কলিকাতার ইতিহাস/ষষ্ঠ অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়।

ধর্ম্ম, বদান্যতা ও বিদ্যাশিক্ষা।

 সেকালে কলিকাতাবাসীদিগের স্বভাবচরিত্র যেরূপ ছিল, তৎসম্বন্ধে জনৈক উদারহৃদয় লেখক এইরূপ সাক্ষ্য দিয়াছেন—“কলিকাতার অধিবাসীরা বদান্যতার জন্য প্রসিদ্ধ; জগতের কোনও জাতি এ বিষয়ে ইহাদের সমকক্ষ নহে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে; ইহাদিগকে সমষ্টিভাবে ধরিয়া ধীরভাবে বিচার করিলে এই অবিচলিত সত্য স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইবে। আমি যে কেবল অধ্যয়ন ও দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ হইতে একথা বলিতেছি তাহা নহে, প্রত্যুত আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতে বলিতেছি। স্বভাবতঃ এইরূপ বদান্যতার প্রবৃত্তিসম্পন্ন জাতি যে পরোপকারপরায়ণ মহাপ্রাণ ইংরাজগণকর্তৃক পরিচালিত হইতে পারছিল, ইহা তাহাদের সৌভাগ্যের বিষয় বলিতে হইবে। সে সময়ে পরোপকারপরায়ণ সদাশয় ইংরেজের সংখ্যাও যথেষ্ট ছিল। বহু সদগুণকর্তৃক প্রণোদিত হইয়া ইংরেজগণ যে বিবিধ লোকহিতকর কার্য্যে যোগদান করিয়া জনসাধারণের সুখস্বচ্ছতার বৃদ্ধি ও তাহাদের নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষবিধান করিয়াছেন, ইতিহাসে এ তাহার বহু জাজ্বল্যমান প্রমাণ বিদ্যমান। প্রোক্ত লেখক চার্লস ওয়েষ্টন নামক একজন সাহেবের মহাপ্রাণতার যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, আমরা এস্থলে তাহা অতি সঙ্ক্ষেপে উল্লেখ করিব। চার্লস ১৭৩১ সালে কলিকাতা নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা মেয়র্স কোর্টের একজন রেকর্ডার ছিলেন। হলওয়েল সাহেব তাহার সুহৃৎ ও সহচর হলেন। নবাব সিরাজুদ্দৌলা যৎকালে ১৭৫৬ অব্দে কলিকাতা আক্রমণ করেন, তৎকালে তিনি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত সৈনিকরূপে অস্ত্রধারণ করিয়াছিলেন। শ্রমশীলতা দ্বারা তিনি প্রচুর ধনের আধিকারী হইয়াছিলেন। তাঁহার সম্বন্ধে একথা অনায়াসেই বলা যাইতে পারে যে, সৌভাগ্যলক্ষ্মী তাঁহা অপেক্ষা যোগ্যতর বরপুত্রের প্রতি কখনও প্রসন্ন হন না: তাঁহার সকল সাধু কার্য্যের উল্লেখ করা দুঃসাধ্য। দীন দুঃখীর ক্লেশ অপনোদনে নিমিত্ত তিনি যথোচিত ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। “যাহারা এক সময়ে সুখের মুখ দেখিয়াছে, যাহাদের প্রতি ভাগ্যলক্ষ্মী বিরূপ হইয়াছে, চার্লস ওয়েষ্টন তাহাদের দুঃখমোচন করেন।” তাঁহার বন্ধুবান্ধব ও অনুচর সহচরগণকে তাহাদের অভাবের সময়ে তিনি অকাতরে সাহায্য করিতেন! এই সকল কারণে অনেকে কৌতুক করিয়া যে তাঁহাকে মানবের সাধারণ বন্ধু’ নাম রাখিয়ালিন, তাহা অসঙ্গত হয় নাই। কর্ণেল স্টুয়ার্ট পূণ্যানুষ্ঠান ও বিনয়প্রদর্শন দ্বারা সকলেরই হৃদয়ের অনুরাগ আকর্ষন করিয়াছিলেন। তিনি কৃষ্ণ ও খৃষ্টকে তুল্যরূপ ভক্তির চক্ষে দেখিতেন। এজন্য তিনি 'হিন্দুষ্টুয়ার্ট’ নাম প্রাপ্ত ইয়াছিলেন।

 অন্যান্য জাতীয় সাধু পুরুষেরাও নানাবিধ সংকার্যের অনুষ্ঠান করিয়া গিয়াছেন। সে সমস্ত সবিস্তারে উল্লেখ করা অনাবশ্যক বটে, অসম্ভবও বটে। এই দুই চারিটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে! কীর্ণ্যাণ্ডার নামক একজন পর্তুগীজ ১৭৫৮ অব্দে এদেশে আগমন করেন। তিনিই কলিকাতার প্রথম প্রোটেষ্টাণ্ট মিশনারী। তিনি যষ্টি সহস্রাধিক সিক্কা টাকা ব্যয় করিয়া ১৭৬৭ সালের ২ শে মে একটি প্রোটেষ্টাণ্ট গির্জা স্থাপন করেন। প্রায় ইহারই সমাকালে তাহার মিশনস্কুলও স্থাপিত হই। পর বৎসর তিনি ১৭৫টি বালকবালিকা প্রাপ্ত হন, তাহাদের মধ্যে ৩৭ টির ব্যয় ভার তিনি নিজে বহন করিতেন। কিছুকাল তাহার বিদ্যালয় ও গির্জার জন্য তাহাকে ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানি এক বাড়ী দিয়াছিলেন, কিন্তু পরে উভয়ই স্থানান্তরিত হয়, এবং তিনি নিজে উভয়ের নিমিত্ত বর্তমান মিশন ষ্ট্রীটে বাটী নির্মাণ করেন। কর্ণেল ক্লাইভ ও তাহার পত্নী এবং ওয়াট সাহেব ও তাঁহার সহধর্ম্মিনী কীর্ণাণ্ডারের সবিশেষ বন্ধুরূপে পরিগণিত ছিলেন। দিল্লীর মোগল সম্রাট তাঁহার প্রতি খৃষ্টীয় ধর্ম্মপুস্তকগুলি আরবীয় ভাষায় অনুবাদ করিবার ভার অর্পণ করেন। তিনিও তাহা সমাধা করিয়া অনুবাদগুলি এলাহাবাদে সম্রাটের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি দুইবার দারপরিগ্রহ করেন। তাহার দ্বিতীয় স্ত্রী আপনার সমস্ত সম্পত্তি স্বামীর বিদ্যলয় ও গির্জার নামে দান করিয়া যান। সেই সদাশয় রমণীর সম্পত্তির বিক্রয়লব্ধ অর্থে কীর্ণ্যাণ্ডার সাহেব আপনার মিশনস্কুল বাড়ীতে একটা প্রকাণ্ড ঘর সংযোজিত করেন; তাহাতে ২৫০ টী বালক বালিকা ধরিতে পারিত। সার আয়ার কুট এবং তাঁহার পত্নী এই মিশনের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ প্রকাশ করিতেন, এবং বিবি কুট এইখানেই তাঁহার সেক্রামেণ্ট দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৭৮৬ সালে কীর্ণ্যাণ্ডার নিজে ১০০০ তাঁহার পুত্র ৩০০০ এবং সার আয়ার কুট ৫০০ টাকা এই মিশনে দান করেন। কীর্ণাণ্ডারের জীন কাল মধ্যে তিনি ইহার আনুকূল্যার্থে ১২,০০০ পাউণ্ড দান করিয়াছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি ভাগ্যবিপর্যয়ে দারুণ দুর্দ্দশায় পতিত হইয়াছিলেন। তাঁহার স্কুল গির্জাও আইনের হস্ত হইতে অব্যাহতি পায় নাই। এই সময়ে গ্রাণ্ট সাহেব অগ্রসর হইয়া ১০,০০০ টাকা প্রদান করিয়া গির্জাটী রক্ষা করেন। ১৭৮৭ সালে এই গির্জা ও স্কুল সাধারণের সম্পত্তি হইয়া পড়ে এবং উহাদের কর্তৃত্ব তিন জন ট্রষ্টির হস্তে অর্পিত হয়। কীর্ণ্যাণ্ডার ১৭৯৯ সালে কালগ্রাসে পতিত হন। সুইডেনের অন্তঃপাতী আকৃষ্টাণ্ড নামক স্থানে ১৭১১ খৃষ্টাব্দের ২১শে নবেম্বর তারিখে তিনি জন্মগ্রহণ করিয়া ছিলেন। তিনি তাঁঁহার সজাতীয় পর্ত্তুগীজদিগের উপকারসাধনের চেষ্টায় যে সদাশয় প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন, তজ্জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন। তাহার গির্জাকে সাধারণ লোকে ‘লালগির্জা' বলিত। তাঁহার স্কুলে পর্ত্তুগীজ ও ইংরেজী—এই উভয় ভাষাই শিক্ষা দেওয়া হইত। আর্ম্মানী ও বাঙ্গালী, বালকেরাও তাঁহার বিদ্যালয়ে পড়িতে পাইত। তাঁহার বড় আশা ছিল যে, তাঁহার হিন্দু ছাত্রেরা খৃষ্টধর্মাবলম্বী হইবে, কিন্তু সে আশায় তাহাকে যারপর নাই বিড়ম্বিত হইতে হইয়াছিল।

 কলিকাতায় সকলেই অবাধে আপন আপন ধর্ম্মবিশ্বাস অনুসারে চলিতে পারে। কোন্ সময়ে প্রথম খৃষ্টান গির্জ্জা নির্মিত হইয়াছিল, তাহা নির্ণয় করিতে পারা যায় না। আগ্রা নগরে ১৬০০ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের অনুমতিক্রমে নির্মিত একটী গির্জা ছিল। কাপ্তেন হ্যামিল্টন ১৬৮৮ হইতে ১৭২৩ সাল পর্য্যন্ত এদেশে ছিলেন। তিনি ১৭২৭ সালে তাঁহার যে ভ্রমণ বৃত্তান্ত প্রকাশিত করেন, তাহার এক স্থলে লিখিয়াছেন—“ফোর্ট উইলিয়ম হইতে প্রায় ৫০ গজ দূরে একটী গির্জা দণ্ডায়মান; কলিকাতাবাসী বণিকদিগের বদান্যতায় এবং যে সকল সমুদ্রগামী লোক কার্যবশতঃ তথায় বাণিজ্য করিতে যায়, তাহাদের দানশীলতায় উহা নির্ম্মিত; পরন্তু খৃষ্টীয় ধর্মশাস্ত্রের প্রচারকেরা অমর নহেন, এজন্য অনেক সময়ে যুবক বণিকদিগকে পৌরোহিত্য করতে হয়; তাঁহারা কোম্পানির প্রদত্ত বেতনের অতিরিক্ত রবিবারে প্রার্থনা ও ধর্ম্মোপদেশ পাঠ করার জন্য বার্ষিক ৫০ পাউণ্ড বেতন পাইয়া থাকেন” ১৭০৯ সালে লণ্ডনের বিশপ উহার নাম সেণ্ট আন্ চর্চ্চ রাখেন। “পাঁচটি উচ্চ পার্শ্ব-শিখর ও একটী চুড়া সুশোভিত এই মন্দিরটি রাইটার্স বিল্ডিং নামক অট্টালিকার যেস্থলে এক্ষণে অষ্টভুজাকার অংশটি বর্তমান, সেইস্থলে দণ্ডায়মান ছিল। ১৭৫৬ অব্দে নবাব সিরাজুদ্দৌলার ফৌজ উহার ধ্বংস সাধন করে। ১৭৩৭ সালের প্রবল ঝড়ে উহার চুড়া ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গিয়াছিল ......... ১৭৫৬ সালের গোলযোগের পর কলিকাতায় শান্তি বিরাজ করিতে আরম্ভ করিলেই একটী নূতনগির্জ্জা নির্মাণ করিবার নিমিত্ত সকলেই সমৎসুক হইয়া উঠিল। কিছুদিন পর্ত্তুগীজদিগের Our Lady of the Roary নামক গির্জ্জাটী রাজ গির্জারূপে ব্যবহৃত হইয়াছিল, কিন্তু উহা আর্দ্রভাবাপন্ন ও অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হওয়ায় পুনর্বার পর্ত্তুগীজদিগকে প্রত্যর্পিত হয়। ১৭৬০ সালের জুলাই মাসে পুরাতন কেল্লার ভগ্ন প্রাচীরের মধ্যেই একটী অস্থায়ী ভজনালয় নির্মিত হয়, এবং সেণ্ট জনস্ চ্যাপেল নামে আখ্যাত হয়।

