায় ক্ষান্ত হইতে হইল। হিন্দু ও অন্যান্য সভ্য জাতি সৎকার্য্যের সমাদর করিয়াছেন, কিন্তু ঐ সকল কার্য্যের পুরস্কার নির্দ্ধারণে তাঁহাদের বিললক্ষণ মতভেদ দৃষ্ট হয়। হিন্দু মতে, মানুষ সৎকার্য্য দ্বারা পূর্ব্বজন্মে (ইহ জন্মে নহে) উচ্চতর ও বিশুদ্ধতর পদলাভের অধিকারী হয়। সেই জন্যই অদ্যাপি দেখা যায় যে, শুদ্র অতি উচ্চ-পদ ও ধন সন্তোগ করিলেও সামাজিক হিসাবে ব্রাহ্মণ অপেক্ষা অধিক সম্মান প্রাপ্ত হয় না।

 রুশিয়ার নিহিলিষ্টদিগের উথ্থান ১৮০০ শতাব্দীর শেষভাগে ফ্রান্সের বলক্ষয়কর সামাজিক বিপ্লব ও অরাজকতা প্রভৃতি ইউরোপের বিষম সমাজবিপ্লবের ন্যায় কোনরূপ বিপ্লবসূচক গোলযোগ যে আমাদের দেশে ঘটে নাই ইহাই সুখের বিষয়। পাশ্চাত্য সমাজনীতির ও ইউরোপের সামাজিক জীবনের বিবিধ জটিল অবস্থায় ইতোমধ্যেই প্রকাশ পাইতে আরম্ভ করিয়াছে।

 শিল্পবিজ্ঞানের সহায়তায় ও ধনদ্বারা লভ্য সর্ব্বপ্রকার সুখ ও ভোগবিলাস সংগ্রহ করাই পাশ্চাত্যদিগের চরম লক্ষ্য। প্রাচীন হিন্দুদিগের লক্ষ্যের সহিত কি বৈষম্য! হিন্দু সাংসারিক সুখদুঃখে সম্পূর্ণ উদাসীন। কিরূপে আত্মজ্ঞান লাভ করা যায়, কিরূপে পূর্ণতা প্রাপ্ত হওয়া যায়, কিরূপে পরব্রহ্মের সহিত যোগ সাধন করা যায়—এই সমস্তই তাহার চরম লক্ষ্য। এই প্রাচীন আদর্শ হইতে অধঃপতনের কথা ভাবিতে চিত্ত বিষাদময় হইয়া উঠে। বড়ই দুঃখের বিষয় এই যে, যেরূপ লক্ষণ প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে, তাহাতে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, সমাজের মূলভিত্তি ক্রমশঃ শিথিল হইতেছে। বর্ক সত্যই বলিয়াছেন;—“সে আঘাতে প্রাচীন আচার ব্যবহার ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, তাহা অপেক্ষা ভয়ের কারণ আর কিছুই হইতে পারে না। প্রাচীন মত ও সংসারনীতি অপনীত হইলে যে ক্ষতি হয়, তাহার পরিমাণ নির্দ্ধারণ অসম্ভব হইয়া পড়ে। সেই মুহূর্ত্ত হইতে আমাদিগকে শাসনে রাখিবার যন্ত্র আমরা হারাইয়া বসি।’’

 প্রকৃত হিন্দুর জীবনে কি উচ্চ আদর্শ, কি মহান আত্মত্যাগ, কি উদার ও স্বর্গীয় চরিত্র অঙ্কিত হইয়াছে! শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অগ্নিময়ী ভাষায় বলিয়াছেন—“রাম ও যুধিষ্ঠির অপেক্ষা মহত্তর চরিত্র আমরা কোথায় পাইব? রামায়ণ ও মহাভারতে যে নীতি-উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে, তদপেক্ষা উচ্চতর উপদেশ আমরা কোথায় পাইব? সত্যপালনের পূণ্য, মাতাপিতার আদেশ পালনের কর্ত্তব্যতা, অবশ্যকর্ত্তব্য কর্মসমূহের সম্পাদনের আবশ্যকতা পাতিব্রত্যের শ্রেষ্ঠ পূণ্যজনকত্ব, সত্যের পবিত্রতা, মিথ্যা-কথনের উৎকট পাপ, এই সমস্ত বিষয় এরূপ চিত্তদ্রাবকভাবে ওজস্বিনী ভাষায় উপদিষ্ট হইয়াছে যে, যাহারা নিতান্ত অমনোযোগের সহিত রামায়ণ পাঠ করে, তাহাদের মনেও উহাদের ভাব গভীররূপে অঙ্কিত হইবেই হইবে। পুরাণে উক্ত হইয়াছে,—“সংসারে মিথ্যাবাদীর স্থান হয় না।” রামায়ণকার ইহার অনুমোদন করিয়া স্বীয় গ্রন্থে উদ্ধৃত করিয়াছেন। রাম অগস্ত্যমুনির আশ্রমে যাইয়া যৎকালে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন, সেই সময়ে মহর্ষি তাঁহাকে বলেন,—“মিথ্যাবাদী পরলোকে আপনার মাংস আপনি খাইয়া থাকে।”