 ১৭৭৪ অব্দে অনেককে অনুযোগ করিতে শুনা গিয়াছিল যে, কলিকাতায় মনোহর ক্রীড়াগার আছে বটে, কিন্তু গির্জ্জা নাই। কিন্তু তথাপি কলিকাতাবাসীরা ১৭৮২ অব্দের পূর্বে তারতসম্রাজের রাজধানীর উপযুক্ত সাধারণের উপাসনা-মন্দির নির্মাণ বিষয়ে আন্তরিকতার সহিত মনোনিবেশ করেন নাই। উক্ত বৎসর একটি চর্চ্চ-কমিটি (গির্জা-সমিতি) গঠিত হইল; ওয়ারেন হেষ্টিংস এবং তাঁহার মন্ত্রিসভার সদস্যগণ উহার পৃষ্ঠপোেষক হইলেন। লণ্ডন নগরের ওয়ালব্রুক নামের স্থানের সেই ষ্টিফেন গির্জ্জার আদর্শে একটী গির্জ্জা নির্মাণের প্রস্তাব হইল। যেমন আদর্শ স্থির হইল, অমনই তাহার একটী নক্সা কর্ণেল পোলিয়ায় এবং আর একটী নক্সা কর্ণেল ফোর্টন্যাম অঙ্কিত করিলেন। ১৭৮৩ সালের ১লা ডিসেম্বর তারিখে, বিলিং কমিটির প্রথম অধিবেশন হয়, ৩৫,০৫০ টাকা চাঁদা দ্বারা এবং ২৫,৫৯২ টাকা লটারি দ্বারা সংগৃহীত হইয়াছিল। মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুর ৬ বিঘা জমি দান করেন। তৎকালে উহার মুল্য ৩০,০০০ টাকা। চাম্পানী তাঁহাদের রাজস্ব হইতে শতকরা ৩ টাকা প্রদান করেন এ বিষয়ে লোকে এতদূর আগ্রহান্বিত হইয়া উঠিয়াছিল যে, উহার ভিত্তিপ্রস্তুরস্থাপনের দিন গভর্ণর জেনারেল সাধারণ ইংরেজদিগকে প্রাতঃকালে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইয়াছিলেন। প্রধান প্রধান গভর্ণমেণ্ট কর্ম্মচারীরা মহাড়ম্বরে ঐ স্থানে গমন করিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে চার্লস গ্রাণ্ট গৌড় হইতে কতকগুলি বৃহদায়তন মর্ম্মর প্রস্তর ও অন্যান্য আসল পাথর আনয়ন করেন। ডেভিস সাহেব গির্জ্জাটী ভূষিত করিবার ভার গ্রহণ করেন। হল নামক একজন ব্যারিষ্টার, বিনা পারিশ্রমিকে চুক্তিনামা লেখাপড়া করিয়া দেন। সুপ্রশিদ্ধ প্রাচ্য-ভষাবিৎ উইলকিন্স বারাণসীতে প্রস্তুত প্রস্তরসমুহের গঠনের তত্ত্বাবধান করেন। আর্ল কর্ণওয়ালিস ৩,০০০ সিক্কা টাকা প্রদান করেন। সুপ্রসিদ্ধ চিত্রকর জোফানি বিনামূল্যে বেদী চিত্রিত করিয়া দেন। এই নূতন গির্জ্জা নির্মাণ করিতে তিন বৎসর লাগিয়াছিল। অবশেষে আর্ল অব্ কর্ণওয়ালিস্ ১৭৮৭ অব্দের ২৪ শে জুন তারিখে ইহা উন্মুক্ত করেন। ইহার প্রাঙ্গণে অনেক বিখ্যাত লোকের সমাধিমন্দির আছে; তন্মধ্যে হ্যামিল্টন, চার্ণক ও তাঁহার হিন্দু বিধবা পত্নী, এবং ওয়াটসনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

 ১৮৩৯ অব্দে ময়দানের দক্ষিণ কোণে সেণ্ট পল ক্যাথিড্রাল নামক গির্জ্জার নির্মাণ আরব্ধ হয়। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্স সম্প্রদায়ের মেজার ফোর্বস্ ইহার নক্সা প্রস্তুত করেন। ১৮৪৭ সালের ৮ই অক্টোবর তারিখে গির্জ্জাটী উৎসৃষ্ট হয়। ইহার নির্মাণার্থে প্রায় ৭৫,০০০ পাউণ্ড অর্থ সংগৃহীত হইয়াছিল; তন্মধ্যে বিসপ স্বয়ং ২০,০০০ পাউণ্ড দিয়াছিলেন, তাহার অর্ধাংশ নির্মাণকার্য ও অপরার্দ্ধ স্থায়ী ধনভাণ্ডার ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ভূমি এবং নগদ ১৫,০০০পাউণ্ড দান করিয়াছিলেন। চাঁদায় ভারতবর্ষে ১২০০০ পাউণ্ড এবং ইংলণ্ডে ২৮,০০০ পাউণ্ড উঠিয়াছিল। মন্দিরের নির্ম্মাণকার্যে ৫০ ০০০ পাউণ্ড ব্যয় হইছিল ইংলণ্ডে যে চাঁদা সংগৃহীত হইয়াছিল তাহার মধ্যে Society for the propagat n of the Gos le(সুমাচারপ্রচার সমাজ) ৫,০০০ পাউণ্ড দিয়াছিলেন, Society for the promotion of Christian knowledge ৫,০০০ পাউণ্ড দিয়াছিলেন, এবং লণ্ডনের টমাস খাট সাহেব ৪,০০০ পাউণ্ড দিয়াছিলেন। পরলোকগত ধর্মপ্রাণ বিশপ উইলসনের সাধু চেষ্টায় ভগবানের এই মন্দির নির্ম্মিত হয়। কলিকাতার লর্ড বিশপ এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত; তিনি এখানকার উপাসনাদি কার্য্যের নির্বাহ করেন, ভারতের রাজপ্রতিনিধি ও অন্যান্য প্রধান প্রধান রাজপুরুষেরা এখানে উপস্থিত হইয়া তাহাতে যোগ দিয়া থাকেন। আজিকালি রোমান ক্যাথলিক, প্রোটেষ্ট্যাণ্ট, প্রেসবিটিরিয়ান ও মেথডিষ্ট এই সকল ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের বহুসংখ্যক গির্জ্জা কলিকাতার গৌরব বৃদ্ধি করিতেছে। প্রাচীনকালে ১৬৮৯ সালেও আর্ম্মানীদিগের ভজনালয় ছিল। ১৭২০ সালে ফানুস নামক একজন আর্ম্মান গির্জ্জার জন্য একখণ্ড ভূমি ক্রয় করেন। তৎপরে ১৭২৪ অকে আগানাজার সেই ভূমি গ্রহণ করেন, এবং সাধারণের চাঁদায় সেণ্ট নাজারেথ নামে আর একটী আর্ম্মানি গির্জ্জা নির্মিত হয়। এইরূপ একটি গল্প প্রচলিত আছে যে, প্রসিদ্ধ কুঠিযাল উমিচাঁদের শ্যালক ও একজিকিউটার হুজুরি মল সেণ্ট জারেখ গির্জ্জার একটী চূড়া নির্মাণের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করিয়াছিলন। এতদ্ভিন্তু এই সহরে চীনামান, ইহুদী, পাসী, গ্রীক ও অন্যান্য জাতিরও উপাসনা-মন্দির আছে।

 কলিকাতা সহরে, টালিগঞ্জে এবং চিৎপুরে তিন স্থানেই মুসলমানদিগের বহু মসজিদ আছে; ইহাদের সংখ্যা ৪৮৬ হইবে, তম্মধ্যে ৩৭৬ টি সুন্নি সম্প্রদায়ের এবং ১১০টি শিয়া সম্প্রদাদের। এই সমস্ত মজিদের মধ্যে পশ্চাল্লিখিত কয়েকটি সবিশেষ প্রসিদ্ধ:—

 ১। সিন্দুরিয়াপটি মসজিদ ১৮ নং লোয়ার চিৎপুর রোড; ইহার স্থাপয়িতা হাফিজ সমরুদ্দিন সাহেব। ইহার বর্তমান অধিকারী হাফিজ আবদুল আজিজ, ইহার সহিত একটি বাসভবন সংলগ্ন আছে; তথায় দরিদ্র মুসলমান ছাত্রেরা দিন ব্যয়ে বাসস্থান ও আহার্য পাইয়া থাকে।

 ২। হাজি জাকারিয়া মহম্মদের মসজিদ লোয়ার চিৎপুর রোডে; ইহার প্রতিষ্ঠাতা হাজি জাকারিয়া মহম্মদ। ইহার বর্তমান অধিকারীর নাম হাজি নুর মহম্মদ জাকারিয়া। এই মসজিদে বহু সংখ্যক ছাত্র বিনা ব্যয়ে বাসস্থান ও আহার্য্য প্রাপ্ত হইয়া থাকে।

 ৩। ধর্ম্মতলা মসজিদ; ইহাকে সাধারণতঃ টিপুসুলতানের মসজিদ বলে; ডিরেক্টর সভা ১৮৪০ সালে প্রিন্স্ গোলাম মহম্মদকে তাঁহার পূর্ব প্রাপ্য সমস্ত বৃত্তির টাকা প্রদানের আদেশ করায় ভগবানের অপার করুণার নিমিত্ত তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞতাসূচক এই মসজিদ ১৮৪২ সালে নির্মাণ করিয়া ইহার ব্যয়নির্বাহের সুন্দর ব্যবস্থা করিয়া দেন।

 ৪। মেচোবাজারের মসজিদ মেচোবাজার বটে অবস্থিত। কটকবাসী ফতু কাঞ্জরিয়া কর্তৃক স্থাপিত; ইহার বর্ত্তমান অধিকারীর নাম মহম্মদ গিয়াসুদ্দিন। এখানেও কয়েকজন ছাত্র বিনাব্যয়ে আহার্য্য ও বাসস্থান পাইয়া থাকে।

 ৫। হারিসন রোডের পার্শ্বস্থ মসজিদ, দীন চামড়াওয়ালা নামক একজন সামান্য জুতাব্যবসায়ী কর্তৃক নির্মিত। এখানেও বিনাব্যয়ে আহার্য্যাদি পাবার ব্যবস্থা আছে।

 মুসলমানেরা এই সমস্ত এবং অন্যান্য মসজিদে নমাজ পড়িয়া থাকেন; নমাজ পড়িবার জন্য প্রত্যেক মসজিদে এক একজন ইমাম অর্থাৎ পুরোহিত আছেন। সকল মসজিদেরই জমি নিঙ্কর জমি এবং সর্ব্বপ্রকার মিউনিসিপাল কর প্রদানের দায় হইতে মুক্ত।

 ব্রাহ্মদিগের তিনটী প্রকাশ্য ভজনালয় আছে একটি পরলোকগত কেশবচন্দ্র সেনের যত্নে নির্ম্মিত, উহা মেচোবাজার ষ্ট্রীটে অবস্থিত এবং নববিধান মন্দির নামে পরিচিত; দ্বিতীয়টা কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে অবস্থিত এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ নামে সুপরিচিত। এবং তৃতীয়টি আদি ব্রাহ্মসমাজ নামে খ্যাত; উহা একমাত্র স্বর্গীয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পত্তি, কিন্তু ইচ্ছা করিলে সকলেই তথায় যাইয়া উপাসনাদি করিতে পারেন। সুপ্রসিদ্ধ রাজা রামমোহন রায়ই প্রথম ব্রহ্মসমাজ স্থাপন করেন।

 হিন্দুদের মতে কালীঘাট বা কালীক্ষেত্র ভারতবর্ষের মধ্যে একটি অতি পবিত্র তীর্থ ও পূজার স্থান। সত্যযুগে আদর্শসতী সতী পিতা দক্ষরাজের যজ্ঞে পতিনিন্দা শ্রবণ করিয়া কলেবর পরিত্যাগ করিলে, যৎকালে বিষ্ণু সুদর্শনচক্র দ্বারা সেই অঙ্গ ছেদন করিতে প্রবৃত্ত হন, সেই সময় সতীদেহের চারিটি অঙ্গুলী এই স্থানে পতিত হইয়াছিল। তদবধি এই স্থানে শাক্ত হউক. শৈব হউক, গণপত্য হউক, সর্বসম্প্রদায়ের হিন্দুর নিকট ইহা মহাতীর্থ। অতি প্রাচীন কাল হইতে লোক মনস্কামনাসিদ্ধির নিমিত্ত এই স্থানে মানসিক করিয়া থাকে, এবং প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, অনেক স্থলে কামনা সফলও হইয়াছে। যোগী, সন্ন্যাসী ও সাধু মহাপুরুষেরা এই স্থানে সমবেত হইয়া থাকেন এবং মহাদেবীর পূজা করিয়া আপনাদের গন্তব্য পথে চলিয়া যান। ভারতবর্ষের উত্তরাংশের হিন্দু করদ রাজারা কলিকাতায় আসিলে, মা কালীর পূজা না দিয়া তাঁঁহারা স্বরাজ্যে প্রত্যাবৃত্ত হন। দেশের সর্বত্রই এই মন্দিরের পবিত্রতার খ্যাতি পরিব্যাপ্ত। হিন্দুরা ইহাকে এতদূর ভক্তি করে যে, এই বিষয়ে ইহা কাশীর বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের তুল্য বলা যাইতে পারে। কথিত আছে যে, সেকালে ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানিও কালীঘাটে দেবীর পূজা দিতেন। প্রথম প্রথম তাঁহারা ধুমধামের সহিত পুণ্যাহ উৎসব যথানিয়মে সম্পন্ন করিতেন, এবং সেই উপলক্ষে দেবী, পূজানুষ্ঠানে যোগদান করিতেন।[১]

 এই তীর্থের উৎপত্তি ও ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে এস্থলে সবিশেষ আলো' চনা করা অনাবশ্যক। মার্কণ্ডেয় পুরাণ, তন্ত্রসার, এবং অন্যান্য পুরাণ ও তন্ত্রে এবিষয়ের সবিস্তার বর্ণনা আছে। কথিত আছে যে, মহাদেবীর মন্দির ঠিক নদীর ধারে অর্থাৎ ঘাটের উপর ছিল। এই জন্য সহজেই স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে যে, ইহা হইতেই বর্তমান কালীঘাট নামের উৎপত্তি বৃহন্নীলতন্ত্রে উক্ত হইয়াছে যে, অতি প্রাচীনকালে অতি অল্পসংখ্যক কয়েকজন ভক্ত মাত্র এই কালীদেবীর কথা জ্ঞাত ছিলেন। যৎকালে সুপ্রসিদ্ধ হিন্দু নরপতি বল্লালসেন প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন, সেই সময় হইতে যৎকালে মোগল সম্রাট আকবর রাজত্ব করিতেন এবং অমর কবিকঙ্কণ তাঁহার ভক্তিরসাত্মক চণ্ডীকাব্য প্রণয়ন করেন, সেই সময় পর্যন্ত নানাস্থানে নানাভাবে এই তীর্থ প্রসঙ্গের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, কলিকাতার অদূরস্থ বড়িশানিবাসী সন্তোষ রায় ১৮০৯ সালে বর্তমান মন্দির নির্মাণ করাইয়া দেন।

 পাদরি ওয়ার্ড সাহেব লিখিয়াছেন—“কলিকাতার নিকট কালী- ঘাটে এই দেবীর একটি বিখ্যাত মন্দির আছে; হিন্দুরা বলে, সমস্ত এশিয়া, এমন কি সমস্ত পৃথিবী এই দেবীর পূজা করিয়া থাকে। এই দেবীর নিকট প্রতিদিন যে সকল পূজার সামগ্রী অর্পিত হয়, তাহার পরিমাণ এত অধিক যে, শুনিলে আশ্চর্য্যান্বিত হইতে হয়; অতি দুর্যেগের দিনেও অন্যূন ৩২০ পাউণ্ড (৪ মণ) চাউল, ২৪ পাউণ্ড চিনি, ৪০ পাউণ্ড সন্দেশ, ১২ পাউও দ্বি, ১০ পাউণ্ড ময়দা, ১০ কোয়ার্ট দুধ, এক পেক ডাল, ৮০০ কলা, ও ন্যূনাধিক পাঁচ শিলিঙ মুল্যের অন্যান্য দ্রব্য প্রদত্ত হইয়া থাকে; তদ্ভিন্ন আট দশটি ছাগ-বলি হয় সাধারণ দিনে এই পরিমাণের তিনগুণ, এবং প্রধান প্রধান উৎসব দিবসে, অথবা; কোনও ধনাঢ্য ব্যক্তি পুজা দিতে আসিলে, ইহার দশ গুণ, বিশ গুণ, চল্লিশ গুণ দ্রব্যও অর্পিত হইয়া থাকে, এবং ৪০ হইতে ৫০টি মহিষ ও ন্যূনাধিক এক সহস্র ছাগ বলি দেওয়া হয়।

 কথিত আছে যে, প্রায় ৫০ বৎসর হইল, কলিকাতার রাজা নবকৃষ্ণ কালীঘাট দর্শনে যাইয়া দেবীর পূজায় অন্ন এক লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছিলেন। তাঁহার পূজার অন্যান্য সামগ্রীর মধ্যে ১০০০০ টাকা মুল্যের একছড়া সোনার কণ্ঠমালা, বহুমূল্য শষ্যা, রূপার থালা, রেকাব, বাটি এবং একহাজার লোককে ভোজন করাইবার উপযুক্ত সন্দেশ ও অন্যান্য খাদ্য ছিল; তদ্ভিন্ন প্রায় দুই হাজার কাঙ্গালীকে কিছু কিছু নগদ অর্থও দেওয়া হইয়াছিল।

 “প্রায় ২০ বৎসর হইল, কলিকাতার নিকটস্থ খিদীরপুরবাসী জয়নারায়ণ ঘোষাল এই স্থানে পঞ্চবিংশ সহস্র মুদ্রা ব্যয় করিয়া- ছিলেন; তিনি ২৫টি মহিষ, ১০টি ছাগ ও ৫টি মেষ বলি দিয়া- ছিলেন, এবং দেবীকে চারিটি রূপার হাত, দুইটি সোণার চক্ষু, এবং সোণা রূপার বিস্তর অলঙ্কার অর্পণ করিয়াছিলেন।

 “প্রায় ১১০ বৎসর হইল, পূর্ববঙ্গের একজন মহাজন (বণিক) এই দেবীর কেবল পুজায় পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় করিয়াছিলেন; তদ্ভিন্ন তিনি এক সহস্র ছাগ ক্রয় করিয়া বলি দিয়াছেন।

 “১৮১০ খ্রষ্টাব্দে পূর্ববঙ্গের একজন ব্রাহ্মণ এই প্রতিমার পূজায় প্রায় ৪০০ টাকা ব্যয় করেন। ঐ টাকার কিয়দংশ দিয়া তিনি একছড়া সোণার কণ্ঠমালা কিনিয়া দিয়াছিলেন; তাহার মালাগুলির আকার অসুরের মুখের মত।

 “১৮১১ সালে গোপীমোহন নামক কলিকাতাবাসী একজন ব্রাহ্মণ এই দেবীর পূজায় দশ হাজার টাকা ব্যয় করেন; কিন্তু তিনি নিজে বৈষ্ণব ছিলেন বলিয়া কোনও পশু বলি দেন নাই। কেবল হিন্দুরাই যে এই কাল পাথরের পুজা করে, তাহা নহে; আমি অনেকবার শুনিয়াছি যে ইউরোপীয়েরা, অথবা তাহাদের এতদ্দেশীয় উপপত্নীরা, এই মন্দির দর্শনে গমন করে এবং পুজায় সহস্র সহ মুদ্রা ব্যয় করে। আমি যে ব্রাহ্মণের নিকট বসিয়া এই বিষয় লিখিতেছিলাম, তিনি বলিয়াছেন যে, তিনি যখন কালীঘাটের নিকট বড়িশায় থাকিয়া পড়িতেন, সেই সময়ে তিনি অনেকবার দেখিয়া- ছিলেন যে, ইউরোপীয়দিগের ভাষারা পাল্কি করিয়া আসিয়া পূজা। দিয়া গিয়াছেন; কিন্তু আমার বোধ হয়, এই সকল রমণী ভারত- বর্ষেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণ বলিলে, মন্দিরাধিকারীর তাঁহাকে দৃঢ়তার সহিত নিশ্চয় করিয়া বলিয়াছেন যে সাহেবেরা সর্বদাই দেবীর পূজা দিয়া তাহার নিকট বর প্রার্থনা করেন, এ সংপ্রতি কোম্পানির একজন সাহেব কর্মচারী একটা মোকদ্দমায় জয়লাভ করিয়া দুই তিন হাজার টাকা ব্যয় করিয়া কালীর পূজা দিয়া গিয়াছেন।....তদ্ভিন্ন ইহাও দৃঢ়তার সহিত কথিত হইয়া থাকে যে, প্রতিমাসে প্রায় চার পাঁচ শত মুসলমান কালীর পুজা দিয়া থাকে।”

 পাদরি ওয়ার্ড সাহেব পুনরপি বলিয়াছেন—“এই মন্দিরের জন্যই কালীঘাটে লোকসংখ্যা এত অধিক; কারণ প্রায় ৩০ ঘর সেবাইত ভিন্ন ন্যুনাধিক ২০০ ব্যক্তি এই মন্দির উপলক্ষ করিয়া জীবিকা অর্জন করিয়া থাকে। কোন কোন সেবাইতের পালা একদিন, কাহারও অর্ধদিন, কাহারও দুই তিন ঘণ্টা মাত্র: যাহার পালার সময়ে যে কিছু পূজার সামগ্রী অর্পিত হয়, তৎসমস্তই তিনি প্রাপ্ত হন। উক্ত সাহেব বলেন, এই দেবীর পৃষ্ঠার ব্যয় সর্ব- প্রকারে মাসিক ৮০ ০ সিক্কা টাকা, অর্থাৎ বৎসরে ৭২,০০০ টাকা) কিছুদিন হইতে কালীঘাট ও তৎসন্নিহিত স্থানগুলি কলি- কাতা সহরের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে, এবং সকল শ্রেণীর লোকেই এখানে বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে; এই কারণে ইহা এক্ষণে কলিকাতা একটি জনবহুল উপনগরে পরিণত হইয়াছে। পাদরি ওয়ার্ড সাহেবের লেখার পর সেবাইতগণের সংখ্যা বহুপরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছে এ তীর্থে শ্রীশ্রীনকুলেশ্বর শ্যামায় নামে আরও দুইটা দেবতা আছেন; হিন্দুর ইহাদিগকেও যথেষ্ট ভক্তির সহিত পূজা করিয়া থাকে। গোবিন্দপুরে যে স্থানে বর্তমান ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ দণ্ডসুমান, ঐ স্থানে শ্রী শ্রীগোবিন্দজীর মন্দির ছিল। গোবিন্দজীকে এক্ষণে কালীঘাটে লইয়া যাওয়া হইয়াছে! লোকের দৃঢ়বিশ্বস এই যে, কালীঘাটে নকুলেশ্বর ভৈরব থাকায় এই তীর্থক্ষেত্রের মাহাত্ম্য আরও অধিকতর বর্ধিত হইয়াছে।

 হিন্দুদিগের ধর্মপ্রবৃত্তির দৃষ্টান্তস্বরূপ ওয়ার্ড সাহেব উল্লেখ করিয়াছেন যে, কৃষ্ণনগরের রাজা রামকৃষ্ণ বরানগরে কালীদেবী: প্রতিমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করিয়াছিনে। শ্রী শ্রী ব্রাহ্মণগণের ও দীন দরিদ্রদিগের ভরণপোষণার্থ উক্ত রাজার দান যথার্থই নদীয়ার রাজবংশের উচ্চ মর্যাদার অনুরূপ। গোবিন্দ- রাম মিত্রের নবরত্ন মন্দিরের কথা ইতঃপূৰ্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। তদ্ভিন্ন বাগবাজারে অপার চিৎপুর তোডের পার্শ্বস্থ, সিদ্ধেশ্বীদেবীও তাহার প্রতিষ্ঠিত। সকল শ্রেণীর হিন্দুই এই দেবীকে পুজা দিয়া থাকে। বাগবাজারের বাবু গোকুলচাঁদ মিত্র মদনমোহন দেবের মুর্তি প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তঁহার জন্য অন্য একটি সুন্দর বাড়ী নির্মাণ করাইয়া বিগ্রহের সেবার জন্য যথোচিত সম্পত্তি দান করেন। ঐ মন্দিরটী মদনমোহনের বাড়ী নামে পরিচিত। এইরূপ একটা কিংবদন্তী আজো আছে যে, এই বিগ্রহটি প্রথমে বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত বিষ্ণুপুরের বাজার ছিল; তিনি বিস্তর টাকা লইয়া ধর্মপ্রাণ গোকুল বাবুর নিকট উহা বন্ধক রাখেন। পরে রাজা টাকা দিয়া বিগ্রহ ফিরাইয়া চাহিলে গোকুল বাবু অত্যন্ত দুঃখিত হন এবং তাহা প্রত্য- র্পণ করিতে অনিচ্ছাপ্রকাশ করেন। ইতোমধ্যে রাজার প্রতি স্বপ্নদেশ হইল যে, তিনি যেন উহার জন্য গোকুলের উপর পীড়া- পীড়ি না করেন; সুতরাং রাজা ঐ বিষয়ে ক্ষান্ত হইলেন; মূর্তি গোকুল বাবুরই হইল।

 মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুর স্বীয় ভবনে মহাপ্রভু শ্রীশ্রীগোপীনাথ জীর যে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, তৎসম্বন্ধে ওয়ার্ড সাহেব এইরূপ লিখিয়াছেন:—

 দুইজন সন্ন্যাসী (যাহারা উত্তরকালে শ্রীকৃষ্ণের ভক্তগণের মধ্যে সবিশেষ প্রসিদ্ধলাভ করেন,—চৈতন্য ও নিত্যানন্দ তাঁহা- দের শিষ্য ঘোষ ঠাকুরকে এই বলিয়া অগ্রদ্বীপ পাঠাইয়া ছিলেন যে, তুমি এই পাথরটা লইয়া যাইয়া গোপীনাথ জীর বিগ্রহরূপে প্রতিষ্ঠা করিয়া পুজা করিতে থাক। ঘোষঠাকুর গুরুর আদেশানুসারে পাথর- খানা মাথায় করিয়অগ্রদ্বীপে উপস্থিত হইলেন এবং দেববিগ্রহ রূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়া প্রতিদিন প্রকাশ্য পূজা করিতে লাগিলেন।”

 এই দেবমূর্ত্তি কিরূপে ধর্ম্মপ্রাণ মহারাজের হস্তগত হল, তৎ- সম্বন্ধে ওয়ার্ড সাহেব লিখিয়াছেন:—

 “এই বিগ্রহের (গ্রদ্বীপের গোপীনাথের) অধিকারী কৃষ্ণনগ- রের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নিকট কলিকাতার রাজা নবকৃষ্ণ তিন লক্ষ টাকা পাইতেন; সেই টাকা কৃষ্ণচন্দ্র শোধ করিতে না পারায় নবকৃষ্ণ এক সময়ে এই বিগ্রহ ক্রোক করেন।”

 মহারাজ নবকৃষ্ণ দুই প্রকাণ্ড ঠাকুরবাড়ী নির্মাণ করান এবং দেববিগ্রহগুলিকে নানাপ্রকার রত্নালঙ্কার ও সোণার বাসনকোসন প্রভৃতি দান করেন। সেই সমস্ত সম্পত্তির বর্তমান মূল্য চারি লক্ষ টাকার নূন হইবে না। বর্তমান সময়েও এ দুইটি ঠাকুরবাড়ীর ন্যায় সুন্দর দেবালয় কলিকাতায় আর নাই।