 এইরূপ একটি গল্প প্রচলিত আছে যে, বুদ্ধদেব যৎকালে স্বীয় আশ্রমে ধ্যানমগ্ন, সেই সময়ে একটী বিধবা তাঁহার নিকট যাইয়া আপনার মৃত পুত্রের পুনজীবন প্রার্থনা করে। বুদ্ধ বৃদ্ধাকে উত্তর করেন, যে বাটীতে মৃত্যু প্রবেশ করে নাই, সেই বাটী হইতে তুমি যদি কঞ্চিৎ তিল আনিয়া দিতে পার, তাহা হইলে তোমার পুত্রের পুনজীবন লাভের উপায় হইতে পারে। বৃদ্ধা সানন্দে চলিয়া গেল, কিন্তু সেরূপ বাটী কোথাও খুঁজিয়া পাইল না। তখন সে হতাশ হইয়া বুদ্ধের নিকট প্রত্যাগত হইল এবং নিবেদন করিল যে, যে বাটীতে কেহ কখনও মরে নাই, এরুপ বাটী সংসারে নাই। যেরূপ মৃত্যু-বর্জ্জিত বাটী নাই, সেইরূপ দোষ-বর্জ্জিত সমাজও নাই। সূক্ষ্মরূপে পরীক্ষা করিলে সকল সমাজেই দোষ বাহির করিতে পারা যায়। পরন্তু ছিদান্বেষণ অপেক্ষা গুণগ্রাহিতা অধিকতর হিতকর।

 যে সমাজ নানাপ্রকার বিপ্লব ও কালের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করিয়া দণ্ডায়মান আছে এবং যে সমাজে সংসারের সকল বিভাগেই বহু সুপ্রসিদ্ধ লোকের উদ্ভব হইয়াছে, সে সমাজ নিতান্ত হেয় হইতে পারে না। হিন্দুসমাজ বহু অগ্নিপরীক্ষা অতিক্রম করিয়াছে। পুনঃপুনঃ বৈদেশিক আক্রমণে সমাজের স্বাভাবিক উন্নতি বহুপরিমাণে ব্যাহত হইয়াছিল। পরন্তু ঐ সকল আক্রমণ সত্বেও হিন্দু সমাজ আপনার জীবন অক্ষুন্ন রাখিতে সমর্থ হইয়াছে। ধর্ম্মের বিশেষত্বই ইহার জীবনধারণশক্তির মূল। ধর্ম্মই এ দেশের সমাজ গঠনের মূলভিত্তি,—ধর্ম্মই হিন্দুজাতিকে প্রাচ্য জাতিসমূহের মধ্যেও অতুলনীয় ও স্বতন্ত্র করিয়াছে। সুতরাং আমাদের সমাজতত্ত্বের আলোচনা করিতে হইলে ধর্ম্মতত্ত্বের আলোচনা স্বতই আসিয়া পড়ে। ভারতের ইতিহাসের একটি আশ্চর্য্য ঘটনা এই যে, মুসলমানেরা হিন্দুস্থানের দ্বারদেশে আসিয়া উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই বৌদ্ধধর্ম্মের সহিত হিন্দুধর্ম্মের বিবাদের নিষ্পত্তি হইয়া গিয়াছিল ও হিন্দুধর্ম্ম আপনার প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হইয়াছিল। মুসলমানদিগের অভ্যুদয় ও উন্নতি-জগতের ইতিহাসে একটী মহা সঙ্কটকাল বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে, কারণ প্রাচীন ও আধুনিক জগতের মধ্যবর্ত্তী অন্ধকারময় যুগের প্রারম্ভ মুসলমানদিগের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই ঘটিয়াছিল। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এই বিষম সঙ্কটকালে ভগবৎপ্রেরিত কয়েকজন মনীষী হিন্দুসমাজে আবির্ভূত হইয়া হিন্দুদের আচারব্যবহার ও কার্য্যপ্রণালী নির্দিষ্ট করিয়া দেন। প্রেস্কট্‌ যথার্থই বলিয়াছেন যে, ‘‘মুসলমানের বন্যার ন্যায় আপতিত হইয়া প্রাচীন সভ্যতা ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল ও তাহার চিহ্ন পর্য্যন্ত বিলুপ্ত করিয়াছিল।” ঐ সময়ে প্রাচীন ভূমণ্ডলের অর্দ্ধাংশ মুসলমানধর্ম্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হয়। একমাত্র ভারতবর্ষই অটলভাবে দণ্ডায়মান থাকিয়া আপনার বিশেষত্ব রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিল। জাতিভেদপ্রণালীর গুণে গ্রাম্যসমিতিসমূহ সমাজে এক একটী ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্ররাজ্যরূপে পরিণত হইয়াছিল। মুসলমানধর্ম্মের শক্তি এই সুদৃঢ় গঠনপ্রণালী ভেদ করিতে পারে নাই। এই প্রথার গুণে যে সহিষ্ণুতাশক্তি বিকশিত হয়, তাহাই হিন্দুচরিত্রের মূল; উহারই বলে হিন্দুরা অগ্নি ও তরবারির গতিরোধে সমর্থ হইছিল। হিন্দুকে ‘মৃদুপ্রকৃতি’ বলা হয় বটে, কিন্তু উহা নিন্দাসূচক নহে! কারণ হিন্দু, পরদ্রোহী নহে,—হিন্দু স্বধর্ম্মে অটল ও ক্লেশসহিষ্ণু।