 জৈন সম্প্রদায়েরও স্বতন্ত্র দেবালয় আছে। মানিকতলা ও হালসিবাগান বোভের বহির্ভাগে প্রসিদ্ধ জৈনমন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরসংলগ্ন ভূমি, সুন্দর সুন্দর পাদপচরণপণ, পুষ্পবৃক্ষ, নানাপ্রকার খোদিত মুর্তি, কৃত্রিম প্রস্রবণ, এবং ভোজন ও আমোদ প্রমোদের নিমিত্ত নির্দিষ্ট রম্য ভবনসমুহে সুশশাভিত। মন্দিরটি দেখিতে অতি সুন্দর; উহার নির্মাণপ্রণালী অতি বিচিত্র অধিকাংশ মাড়ওয়ারি জৈনসম্প্রদায়ভুক্ত তাহাও প্রতি বৎসর যেরূপ মিছিল সাজাইয়া বড়বাজার হইতে মন্দিরে এবং পুনরায় মন্দির হইতে বড়বালারে যাইয়া থাকে, সেরূপ নয়নমনোহর আড়ম্বরবিশিষ্ট মিছিল কলিকাতার রাস্তায় আর একটিও দেখিতে পাওয়া যায় না। পরেশনাথ, মহাবীর ও আদিনাথ—ইহারাই জৈনধর্ম্মের প্রবর্তক ও সংস্কারক। জৈনগণ ইহাদের পূজা করিয়া থাকেন; তদ্ভিন্ন তাহারা তীর্থঙ্কর বা জৈনগণেরও উপাসনা করেন। বৌদিগের তা জৈনগণও প্রাণিহিংসা মহাপাপ বলিয়া জ্ঞান করেন; তাহারা কলিকাতায় ও তাহার চতুষ্পার্শে: কয়েকটি পিজরাপোল অর্থাৎ রুগ্ন পশুর আশ্রম প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। বাণিজ্যই এই সদাশয় সম্প্রদায়ের প্রধান অবলম্বন; বড়বাজারের মধ্যে ইহারাই সব্বাপেক্ষা ধনাঢ্য বণিক বলিয়া প্রসিদ্ধ। ইহারা প্রধানতঃ কাপড় ও জহরতের কারবার করিয়া থাকেন।

 রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপদেশ-প্রভাবে আর একটি ধৃতৰ ধর্ম্ম- সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হইয়াছে। রামকৃষ্ণের শিষ্যেরা তঁহাকে অব- তার বলিয়া বিশ্বাস করেন। তাহার শিষ্যগণের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দই বিলক্ষণ প্রসিদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিলেন। তাহার যত্নে ভাগীরথীর অপর পারে বেলুড় নামক স্থানে একটি মঠ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। প্রতি বৎসর এই স্থানে রাম-কৃষ্ণোৎ সব নামে একটি মহোৎসব হইয়া থাকে; সেই সময়ে বহুসংখ্যক হিন্দু এই স্থানে সমবেত হন। এই নব সম্প্রদায়ের অনেকেই লোকহিতকর কার্যে আত্মোৎসর্গ করিয়াছেন।

 কলিকাতা বদান্যতার জন্য প্রসিদ্ধ। পুরবাসিগণের এক এক জনেরদানশৌণ্ডতার বিষয় পৃথকৃভাবে আলোচনা করা সহজ নয়। সেকালের ন্যায় একালেও দানধ্যানের কার্য্য সুস্পষ্ট দৃশ্যমান। নৌ সেনাধ্যক্ষ ওয়াটসন সাহেবের চিকিৎসক ও বন্ধু, সদাশয় এভোয়ার্ড আইভিস তাঁহার সময়ে (৭৫৬-৫৭) কলিকাতায় বদান্যতার যেরূপ প্রাদুর্ভাব দেখিয়াছিলেন তৎসম্বন্ধে এইরূপ লিখিয়াছেন:—

 “আমাদের ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বসতিস্থানে যেরূপ উদারতার সহিত দানপ্রবৃত্তির চরিতার্থতা সাধন করা হইয়া থাকে, ভুমণ্ডলের আর কোনও অংশে যে সেরূপ হয়, ইহা নির্দেশ করা সম্ভবপর নয়। বহু দুই পরিবারের প্রকৃত ক্লেশ বিমোচনের নিমিত্ত চাদা দ্বারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রভূত অর্থ সংগৃহীত হইয়া ঐ কার্য্যে নিয়োজিত হইয়াছে। এরূপ বিস্তর দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করা যাইতে পারে।”

 কলিকাতায় যে বিবিধ লোকহিতকর দাতব্য অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে, আমরা এস্থলে তাহাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে। চেষ্টা করিব এ পরিচয় ধে নিতান্ত অসম্পূর্ণ হইবে, তাহা বলাই বাহুল্য। সকলেই জানেন যে, কলিকাতায় বহু ধর্ম্মমন্দিরেই দরিদ্র-পোষণের রীতিমত ব্যবস্থা আছে। হিন্দু ও মুসলমান সমাজে প্রত্যেক ধর্ম্মানুষ্ঠান উৎসবাদির পর কাঙ্গালীদিগকে ভোজন করান ও তাহাদিগকে অর্থসাহায্য করা অবশ্য কর্তব্য বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। সচরাচর কলিকাতাবাসীদিগের এইরূপ একটা নিন্দা শুনিতে পাওয়া যায় যে, কালসহকারে পুৰ্বভাবের পরিবর্তন হইয়াছে এবং কলিকাতাবাসীর। এক্ষণে অসহায় দীন দরিদ্র ও অনাথ অতুরদিগের দুঃখদুর্দশায় সম্পূর্ণ উদাসীন, তাহাদের দয়া- দাক্ষিণ্যের ভাব তিরোহিত হইয়াছ এইরূপ নিন্দা সত্ত্বেও আমরা দেখিতে পাই যে, দরিদ্রদিগের প্রতি কলিকাতাবাসীদিগের সহানুভূতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতেছে, ইহা বড়ই সুখের বিষয় বলতে হইবে কয়েকটী প্রধান দাতব্য অনুষ্ঠানের দৃষ্টান্ত এস্থলে প্রকাশিত হইতেছে;—

 ১। ডিষ্ট্ৰীক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটি (District: Charitable Society)—বিশপ টার্নার অপর কতকগুলি ইউরোপী ও দেশীয় ভদ্রলোকের সহধাগিতায় ১৮৩০ সালে লালবাজারে এই সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেন। ইহার সহিত সংসৃষ্ট একটী আমস্ হাউস (অন্নসত্র) ও কুষ্ঠাশ্রম আমহাষ্ট স্ট্রীটে আছে। ইহার অর্থভাণ্ডারে গবর্নমেণ্ট প্রচুর অর্থ সাহায্য করিয়াছিলেন, এবং জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ ঠাকুর এক লক্ষ টাকা দান করিয়াছিলেন।

  ২। (প্রসিডেন্সি হাসপাতাল। হ্যামিল্টন সাহেবের মতে ইহা ১৭.৯ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্সি জেলের দক্ষিণে ইহা অবস্থিত। এই স্থানে কেবল ইউরোপীয়েরাই চিকিৎসিত হইয়া থাকে।

 ৩। মেয়ো হাসপাতাল। ইহার আদি নাম নেটিভ হাঁস- পাতাল। প্রধানতঃ পারি জন আওয়েন সাহেবের যত্নে ১৭৯২ সালের ১৩ই সপ্টেম্বরে ইহা প্রতিষ্ঠিত হয়। কলিকাতার দেশীয় অধিবাসীরা, বিশেষতঃ নিম্নশ্রেণীর শ্রমজীবীরা এই খানে চিকিৎসিত হইয়া থাকে। ইহার অর্থভাণ্ডারে রাজা বৈদ্যনাথ ৩০,০০০ টাকা দান করিয়াছিলেন। ইহা প্রথমে চিৎপুর রোডের উপর ছিল; তৎপরে ধর্মতলা রোডে স্থানান্তরিত হইয়াছিল। এক্ষণে ইহা সহরের উত্তরাংশে স্ট্রাণ্ড রোডের উপর অবস্থিত। গবর্ণমেণ্ট সাহায্য প্রথমে মাসিক ৬০, টাকা ছিন, এবং সাধারণের নিকট ৫৪,০০০ টাকা চাঁদা সংগৃহীত হইয়াছিল। লৰ্ড কর্ণওয়ালিস ৩,০০৬ টাকা দিয়াছিলেন, কাউন্সিলের প্রত্যেক সদস্য ৪,৫০০ টাকা দিয়াছিলেন, এবং নবাৰ উজির ৩,০০০ টাকা দিয়াছিলেন। গবর্ণমেণ্টের সাহায্য পরে বন্ধিত হইয়া মাসিক ২০০০ টাকা নির্ধারিত হয়। ৮৭১ সালে ইহাকে বর্তমান স্থানে উঠাইয়া আনা স্থিরীকৃত হয়। তদনুসারে মেয়ো স্মৃতিভাণ্ডারের যে ৫০,০০০ টাকা উদ্ব ও হইয়া ছিল, তাহা এই হাসপাতালে প্রদত্ত হয়। তদবধি ইহা ‘মোয়ো নেটিভ হাসপাতাল' নামে অভিহিত হয়। বাড়ী নির্মাণার্থ ডি সুজা ১০,০০০ টাকা দান করেন, এবং ধর্ম্মতলার সম্পত্তির কিয়- দংশ ৭৯,০০০ টাকায় বিক্রীত হয়। বাড়ীটা ত্রিতল; ইহাতে আউট ডোর রোগীদিগের জন্য (অর্থাৎ যে সকল রোগী হাঁস- পাতালে থাকে না, কেবলমাত্র আসিয়া. ঔষধ লইয়া যায়, তাহাদের জন্য কয়েকটা প্রকোষ্ঠ এবং রেসিডেণ্ট মেডিক্যাল অফিসারের বাসভবন আছে। ধর্ম্মতলার পুরাতন হাসপাতালে একটী আউট- ডোর ডিস্পেনসারি রাখা হইয়াছিল। এই হাসপাতালের সহিত সংসৃষ্ট আর তিনটা ডিস্পেনসারি আছে, একটী পার্ক স্ট্রীটে, দ্বিতীয়টা চিৎপুর রোড, এবং তৃতীয়টা সুকিয়া স্ট্রীটে।

 ৪। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ইহা কলেজ স্ট্রীটে অব- স্থিত। মার্কুইস অব ডালহাউসির শাসনকালে ১৮৪৮ সালে ইহা নির্ম্মিত হয়। পুরাতন ও নূতন ফিভার হাসপাতালের টাকায়, লটারি কমিটির অর্থভাণ্ডারের উদ্বৃত্ত অর্থে, এবং পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের এককালীন দানের ৫০০০০ টাকায় এই হাঁস- পাতাল নির্ম্মিত হইয়াছিল। বাবু শ্যামাচরণ লাহার প্রদত্ত অর্থে হাসপাতালের উত্তর-পূৰ্বাংশে একটি নূতন চক্ষু চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত- হইয়াছে, এবং মহানুভব দাতার নামানুসারে তাহার নামকরণ হইয়াছে। ইহুদীদিগের চিকিৎসা নিমিত্ত মিসেস এজরা নামী একটী ইহুদী মহিলার সম্পূর্ণ ব্যয়ে মূল হাসপাতাল বাড়ীর সংলগ্ন ভাবে একটা স্বতন্ত্র বিভাগ নির্মিত হইয়াছে। কলিকাতার একটি বহু কালের অভাব দূর করিবার নিমিত্ত বাঙ্গালায় ভূতপূর্ব্ব ছোটলাট সার আশলি ইভেন স্ত্রীলোক ও শিশুদিগের চিকিৎসার্থে ১৮৮২ সালের জুলাই মাসে ইডেন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। এই হাসপাতাল সম্বন্ধে জনৈক লেখক এইরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়া- ছেন। এই হাসপাতাল সম্বন্ধে জনৈক লেখক এইরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেনঃ-“ইডেন হাসপাতাল অপেক্ষা, বোধ করি অধিকতর সর্বাঙ্গসুন্দর হাসপাতাল জগতে আর নাই।” ইহার আনুষঙ্গিক অট্টালিকাগুলির মধ্যে দুইজন হাসপাতালধাত্রীর জন্য দুইটি বৃহৎ বানভবন আছে কলুটোলায় বিখ্যাত শীল বংশের বদান্যতায় ইহার উপকারিতা সমধিক পরিমাণে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে; চুনীলাল শীলের আউট ডোর ডিস্পেন্সারি উক্ত মহানুভব দাতার বহু লোকহিতকর কার্য্যের একটি সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।[২]

 ৫। ক্যাম্বেল হাসপাতাল। প্রথমে ইহঁর নাম ছিল ‘পপার হাসপাতাল। গবর্ণমেণ্ট এবং কলিকাতা মিউনিসিপালিটি ইহার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেন।

 ৬। অলবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল। প্রধানতঃ ডাক্তার আর, জি, কর এবং সহরের পর কয়েক জন ডাক্তারের চেষ্টায় ১৫-১৬ বৎসর পূর্বে যে মেডিক্যাল স্কুল স্থাপিত হয়, সেই স্কুল হইতে এই হাসপাতালের উদ্ভব। আলবার্ট-ভিক্টরের স্থ যি-স্মৃতিচিহ্ন ভণ্ডারের উদ্বত্ত অর্থ এই হাসপাতালের অর্থভাণ্ডারের সহিত মিলিত হইয়াছে।

 ৭। পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা-নিবারণী-সভা! (The calcutta society for the prevention of Cruelty to Animals):—দীর্ঘকাল হইতে কলিকাতায় এইরূপ একটা অনু, ষ্ঠানের অভাব অনুভূত হইয়া আসিতেছিল। লর্ড এলগিন ১৮৬২ সালে লণ্ডনের রয়াল সোসাইটির আদর্শে এই সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেন। পরে ১৮৬৯ অব্দে বাবু প্যারীচঁদ মিত্রের যত্নে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা নিবারণদ্দেশে একটি আইন বিধিবদ্ধ হয়। এই সভার ব্যয় কতকটা সাধারণের চাঁদায় এবং কতকটা গবর্ণমেণ্টের অর্থ সাহায্যদ্বারা নির্ব্বাহিত হইয়া থাকে।

 ৮। কলিকাতা মুক-বধির বিদ্যালয়। প্রধানতঃ সিটিকলেজের অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র দত্ত, শ্রীযুক্ত যামিনীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত শ্রীনাথ সিংহ ও শ্রীযুক্ত মোহিনীমোহন মজুমদারের যত্নে এই পরম হিতকর বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ইহার অবস্থা এক্ষণে বেশ সচ্ছল; সাকুলার রোডের উপর ইহার একটী সুন্দর অট্টালিকা হইয়াছে, এবং সরকারী বে-সরকারী সকল শ্রেণীর ভদ্রলোকেই এই শুভানুষ্ঠানে আন্তরিক সহানুভূতি ও যত্ন প্রকাশ করিয়া থাকেন।

 ৯। রমণীদ্বারা ভারতীয় রমণীগণের চিকিৎসাবিধানার্থে জাতীয় সমাজ (National Association for supplying Female medical Aid to the Women of India):13600 ভূতপূৰ্ব প্রধান শাসনকর্তা লর্ড ডফরিনের মহিষী এই মহানুষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাত্রী। ভারতের সর্বত্রই ইহার বহুশাখা আছে। ইহার কার্যপরিচালনভার একটি সেণ্ট্রাল কমিটির হস্তে অর্পিত।

 ১০। জাতীয় সভা—বঙ্গশাখা (The National Associa- tion-Bengal Branch) —ইউরোপীয় ও দেশীয়দিগের মধ্যে সামাজিক সংযোগ ও সদ্ভাবের বৃদ্ধি এবং সম্রান্ত বংশসমুহের মধ্যে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারই এই সভার উদ্দেশ্য। কুমারী মেরি কার্পেণ্টার উহার প্রতিষ্ঠাত্রী।

 ১১। ভারতীয় বিজ্ঞান-সভা (The Indian Associatiog for the Cultivation of Science):—এই সভা ১৮৭৬ সালে স্থাপিত; বৌবাজার স্ট্রীটে ইহার একটী অতি সুন্দর ও প্রশস্তায়তন বাড়ী আছে। ইহার উদ্ভব ও বর্তমান সমৃদ্ধি সমস্তই একমাত্র পরলোকগত সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের ঐকান্তিক যত্নের ফল। ইহার স্থাপনকালাবধি প্রত্যেক রাজপ্রতিনিধি ইহার পেট্রন (পৃষ্ঠপোষক) হইয়া আসিতেছেন, এবং বঙ্গের শাসনকর্তার ও অন্যান্য প্রধান প্রধান রাজপুরুষ সকলেই ইহার প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি ও অনুরাগ প্রদর্শন করিয়াছেন।

 ১২। শোভাবাজার হিতৈষী সমাজ (The Sovabazar Benevolent Sciety):—১৮৮৩-৮৪ অব্দে স্থাপিত। মহারাজ কমলকৃষ্ণ দেব বাহাদুর ইহার প্রথম পেট্রন ও পোষণকর্তা। তাহার দ্বিতীয় পুত্র রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর ইহার প্রতিষ্ঠাতা। জাতিধর্মনির্বিশেষে দরিদ্র ছাত্র, অসহায় বিধবা ও অনাথ আতুর- দিগের অভাবমোচনই ইহার উদ্দেশ্য।

 ১৩। হিন্দু বিধবা সাহায্য সভা। মহারাজ বাহাদুর সার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর হিন্দু বিধবাদিগের সাহায্যকল্পে তাহার স্বর্গীয় মাতৃদেবীর নামে অর্থভাণ্ডার উৎসর্গ করিয়া তাহা গবর্ণমেণ্টের হস্তে অর্পণ করিয়াছেন। এই পরম কল্যাণকর শুভানুষ্ঠানের কার্যভার গবর্ণমেণ্ট ও সদাশয় দাতার নিয়োজিত একটি কমিটি কর্তৃক পরিচালিত হইয়া থাকে।

 ১৪। কলিকাতা অনাথাশ্রমঃ—শ্রীযুক্ত প্রাণকৃষ্ণ দত্ত কর্তৃক স্থাপিত। পরলোকগত রাজা দিগম্বর মিত্র বাহাদুরের পৌত্র উদার- হৃদয় কুমার মন্মথনাথ মিত্র রায় বাহাদুরের সদয় যত্নে ইহার ভাণ্ডারে যথেষ্ট অর্থ সঞ্চিত হইয়াছে ও হইতেছে। উক্ত কুমার বাহাদুরের স্লাঘ্য চেষ্টায় অচিরেই ইহার নিজের একটী বাড়ী হইবে।

 এতদ্ভিন্ন ‘অনাথবন্ধু-সমিতি, ভবানীপুর সাহায্য-সমিতি ও সহরের উত্তরাংশে ১নং ওয়ার্ডে পল্লী-সমিতি আছে; এগুলিও দরিদ্র পোষণ ও আর্ত্তত্রাণরূপ লোকহিতকর কার্যদ্বারা যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে।

 এক্ষণে বিভিন্নশ্রেণীর বিদ্যাশিক্ষার অনুষ্ঠানসমূহ সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলাম। ইংরেজ বণিকৃ-সম্প্রদায়, খৃষ্টান মিশনারিরা এবং অন্যান্য শিক্ষিত মহোদয়গণ এদেশে ইউরোপীয় আদর্শে বিদ্যাশিক্ষার প্রবর্তন করিয়া ধন্যবাদের ভাজন হইয়াছেন। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি যংকালে কেবল সামান্য ব্যবসাদার ও মুসল- মান বিধিব্যবস্থাদির শাসনাধীন ছিলেন, সে সময়ে বিদ্যাশিক্ষার প্রতি তাহাদের যে তাদৃশ যত্ন চেষ্টা ছিল না, তাহাতে আশ্চর্যের বিষয় কিছুই নাই। সে সময় খাস ইংলণ্ডেও বিদ্যাবিতরণের ভার জনসাধারণের এবং খৃষ্টীয় যাজকসম্প্রদায়ের হস্তে ছিল। তৎকালে তত্রত্য গবর্ণমেণ্ট জাতীয় শিক্ষাবিধান তাহাদের একটা অবশ্য কর্তব্য কর্ম্ম বলিয়া জ্ঞান করিতেন না। সুতরাং তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতেও বড় ইচ্ছুক ছিলেন না।

 মুসলমানদিগের রাজত্বকালে বিজ্ঞাশিক্ষার অনাদর ছিল না। সকল শ্রেণীর লোককেই আরবী, পারসী ও উর্দ ভাষা শিক্ষা দেওয়া হইত, এই সঙ্গে বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। অতি প্রাচীনকাল হইতে হিন্দুরা বিদ্যানু- রাগের জন্য প্রসিদ্ধ। হিন্দুস্থানে যে সাহিত্যের বিকাশ হইয়া- ছিল, কি সৌন্দর্য্যে কি জ্ঞানের গভীরতায় কোনও জাতির সাহিত্যই তাহার সমকক্ষ হইতে পারে নাই। বৌদ্ধধর্মের প্রাবল্য- কালে বৌদ্ধভিক্ষা বহু প্রসিদ্ধ বিহারে অকাতরে ছাত্রগণকে শিদ্যা বিতরণ করিতেন। কথিত আছে যে, কোন কোন বিহারে পাঁচ হইতে দশ সহস্ৰ ছাত্র থাকিয়া বিনাব্যয়ে আহার্য ও বাসস্থান পাইয়া বিদ্যালাভ করিত। ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণের টোল চতুষ্পাঠী পুর্বেও ছিল, এখনও আছে। এই সকল স্থানে বাঙ্গালা ও সংস্কৃত উভয় ভাষার সাহায্যে অধ্যাপনা হয় এবং ব্যাকরণ, অলঙ্কার, কাব্য, স্মৃতি, ন্যায়, জ্যোতিষ, বেদান্ত প্রভৃতি সকল বিষয়ই শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে। এই সকল বিদ্যালয়ের মধ্যে কোন কোনটীর ব্যয় নির্বাহের নিমিত্ত স্থায়ি-সম্পত্তি দেওয়া আছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ হলেই বিবাহ, শ্রাদ্ধ, পূজা প্রভৃতি উৎসব উপলক্ষের দানের সাহায্যে ব্যয় নির্যাহ হয়। কোন কোন অধ্যাপক পণ্ডিত ধনাঢ্য হিন্দু ভদ্রসন্তানদিগের নিকট বার্ষিক বৃত্তি পাইয়া থাকেন; এইরূপ বৃত্তিকে সাধারণতঃ কেবল 'বার্ষিক’ বলা হইয়া থাকে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ নিঃস্বার্থভাবে ছাত্রগণকে বিনামূল্যে কেবল বিদ্যা নহে, অধিকন্তু বাসস্থান, আহার্য্য ও কোন কোন স্থলে পরিচ্ছদ বিতরণ করিয়া যেরূপ ত্যাগস্বীকার করেন এবং তাঁহাদের শিষ্যগণও কেবল বিদ্যাশিক্ষার অনুরোধেই যেরূপ বিবিধ শারীরিক ক্লেশ স্বীকার করেন, তাহা উভয় পক্ষেরই সবিশেষ শ্লাঘার বিষয় সন্দেহ নাই, এবং তাহাতে হিন্দুজাতির জ্ঞান পিপাসার ও জ্ঞান-বিস্তারাকাঙ্ক্ষার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।

 কথিত আছে যে, বাষিক ২,৪০০ টাকা ব্যয়ে ২০টি দরিদ্র বালকবালিকার ভরণপোষণের ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা হইয়াছিল; ইহাদিগকে ওল্ড কোর্ট হাউস বা টাউন হল নামক বাটীতে রাখিয়া খাইতে দেওয়া হইত। এই অর্থভাণ্ডার ১৭৩৪ সালে বা তৎসম- কালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কেহ কেহ বলেন, বিখ্যাত কুঠিয়াল উমিচাঁদ এই ভাণ্ডারের সাহায্যকল্পে ৩০,০০০ টাকা সাহায্য করিয়াছিলেন, কিন্তু এবিষয়ে মতবিরোধ দৃষ্ট হয়। ১৭৩৪ অকে ব্রুশিয়ার সাহেব কর্তৃপক্ষকে এই নিয়মে ওল্ড কোর্ট হাউস অর্পণ করেন যে, তাঁহারা একটি দাতব্য বিদ্যালয়ের ব্যয়নিৰ্বাহার্থ বার্ষিক ৪,০০০ টাকা প্রদান করিবেন। ১৭৫৬ অব্দে মুরগণ ইংরেজদিগের গির্জা বিধ্বস্ত করিলে কোম্পানী তাহার ক্ষতিপুরণ স্বরূপ যে অর্থ পাইয়াছিলেন, তাহাও এই ভাণ্ডারে প্রদান করিয়া ইহার পরিমাণ বর্ধিত করিয়া দেন।

 যে যে উপায়ের অর্থে পুরাতন কলিকাতা দাতব্য ভাণ্ডার (Old Calcutta Oharity Fund) সমুদ্ভূত হইয়াছিল, তাহা নিম্নে উল্লিখিত হইল:—

  ১। ১৭৩২ সালের পূর্বে বা তৎসমকালে প্রথম যে চাঁদা সংগৃহীত হইয়াছিল;

 ২। গির্জার সংগৃহীত অর্থ;

 ৩। পুরাতন গির্জা ধ্বংসের ক্ষতিপূরণস্বরূপ নবাব মিরজাফর আলি খা কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ। ইহার পরিমাণ অজ্ঞাত;

 ৪। স্বয়ং উমিচাদের প্রদত্ত, অথবা তাহার মৃত্যুর পর তাহার দত্ত-ধন-বিধাতা প্রদত্ত অর্থ। উমির্চা কলিকাতায় ১৭৬০ সালে কালগ্রাসে পতিত হন। এই দানের পরিমাণ ও অন্যান্য বিশেষ বিবরণ অজ্ঞাত;

 ৫।লয়েন্স কষ্টাণ্টিয়স্ নামক জনৈক মৃত ধনবান্ পর্তুগীজের সম্পত্তির এক্সিকিউটার চার্লস্ ওয়েষ্টন কর্তৃক ১৭৭৩-৭৪ অব্দে প্রদত্ত “,০০০ টাকা (ব। তদপেক্ষা কিছু কম)।  এতদ্ভিন্ন কোম্পানি মেয়র্স কোর্ট বা টাউন হল (পরে ওল্ড কোর্ট নামে অভিহিত) নামক বাড়ীর ভাটক স্বরূপ মাসিক ৮০০ টাকা এই অর্থভাণ্ডারে প্রদান করিতেন। উত্তরকালে ওল্ড কোর্ট হাউস যখন ভাঙ্গিয়া ফেলা হয়, সেই সময়ে গবর্ণমেণ্ট চর্চ ওয়ার্ডেন- দিগের (গির্জার কর্মচারিবিশেষ) নিকট স্বীকৃত হইয়াছিলেন যে, তঁহারা ঐ ৮০০ টাকা চিরকাল দিবেন। সম্ভবতঃ ওয়ার্ডেন ও চাপলেনগণ (খৃষ্টীয় রাজকোষবিশেষ) সাক্ষাৎ সম্বন্ধে এই ফণ্ডের কার্য্য পরিচালনা করিতেন, কিন্তু ইহার সম্পূর্ণ কর্তৃত্বভার কোম্পা- নীর হস্তে ছিল। তৎকালে এই বিদ্যালয়ে লেকচার (উপদেশ) প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। ১৭৮৮ সালে ডাক্তার বেল দর্শনশাস্ত্র সম্বন্ধে ধারাবাহিকরূপে কতকগুলি লেক্চার প্রদান করেন। ১৭১০ সালে এই ফণ্ডের অর্থপরিমাণ ২,৪৫,৮৯৭ প্রচলিত টাকায় দাঁড়া- ইয়াছিল। এই সময় ফ্রী স্কুল সোসাইটি ইহার সহিত মিলিত হয়। ১৭৯ সালে ফ্রী-স্কুলের ফণ্ডে ৫৮,৬২, টাকা ছিল। উভয় ফণ্ড মিলিত হইয়া ফ্রী স্কুল নাম ধারণ করিল, এবং উহাদের মোট সম্পত্তি ৩০,৩,৯৫৯ টাকায় দাঁড়াইল। এ স্থলে ফ্রী-স্কুল সম্বন্ধে দুই চারি কথা বলা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। ১৭৮৯ সালের ২১শে ডিসেম্বর ইহা স্থাপিত হয়। এই মহারাজধানীতে কিঞ্চিৎ বৃহদাকারে সাধারণের হিতকর কার্যের অনুষ্ঠান ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। চুচুড়ার গবর্ণর মাকুইস অব, কর্ণওয়ালিস্ ইহার উদ্দেশ্যের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি প্রদর্শন করিতেন।

 ১৭৮০ অব্দে বা তৎসমকালে মিষ্টার হজেস নামক এক সাহেব আম্মানী গির্জার নিকট একটি গবর্নমেণ্ট স্কুলের বিজ্ঞাপন দিয়া প্রচার করেন যে, তথায় পড়া, লেখা ও সূচিকর্ম শিক্ষা দেওয়া হইবে। আর এক ব্যক্তি চিৎপুর পোলের অপর দিকে একটি বোর্ডিং-স্কুলের বিজ্ঞাপন প্রচার করিয়া বলিয়াছিলেন যে, তথায় পড়া, লেখা ও অঙ্ক শিক্ষা দেওয়া হয়; বেতন শিক্ষকের টেবিলে মাসিক ৫০ টাকা, এবং স্বতন্ত্র টেবিলে মাসিক ৩০ টাকা; একজন সহ- কারী না পাওয়া পর্যন্ত ১৪ টীর অধিক বালক লওয়া হইবে না। ১৭৮১ অব্দে গ্রিফিথ সাহেব বৈঠকখানার নিকট তাহার বাগান বাড়ীতে একটি বোর্ডিং স্কুল করেন; তথায় “তরুণবয়স্ক ভদ্রসন্তান- দিগকে ভদ্রলোকের মত খাইতে দেওয়া হয়, তাহাদের প্রতি কোমল ব্যবহার করা হয়, এবং তাহাদিগকে অতি শীঘ্র শীঘ্র শিক্ষা দেওয়া হয়।

 ১৮৮০ সালে আর্চ্চার সাহেব কেবল বালকদিগের জন্য একটা স্কুল স্থাপন করেন। তাহার উন্নতি দেখিয়া আরও অনেকে আসরে অবতীর্ণ হইল। সে কালের যে সে লোকে স্কুল খুলিয়া বসিত। যাহারা খানসামা বা পাদুকাকার হইবার উপযুক্ত, তাহারাও স্কুল খুলিয়া অধ্যাপকের আসনে বসিয়া যাইত। এ সম্বন্ধে জনৈক লেখক লিখিয়াছেন—“অকর্মণ্য সৈনিক, দেউলিয়া মহাজন, সৰ্বস্বান্ত মিতব্যয়ী সকলেই এই বৃত্তি অবলম্বন করিত। ইহাকে তাহার উপার্জ্জনের একটি সুন্দর পথ মনে করিত। কথিত আছে যে, আন্দিরাম দাস নামক এক ব্যক্তি তাহার নিজ বাড়ীতে একটি স্কুল খুলিয়া বসিয়াছিল; তথায় কতকগুলি হিন্দু বালক প্রত্যহ যাতায়াত করিত এবং তাহার পুস্তক হইতে কিঞ্চিৎ জ্ঞান লাভ করিবার আশায় তাহার সুযোগ সুবিধার প্রতীক্ষায় কয়েক ঘণ্টা করিয়া বসিয়া থাকিত। এই ধর্ম্মনিষ্ঠ দেশহিতৈষী ছাত্রদের পাঠের নিমিত্ত প্রতি দিল পাঁচ ছয়টী কথা বলিয়া দিত।”

 কথিত আছে যে, ১৭৭৩-৭৪ সালে সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হইলে ইংরেজী শিক্ষার ক্রমেই প্রচার হইতে লাগিল। রামরাম মিশ্র নামক এক ব্যক্তি এবং তাহার ছাত্র রামনারায়ণ মিশ্র, এই দুইজন ইংরেজী বিদ্যায় সুপণ্ডিত বলিয়া বিবেচিত হইতেন। রামরাম মিশ্র একটি স্কুল করিয়াছিলেন; তাহাতে কতকগুলি হিন্দু ছাত্র শিক্ষালাভ করিত; বেতন ৪ টাকা হইতে ১৬ টাকা পর্যন্ত ছিল। ইহার পূর্বে মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুর এবং স্বনামখ্যাত সিবিলিয়ান শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্তের জনৈক পূর্বপুরুষ বাবু নীলমণি দত্ত, এই দুইজন বাঙ্গালী ইংরেজী জানিতেন; পরন্তু তাঁহারা কি উপায়ে এ ভাষা শিখিয়াছিলেন, তাহা জানা যায় নাই। বোধ হয় মহারাজ ওয়ারেন হেষ্টিংসের নিকট ইংরেজী শিখিয়া থাকিবেন, কারণ তিনি আবার সাহেবকে পারসী ও বাঙ্গালা পড়াইতেন।

 সে সময়ে আর্চার সাহেবের স্কুলই একমাত্র ইংরেজী বিদ্যালয় ছিল না; ফ্যারেলস সেমিনারী এবং ধর্মতলা একাডেমি উহার প্রতিদ্বন্দী ছিল। প্রায় এই সময়ে হালিফাক, লিনষ্টেট ও ড্রাপার এই তিন জন সাহেবও তিনটি স্কুল স্থাপন করেন। এই সমস্ত স্কুলে মোটামুটী রকমের ইংরেজী শিক্ষা দেওয়া হইত; কোন কোন স্কুলে নাবিক বিদ্যা ও সাহেবী দোকানের খাতাপত্র রাখার কৌশলও শিখান হইত। এই সকল বিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্র ড্রমণ্ড সাহেব স্বয়ং লিখিয়াছেনঃ—“তিনিই প্রথমে ধর্ম্মতলা স্কুলে গ্রামার (ইংরেজী ব্যাকরণ) ও গ্লোবের ব্যবহার প্রবর্তিত করেন। ...বস্তুতঃ সে সময়ে লোকে পড়া, লেখা ও অঙ্ক ভিন্ন অন্য উচ্চ শিক্ষার আকাঙ্খা রাখিত না। ড্রমণ্ড সাহেব শিক্ষার পরিমাণ বর্ধিত করিতে বিস্তর চেষ্টা করিয়াছিলেন। সেকালে তিনিই নিজের স্কুলে ইংরাজী সাহিত্য ও লাটিন শিক্ষার প্রথা প্রবর্তিত করেন। যে ডিরোজিও উত্তরকালে হিন্দু কলেজের প্রসিদ্ধ অধ্যা- পক হইয়াছিলেন, সেই ডিরোজিও বাল্যকালে এই স্কুলে প্রথম শিক্ষা লাভ করেন। ড্রমণ্ড সাহেবের যত্নেই বার্ষিক পরীক্ষার প্রথা প্রবর্তিত হয়। এ কালের ন্যায় সেকালেও পরীক্ষাটা বালকদের একটা বৃহদ্ব্যাপার ছিল। সে দিবস তাহাদের একটা বিষম বিভী- ষিকা ও মহা আনন্দের দিন হইত, একদিকে পরাজয়ের অনুত্তীর্ণ হইবার আশঙ্কা যেমন ভয়ের কারণ হইত, অপর দিকে তেমনি প্রাইজ পাইবার অনিশ্চিত আশা ও আনন্দময় ছুটী পাইবার নিশ্চিত আশা তাহাদিগকে আহ্লাদে অধীর করিয়া তুলিত।

  কীর্ণ্যাণ্ডার সাহেবের মিশন স্কুলের কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। ক্যানিঙ সাহেবের এক স্কুল ছিল; তথায় পরলোকগত রাজা সার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। শেরবর্ণ সাহে- বের স্কুলেই দ্বারকানাথ ঠাকুর শিক্ষিত হইয়াছিলেন। ভবানীপুরে ইউনিয়ন স্কুলেই হিন্দু পেট্রিয়টের সুপ্রসিদ্ধ ও সুযোগ্য সম্পাদক স্বর্গীয় হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া- ছিলেন। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র পাথুরিয়াঘাটায় ক্ষেম বসুর স্কুলের ছাত্র ছিলেন। মোহন নাপিত, কৃষ্ণমোহন বসু, ভুবন দত্ত, শিবু দত্ত, আরাটুন পিটার্স ও অন্যান্য লোকের অধীনে কতকগুলি স্কুল ছিল। রামমোহন রায়ও মাণিকতলা স্ত্রীটে ইণ্ডিয়ান একাডেমি নামে একটা স্কুল স্থাপন করিয়াছিলেন; উহাকে সাধারণ লোকে রামমোহন রায়ের হিন্দুস্কুল বলিত। এতদ্ভিন্ন আরও অনেক বেসরকারী স্কুল ছিল; তন্মধ্যে কতকগুলির নাম নিয়ে লিখিত হইল;—
... প্রাতঃকালে ১২৫ জন ছাত্র।
শীলস্ ফ্রি কলেজ ... দিবাভাগে ৩০০ "
পেট্রিয়টিক কলেজ ... " ১১০ "
ওরিএন্টাল সেমিনারি(১৮২৩ খৃঃ) ৫৮৫ "
আংলো ইণ্ডিয়ান স্কুল প্রাতঃকালে ১০০ "
ইউনিয়ন স্কুল(১৭৯৩ খৃঃ)দিবাভাগে ১৮০ "
হিন্দু বেনেভলেণ্ট ইনষ্টিটিউশনদিবাভাগে ১০০ "
লিটারারি সেমিনারি ... " ৫০ "
চ্যারিটেবল মর্ণিংস্কুল ... প্রাতঃকালে ৮০ "

 এই সকল বিদ্যালয়ের মধ্যে ওরিএন্টাল সেমিনারি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হাইকোর্টের প্রথম দেশীয় জজ শম্ভুনাথ পণ্ডিত, সুপ্রসিদ্ধ বাঙ্গালা-লেখক অক্ষয়কুমার দত্ত, খাতনামা ব্যারিষ্টার ডবলিউ. সি. ব্যানার্জী প্রভৃতি বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠ ভদ্রলোক প্রথমে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন। বাবু গৌরমোহন আঢ্য এই স্কুল স্থাপন করেন; এইজন্য ইহাকে সাধারণতঃ গৌরমোহন আড্ডির স্কুল বলিত। তাঁহার সম্বন্ধে একজন লেখক কলিকাতা রিভিউ পত্রে এইরূপ লিখিয়াছেন:—

 “সপ্তবিংশবর্ষ বয়ঃক্রমকালে তিনি উপার্জনের অন্য কোন সুবিধাজনক পথ না দেখিয়া স্বদেশীয়দিগের নিমিত্ত একটি স্কুল স্থাপন করিলেন এবং কয়েক বৎসর অবিচলিত অধ্যবসায়ের সহিত পরিশ্রম করিতে লাগিলেন। তৎপরে তাঁহার ছাত্রসংখ্যা যখন প্রায় ২০০ হইয়া উঠিল, সেই সময়ে তিনি টর্ণফুল নামক এক সাহেবকে অংশী করিয়া লইলেন। ইহার পর ক্রমশই তাহার স্কুলের উন্নতি হইতে লাগিল; তঁহার অংশীর মৃত্যুর পর হইতে তাঁহার নিজ মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি অতি দক্ষতার সহিত নিজ তত্ত্বাবধানে স্কুলের কার্য্য পরিচালনা করিয়াছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি হামান জিওফ্রি নামক একজন দুঃস্থ ব্যারিষ্টার প্রাপ্ত হন; সেই ব্যারিষ্টা- রের উৎকৃষ্ট শিক্ষায় গৌরমোহনের স্কুল বিলক্ষণ প্রাধান্য লাভ করিল। গৌরমোহনকে দেখিলেই ধর্ম্মভীরু বলিয়া বোধ হইত; তিনি এরূপ সরল প্রকৃতির লোক ছিলেন যে, তিনি প্রথম শ্রেণীর বালকদিগকে অকপটে বলিয়া ফেলিতেন যে, আমি তোমাদিগকে পড়াইতে পারি না। বৃথা অভিমানের লেশ মাত্র হাতে ছিল না। যাহা তিনি জানতেন, তাহা অন্য সমস্ত দেশীয় শিক্ষক অপেক্ষা উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিতে পারিতেন। তিনি অতি মৃদু- স্বভাব ছিলেন; আশ্চর্যের বিষয় এই যে, নানাপ্রকার স্বভাব ও মেজাজের লোকের সহিত তাহাকে কারকারবার করিতে হইলেও তিনি অতি সুকৌশলে আপনার কার্য্য সম্পন্ন করিতেন, তিনি কখ- নও কাহারও বিরাগভাজন হন নাই। তিনি ছাত্রমণ্ডলীর অতিশয় প্রিয়পাত্র ছিলেন; আর যদিও তিনি নিয়মানুগামিতা ও বশবর্ত্তিতা সম্বন্ধে কঠোর শাসনপ্রণালী অবলম্বন করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না এবং যদিও তাহাকে এমন অনেক স্বেচ্ছাচারী বালককে লইয়া চলিতে হইত, যাহাদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি তাহাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, কিন্তু তথাপি তিনি সকলেরই সমানভাজন ও অনেকের প্রণয়াস্পদ হইয়াছিলেন।”

  এস্থলে শীলস্ ফ্রী কলেজ সম্বন্ধেও দুই চারি কথা না বলিয়া থাকা যায় না। সদাশয় মতিলাল শীলের বদান্যতা হইতে এই বিদ্যালয়ের উদ্ভব। কলিকাতার মধ্যে একটিমাত্র বিদ্যালয়ে দেশীয় দরিদ্র ছাত্রগণকে বিনা বেতনে শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে। কোন কোন বালক বিনাব্যয়ে আহার্যও প্রাপ্ত হয়। মতিলাল শীল অতি হীনাবস্থা হইতে প্রচুর বিভবশালী হইয়াছিলেন। তিনি ধর্মপরায়- ণতা ও অকুণ্ঠিত দানশীলতার জন্য সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার ন্যায় উদারহৃদয় বিশ্বপ্রেমিক অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। তিনিই কলুটোলার বিখ্যাত শীলবংশের আদি পুরুষ।

 কলিকাতায় বিদ্যালয় সংস্থাপনে ব্যক্তিবিশেষ কিরূপ চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন, আমরা এতক্ষণ তাহারই কথা বললাম। অতঃপর এতৎপক্ষে মিশনারি ও অন্যান্য সম্প্রদায় এবং রাজপুরুষেরা কিরূপ উদ্যমশীলতার পরিচয় দিয়াছেন, তৎসম্বন্ধে সংক্ষেপে দুই চারি কথা বলিতে চেষ্টা করি। এ সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলে সর্ব্বপ্রথমে “মহাপাঠশালা” বা কলিকাতার “হিন্দু-কলেজ” নামক বিদ্যালয়ের নামোল্লেখ করা আবশ্যক। হিন্দুসন্তানগণের উচ্চশিক্ষার নিমিত্ত একটি বিদ্যামন্দির প্রতিষ্ঠা ও তাহার জন্য অর্থ সংগ্রহ করিবার উদ্দেশ্যে ১৮১৬ সালের ৪ঠা মে[৩] তারিখে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সার ঈ, হাইড় ঈষ্ট মহোদয়ের ভবনে সম্ভ্রান্ত হিন্দুদিগের একটি আনুষ্ঠানিক সভার অধিবেশন হয়। প্রধান বিচারপতি সভার কার্য্য আরম্ভ করিবার সময়ে মুখবন্ধে এইরূপ বিদ্যালয়ের উপকারিতা সবিস্তারে বর্ণন করিয়া শ্রোতৃবর্গকে ঐ বিষয়ে উৎসাহশীল হইতে অনুরোধ করেন। তাঁহার প্রস্তাব উপস্থিত হিন্দু-ভদ্রলোকগণ এবং বিখ্যাত পণ্ডিতগণ অন্তরের সহিত সমর্থন করিলে, সেই সভাতে ৬,০০০ পাউণ্ডের উপর চাঁদা স্বাক্ষরিত হয়।

 ঐ সভায় ডবলিউ, সি, ব্ল্যাকিয়ার ও জে, ডবলিউ, ক্রফট নামক দুইজন সাহেব চাঁদার টাকা সংগ্রহ করিবার নিমিত্ত অস্থায়ী ধনাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অতঃপর ২১শে তারিখে একটী প্রকাশ্য সভার অধিবেশন হয়; তাহাতে গভর্ণর জেনারেল ও তাহার সদস্য- গণ পেট্রন, প্রধান বিচারপতি সার ঈ, হাইড ঈষ্ট সভাপতি, সদর দেওয়ানি ও নিজামত আদালতের প্রধান বিচারক জে, এইচ, হরিংটন সহ-সভাপতি, এবং আটজন ইউরোপীয় সাহেব, পাঁচজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও অপর পনর জন দেশীয় ভদ্রলোক কমিটির মেম্বয় নিযুক্ত হন। ২৭শে তারিখে ঐ কমিটির যে অধিবেশন হয়, তাহাতে জোসেফ ব্যারেটো স্থায়ী ধনাধ্যক্ষ ও লেফটেনাণ্ট ফ্রান্সিস আর্ভাইন ইংরেজী সেক্রেটারী এবং দেওয়ান বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়[৪] ইংরেজী সেক্রেটারীকে সাহায্য করিবার জন্য দেশীয় সেক্রেটারী নিযুক্ত হন এবং কলেজবাড়ীর উপযুক্ত স্থানসংগ্রহ ও আপাতত বিদ্যালয় বসাইবার জন্য একটা অস্থায়ী বাটী সংগ্রহ করিবার নিমিত ডবলিউ সি, ব্ল্যাকিয়ার, রামগোপাল মল্লিক, গোপীমোহন দেব ও হরিমোহন ঠাকুর এই কয়েকজনকে লইয়া একটি সব-কমিটি গঠিত হয়। এই সভায় বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য এইরূপ প্রচারিত হইয়া- ছিলঃ -–“সম্রান্ত হিন্দুসন্তানগণকে ইংরেজী ও দেশীয় ভাষা এবং ইউরোপের সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়াই এই বিদ্যালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য।” পরবর্ত্তী ১১ই জুন তারিখে কমিটির ইংরেজ মেম্বরগণ তাঁহাদের ‘ভোট’ দিবার অধিকার পরিত্যাগ করিবার অভিলাষ প্রকাশ করেন, এবং সভাপতি ও সহকারী সভাপতিও ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, অতঃপর তাঁহারা যেন বিদ্যালয়ের বেসরকারী মিত্র বলিয়া বিবেচিত হন। এ পর্যন্ত কমিটীর সমস্ত অধিবেশনই প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হইয়াছিল। বোধ হয়, পাঠকগণের কৌতূহলনিবৃত্তির নিমিত্ত শিক্ষকগণের নাম এবং তাঁহাদের বেতনের পরিমাণ এস্থলে উল্লেখ করিলে অসঙ্গত হইবে না: নাম জেমস আইজ্যাক ডি আনসেল,
ইরেজী বিদ্যালয়ের হেড মাষ্টার


নিকোলাস উইলার্ড, শিক্ষক
পিটার এমৃনিয়ার, শিক্ষক
হেনরি ওয়ার্ড, শিক্ষক
মৌলবী মহম্মদ এ, বকসি, পারসী শিক্ষক

বেতন টাকা ২০০্ মাসিক এবং

কার্যে যোগ দিলে সাজ-
সজ্জা বলিয়া ১০০্ টাকা।

“৩৬্
“৩৬্
“১৬্


 এতদ্ভিন্ন সেক্রেটারী স্বরূপে লেফটেনান্ট ফ্রন্সিস্ আর্ভাইনের বেতন মাসিক ৩০০্ টাকা, এবং নেটিভ সেক্রেটারী, সুপারিন্টেণ্ডেন্ট ও এ্যাকাউন্ট্যান্ট স্বরূপ দেওয়ান বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের বেতন মাসিক ১০০্ টাকা ছিল।  ১৮১৭ সালের ২০শে জানুয়ারি সোমবার বাবু গোরাচাঁদ বসা- কের বাড়ীতে হিন্দুকলেজ প্রথম খোলা হয়। বাড়ীর জন্য মাসিক ৮০ টাকা ভাড়া দিতে হইত। বাবু হরনাথ কুমার তাঁহার চিৎ পুরের বাড়ী কমিটির হস্তে অৰ্পণ করিতে অনিচ্ছুক হওয়ায় বাড়ী ভাড়া করিতে হইয়াছিল। ডেভিড হেয়ার ও হোরেস হেম্যান উইলসন প্রভৃতি বহু ভদ্রলোকই এই বিদ্যালয়ের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি ও যত্ন প্রদর্শন করিতেন। ডেভিড হেয়ার ভারতবাসী- দিগের অবস্থার উৎকর্ষবিধানের নিমিত্ত যে সকল মহৎ কার্য্য করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে তাঁহার নাম যথাযোগ্যরূপেই সমাদৃত ও সম্মা- নিত হইয়া রহিয়াছে। তিনি গবর্ণমেণ্টের হস্তে নিজের যে ভূমি দান করিয়াছিলেন, তাহারই উপর হিন্দু ও সংস্কৃত কলেজের বাড়ী ১,২৪,০০০ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়। কলিকাতার মেডিক্যাল কলেজ যখন প্রথম স্থাপিত হয়, তখন লোকের অনুরাগ আকর্ষণ করিয়া প্রতিষ্ঠালাভ করিবার নিমিত্ত উহাকে অনেক সংগ্রাম করিতে ও বিস্তর বেগ পাইতে হইয়াছিল; সেই বিপদের দিনে ডেভিড হেয়ার উহাকে প্রকৃত কার্যকর ও জনপ্রিয় করিবার নিমিত্ত যেরূপ অসামান্য শ্রমস্বীকার করিয়াছিলেন, তাহা বস্তুতঃ সবিশেষ শ্লাঘার বিষয়। শিক্ষিত লোক বলিলে সাধারণত যাহা বুঝায় ডেভিড হেয়ার সে অর্থে শিক্ষিত লোক নাও হইতে পারেন, কিন্তু শিক্ষাবিষয়ে তাঁহার যে ঐকান্তিক আগ্রহ দৃষ্ট হইয়াছে এবং প্রাচ্য ভূখণ্ডে প্রতীচ্য শিক্ষা-বিস্তারের যেরূপ উদার ভাব তিনি পোষণ করিতেন, তাহাতে তাহাকে উচ্চশ্রেণীর শিক্ষাব্যবসায়ী বলা যাইতে পারে। ডেভিড হেয়ার হিন্দু-কলেজের জন্য যাহা করিয়াছেন, কি ইউরোপীয় কি দেশীয়, আর কোনও ব্যক্তি তাহা করিয়াছেন কি না সন্দেহ। তিনি আবার একজন মহান বিশ্বপ্রেমিক ও দরিদ্রসুহৃদ ছিলেন। তিনি ঘড়ীর ব্যবসায় অবলম্বন করিবার উদ্দেশ্যে ১৮০০ সালে কলিকাতায় আগমন করেন, এবং কতিপয় বৎসর ঐ কর্ম্মে নিযুক্ত থাকার পর তাহা পরিত্যাগ করেন। অতঃপর তিনি আপনার সমস্ত সময় ও অর্থ দেশীয়দিগের শিক্ষাবিধানে উৎসর্গ করেন। তৎকালে দেশের মঙ্গলার্থ যে কোনওরূপ কার্য্য বা আন্দোলনের অনুষ্ঠান হইত, তাহাতেই তিনি কায়মনোবাক্যে যোগ দিতেন। কেবল শিক্ষা কেন, দেশহিতকর সর্ব্ববিধ কার্য্যেই তাঁহাকে ব্যাপৃত দেখিতে পাওয়া যাইত; এদেশে দেওয়ানি আদালতে জুরিপ্রথার প্রবর্ত্তন ও মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার নিমিত্ত তাঁহার ঐকান্তিক ঔৎসুক্য ও আগ্রহ এবং কুলি-ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন ও তাঁহার প্রতিবন্ধকতা, এগুলি তাহার বহুতোমুখি-ক্রিয়াশীলতার যৎসামান্য কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়া নামক ইংরেজী সংবাদপত্র তাঁহার মৃত্যুসংবাদ প্রচার করিবার সময়ে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার এক বর্ণও অসত্য বা অতিরঞ্জিত নহে। তাহাতে এইরূপ লিখিত হইয়াছিলঃ —“পরলোকগত ডেভিড হেয়ার যেরূপ অশ্রুতপূর্ব্বভাবে জীবন যাপন করিয়া প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া গিয়াছেন, ভারতে অন্য কোনও ব্যক্তিই এ পর্যন্ত তাহা পারেন নাই।  * *   *   * শিক্ষা সংস্কারবিহীন, বিদ্যাবুদ্ধিহীন, উচ্চপদ, ক্ষমতা ও ধনবিরহিত ডেভিড হেয়ার ভারতীয় বালক ও যুবকদিগের উন্নতিসাধনার্থ অবিরাম চেষ্টা দ্বারা দেশীয় সমাজে একাদিক্রমে বহু- বৎসর যাবৎ প্রভাব ও মর্যাদা অর্জ্জন ও রক্ষা করিয়া যে দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন, তাহা ভারতে অদ্বিতীয় এবং অন্য দেশেও বিরল।” হেয়ার ১৮৪২ সালের ১লা জুন কলেবর পরিত্যাগ করিলে এক টাকা করিয়া চাঁদা তুলিয়া একটি সমাধি-স্তম্ভ নির্মিত হইয়া ছিল, তাহাতে যে ক্ষোদিত লিপি মণ্ডিত আছে, তাহার মর্ম এইরূপ—

 “স্কটল্যাণ্ড ইহার জন্মভূমি; ইনি ১৮০০ সালে এই নগরে আগ- মন করেন, এবং ঘড়ি-নির্মাতার ব্যবসায়ে সচ্ছলভাবে চলিবার মত অর্থ উপার্জন করার পর ১৮৪২ সালের ১লা জুন ৬৭ বৎসর বয়ঃ- ক্রমকালে ইহলোক ত্যাগ করেন। ইনি এই বিদেশকেই নিজের দেশ করিয়া লইয়াছিলেন, এবং ইহার একমাত্র অতিপ্রিয় উদ্দেশ্য সাধনে, অর্থাৎ বঙ্গবাসীদিগের শিক্ষা ও নৈতিক উন্নতিবিধানে, অক্লান্ত আগ্রহ ও হিতৈষণার সহিত আপনার জীবনের অবশিষ্টকাল সানন্দে নিয়োজিত করিয়াছিলেন; এজন্য সহস্র সহস্র বঙ্গবাসী ইহার জীবিতকালে ইহাকে পিতার ন্যায় ভালবাসিত ও ভক্তি করিত এবং ইহার মরণেও আপনাদের সর্বোৎকৃষ্ট ও নিঃস্বার্থ বন্ধু বলিয়া শোক প্রকাশ করিতেছে।”

 ডেভিড হেয়ারের সম্মানার্থ তাঁহার উপযুক্ত স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করিবার উপায় নির্ধারণ করিবার জন্য ১৮৪১ সালের ১৭ই জুন তারিখে কাশিমবাজারের বর্তমান মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর পূর্ব- পুরুষ (মাতুল) পরলোকগত রাজা কৃষ্ণনাথ রায়ের যত্নে মেডিক্যাল কলেজের বাড়ীতে হিন্দুসমাজের এক সাধারণ সভা আহূত হয়। তাহাতে স্থির হয় যে, হেয়ারের একটি পূর্ণাবয়ব প্রতিমূর্তি স্থাপিত হইবে; তদনুসারে যে প্রতিমূর্তি স্থাপিত হয়, তাহা এক্ষণে প্রেসি- ডেন্সি কলেজ ও হেয়ার স্কুল এতদুভয়ের মধ্যস্থলে দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার পাদদেশে যে লিপি খোদিত আছে, তাহার মর্মার্থ এইরূপ:—

 “ডেভিড হেয়ারের সম্মানার্থ; তিনি অবিচলিত শ্রমশীলতা দ্বারা সচ্ছলভাবে চলিবার মত যথেষ্ট ধন উপার্জন করিয়াছিলেন, কিন্তু যে বিদেশকে তিনি স্বদেশ করিয়া লইয়াছিলেন, তাহার শুভ-সংবর্ধ- নোদ্দেশ্যে সে ধন উপভোগ করিবার নিমিত্ত জন্মভূমিতে প্রত্যাগত হইবার আশা সানন্দে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।”

 পরলোকগত বাবু কিশোরচাঁদ মিত্রের উদ্যোগে হেয়ার-বার্ষিক উৎসব-কমিটি গঠিত হইয়াছে; প্রথম অবস্থায় তিনি নিজে উহার সেক্রেটারী এবং পরলোকগত পাদরি ডাক্তার কে, এম, বন্দ্যো- পাধ্যায় উহার সম্পাদক হন। হেয়ারের মৃত্যুর দিবসে ভারতবাসী- দিগের মানসিক বা নৈতিক উন্নতি সম্পকীয় কোনও বিশেষ বিষয়ে প্রতিবৎসর বক্তৃতা প্রদত্ত বা প্রবন্ধ পঠিত হইয়া থাকে। তদ্ভিন্ন বাঙ্গালা ভাষার উৎসাহবর্দ্ধনার্থ “হেয়ার-প্রাইজ ফণ্ড” নামে একটি অর্থভাণ্ডারও সংস্থাপিত হইয়াছে।

 হিন্দু-কলেজের পরবর্তী ইতিহাস সম্বন্ধে অধিক কথা না বলি- লেও চলে। ১৮২৫ সালে হিন্দু-কলেজের বাটী নিৰ্মাণ সমাপ্ত হয়। কিন্তু যাহারা এই ফণ্ডের ধনাধ্যক্ষতা করিয়াছিলেন, সেই জোসেফ ব্যারেটো এণ্ড সন্স নামক কোম্পানি ফেল’ হওয়ায় অর্থাৎ দেউলিয়া পড়ায় তাহাদের হস্তে কলেজের যে কিছু অর্থসঙ্গতি ছিল, সমস্তই লয় প্রাপ্ত হয়। তখন ম্যানেজিং কমিটি গবর্ণমেণ্টের নিকট সাহায্যপ্রার্থী হইলে গবর্ণমেণ্ট তৎক্ষণাৎ মুক্তহস্তে অগ্রসর হইলেন এবং এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন যে, অতঃপর গবর্ণমেণ্টের সাধারণ-শিক্ষা-কমিটি হিন্দু-কলেজের পরিচালনার তত্ত্বাবধান করি- বেন। গবর্ণমেণ্টের এই প্রস্তাব সম্বন্ধে মেম্বরদিগের মধ্যে মতভেদ উপস্থিত হইল। অবশেষে বিবদমান পক্ষদ্বয় ডাক্তার এইচ, এইচ, উইলসন[৫] ও ডেভিড হেয়ারকে স্ব স্ব প্রতিনিধি নিযুক্ত করিলে এই বিষয়ের সুমীমাংসা হইয়া যায়। ইহারই সমকালে রাজা বৈদ্য- নাথ, কান্তবাবুর পুত্র হরিনাথ রায়, এবং কালীশঙ্কর ঘোষাল যথা- ক্রমে ৫০,০০০, ২০,০০০ ও ২০,০০০ টাকা দান করেন। ছাত্রেরা যাহাতে অকালে বিদ্যালয় পরিত্যাগ না করিয়া দীর্ঘকাল বিদ্যা- লোচলা করিতে প্রবর্তিত হয়, এই উদ্দেশ্যে বৃত্তি স্থাপনার্থ ঐ অর্থ বিনিয়োজিত হইয়াছে। পুরাতন হিন্দু কলেজ বর্তমান সময়ে হিন্দু স্কুল নামে পরিচিত হইয়া এক্ষণে খাস গবর্ণমেণ্টের স্কুল হইয়াছে।

 হেয়ার স্কুলঃ— ডেভিড হেয়ারের পবিত্র নাম স্মরণার্থ এই বিদ্যালয়ের এইরূপ নামকরণ হইয়াছে। ইহাও গবর্ণমেণ্টের স্কুল।

 লা মার্টিনিয়ার কলেজঃ— জেনারেল মার্টিন কর্তৃক স্থাপিত তিনি খৃষ্টানদিগের নিমিত্ত একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য দুই লক্ষ টাকা দিয়া যান এবং তাহার স্থায়িত্বের জন্য আরও দেড়লক্ষ টাকা দান করেন। কলেজটিতে দুইটি বিভাগ আছে; একটি বালক- দিগের জন্য এবং অপরটি বালিকাদের জন্য। ইহা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত সংসৃষ্ট এবং ইহাতে বি, এ, পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা আছে।

 ক্লড মার্টিনের জন্মস্থান ফ্রান্সের অন্তর্গত লিয় নগর। তিনি ভারতে কাউণ্ট লালির অধীনে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। পরে তিনি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সেনাদলে প্রবিষ্ট হন, এবং ক্রমশঃ উন্নতি লাভ করিয়া মেজর জেনারেলের পদ লাভ করেন। এই বিদ্যালয়টি ১৮৩৬ সালের ১লা মার্চ খোলা হয়, এবং জেনারেল মার্টিনের উই- লের অভিপ্রায়ানুসারে ইহার নাম ‘লা’ মার্টিনিয়ার রাখা হয়।

 সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজঃ— ও-ইহার অবস্থিতিস্থান ১০ ও ১১ নং পর্ক স্ট্রীট; যিশুসমাজের (The Society of jesus) লোকেরা ইহা স্থাপন করেন। ১৮৩৪ সালে পোপ ইহাদিগকে কলিকাতায় খৃষ্টধর্মের পক্ষ সমর্থন করিবার নিমিত্ত প্রেরণ করিয়াছিলেন। প্রধানতঃ দুইজন নগরবাসীর বদান্যতা হইতে এই বিদ্যালয়ের উদ্ভব; ইহাদের মধ্যে একজন কলেজের জন্য আপনার বাড়ী ছাড়ি দিয়াছিলেন, এবং অপর ব্যক্তি ইহার ব্যয়নিৰ্বাহার্থ বহু অর্থ দান করিয়াছিলেন। বর্তমান বাড়ীটা প্রথমে একটি থিয়েটারের জন্য নির্মিত হইয়াছিল। ১৮৪৪ সালে পাদরি ক্যারু সাহেব ইহা ক্রয় করিয়া লইয়াছেন। তৎকালে ইহার নাম সেণ্ট জন কলেজ ছিল; পরে বেলজিয়ানের জেটদিগের আগমনাবধি ইহার বর্তমান নাম এবং ইহার কার্যপরিচালনের অধিকতর সুব্যবস্থা হইয়াছে।

 লণ্ডন মিশনারি সোসাইটিজ ইনৃষ্টিটিউসন লণ্ডন মিশনারি সোসাইটি ১৭৯৮ অব্দে এদেশে মিসনবিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তাহাদেরই যত্নে ও অর্থে এই বিদ্যালয়ের উৎপত্তি। ১৮৫৪ সালে ইহা ভবানীপুরে একটা বৃহত্তর ও বিস্তৃতায়তন বাটীতে স্থানান্তরিত হইয়াছে; সেই বাটীতে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর নিমিত্ত ভিন্ন ভিন্ন ঘর, একটি প্রকাণ্ড হল ও একটী সুন্দর লাইব্রেরি আছে।

 জেনারেল এসেমব্লিজ ইনষ্টিটিউসন চর্চ অব স্কটল্যাভুক্ত জেনারেল এসেমব্লি নামক খৃষ্টান সম্প্রদায়ের সবিশেষ যত্নে ও আনু- কূল্যে এই বিদ্যামন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম প্রথম খৃষ্টান মিশনা- রিরা দেশীয় ভাষায় খৃষ্টধর্ম প্রচার করিতেন; কিন্তু পারি ডাক্তার আলেকজাণ্ডার ডফ ১৮৩০ অব্দে এই বিদ্যালয় সংস্থাপন করিয়া ইংরেজী ভাষায় বৃষ্টধর্ম্মের গাঢ় তত্ত্বজ্ঞানপূর্ণ উপদেশ প্রদান করিতে লাগিলেন। প্রথম কতিপয় বৎসর এই স্কুল কয়েকটি ভাড়াটিয়া বাড়ীতে বসিয়াছিল। অবশেষে কর্ণওয়ালিস স্কোয়ারে বর্তমান সুন্দর ভবন নির্দিষ্ট হইলে ১৮৩৮ অব্দে তথায় স্থানান্তরিত হয়। এই বিদ্যালয়ের স্থানটি যে অতি উৎকৃষ্ট, তাহা বলাই বাহুল্য। ১৮৪৪ সালে এতৎসংসৃষ্ট মিশনারিরা ফ্রি-চর্চ নামক সম্প্রদায়ের সহিত মিলিত হওয়ায় কিছুদিনের জন্য এই বিদ্যালয়ের কার্য্য স্থগিত ছিল। পরে ১৮৪৬ অব্দে চর্চ্চ অব স্কটল্যাণ্ড পাদরি ডাক্তার অগিলভির অধ্যক্ষতাধীনে ইহার কার্য পুনরারম্ভ করেন। ইহাতে দুইটি বিভাগ আছে—স্কুল বিভাগ ও কলেজ বিভাগ।

 ফ্রিচাৰ্চ ইনষ্টিটিউশন ও ডফ কলেজ স্কটল্যাণ্ডের জেনারেল এসে্মবিলি সম্প্রদায়ভুক্ত পাদরি ডাক্তার আলেকজাণ্ডার ডফের যত্নে ১৮৩৪ সালের বিচ্ছেদের পূর্ব্বে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচ্ছেদ ঘটার পর জেনারেল এসেমব্লিজ ইনষ্টিটিউশন নামক বিদ্যালয় কিছুদিন বন্ধ হয়, এবং ডাক্তার ডফকে ঐ বাড়ী এবং তাহার নিজের বহুমুল্য লাইব্রেরী পরিত্যাগ করিতে হয়। শিক্ষক, ছাত্র, দেশীয় খৃষ্টান, সকলেই ডাক্তার ডফ ও অন্যান্য মিশনরিগণের অনুগমন করিল; কাজেই নিমতলায় একটা ভাড়াটিয়া বাটীতে বিদ্যালয় খোলা হইল। পরে ডফ সাহেব স্কটল্যাণ্ড, ইংল্যাণ্ড ও ভারতবর্ষে চাঁদা তুলিয়া বর্তমান ভবন নির্মাণ করেন। ১৮৫৭ সালে উহার নির্মাণকার্য শেষ হইলে বিদ্যালয় তথায় স্থানান্তরিত হয়। ইহাতেও স্কুল ও কলেজ দুইটি বিভাগ আছে। এতদ্ভিন্ন ডফ সাহেব একটি অনাথাশ্রম, একটি হিন্দু- বালিকা-বিদ্যালয় এবং একটি নর্ম্ম্যাল স্কুল স্থাপিত করেন।

 ডাক্তার ডফ প্রথমতঃ ২২ নং মির্জাপুর স্ট্রীটে থাকিতেন, পরে ২ নং কর্ণওয়ালিস স্কোয়ারে বাস করেন। প্রথম বাসভবনে তিনি খৃষ্টধর্মের প্রত্যক্ষ প্রমাণ সম্বন্ধে লেকচার (উপদেশ) দিতেন; তাহারই ফলে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (সুপ্রসিদ্ধ ডাক্তার কে, এম, বানার্জি। খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হন।

 বিশপস্ কলেজ —খৃষ্টীয় সুসমাচার-প্রচার-সমাজের (The Society for the Propagation of the Gospel) সোৎসাহ সহযোগিতায় বিশপ মিডলটন ১৮২০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর এই বিদ্যালয়ের ভিত্তিস্থাপন করেন। খৃষ্টধর্ম প্রচার ও সাধারণ শিক্ষার প্রসার, বাইবেল ও অন্যান্য ধর্ম্মগ্রন্থের অনুবাদ, এবং খৃষ্টান মিশনরিরা ভারতে প্রথম আগত হইলে তাহাদিকে বাসস্থান প্রদান, এই কয়েকটি উদ্দেশ্যেই ইহার প্রতিষ্ঠা। এই কলেজের সহিত সংসৃষ্ট একটি ছাত্রাবাস ছিল, এবং কয়েকটি বৃত্তিও নির্ধারিত হইয়াছিল— ঐ সকল বৃত্তিধারী ছাত্রের। বিনা ব্যয়ে আহার্য্য ও শিক্ষা প্রাপ্ত হইত। এই কলেজ পূর্ব্বে বর্তমান শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বাড়ীতে অবস্থিত ছিল। তথা হইতে ২৩৩ নং সার্কুলার রোডে স্থানান্তরিত হয়, এবং পরে আবার তথা হইতে ২২