 ভূয়োদর্শন দ্বারা প্রতিপন্ন হইয়াছে যে, অনুকরণ সকল স্থলে সমাজের উন্নতি ও সুখসাধনের কারণ হয় না,—উহা সকল সময়ে আমাদের উপকারজনক হইতে পারে না। লোক যথার্থই বলিয়াছেন,—“বীজ উপযুক্ত মৃত্তিকা পাইলেই অঙ্কুরিত হয়; মনোমুগ্ধকর নীতি ও সিদ্ধান্ত পাইলেই লোক অনেক সময় তাহা অবলম্বন করিয়া বসে, কিন্তু তাহার বিরুদ্ধে বলিবার যে অনেক কথা আছে, তাহা ভুলিয়া যায় এবং যে সমস্ত সুযুক্তি দ্বারা তাহারা রক্ষিত ছিল তাহা অগ্রাহ্য করে।” অতএব কোনও নতুন বিষয়ই সম্যক‌্ বিবেচনা না করিয়া প্রবর্ত্তিত করিবার চেষ্টা করা উচিত নয়, পরন্তু সমাজের বিশেষ বিশেষ ভাবগুলি প্রগাঢ় মনোযোগের সহিত বিচার করিয়া দেখা কর্ত্তব্য। এ সম্বন্ধে ম্যাক্সমুলার যাহা বলিয়াছেন, তাহা বড়ই সঙ্গত বলিয়া বোধ হয়। তিনি বলিয়াছেন,—“যাহারা আপনাদের অতীত ইতিহাসে ও সাহিত্যে গৌরব বোধ না করে, তাহারা আপনাদের জাতীয় চরিত্রের প্রধান অবলম্বন হারাইয়া বসে।”

 অন্যান্য সকল সমাজের ন্যায় আমাদের সমাজেরও কতিপয় বিষয়ে সংস্কার আবশ্যক। অপরন্তু আশা করি, এই সংস্কার-সাধনে, এ স্থলে যে সকল মূলনীতি সংক্ষেপে আলোচিত হইল, তাহাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা হইবে না, অথবা এ বিষয়ে কোনরূপ হঠকারিতা প্রদর্শিত হইবে না, কিংবা অবস্থার কথা সম্যক্ বিবেচনা না করিয়া কোন বিষয়ের ধ্বংসসাধন করা হইবে না।

_______________




সমাপ্ত।
  1. ঋগ্বেদে জাতিভেদপ্রণালীর উল্লেখ আছে। পাশ্চাত পণ্ডিতগণ স্থির করিয়াছেন, খ্রীষ্টের জন্মের ৩০০০ বৎসর পূর্ব্বে ঋগ্বেদ রচিত হইয়াছিল। কিন্তু হিন্দুরা বলেন, ইহা অনাদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে।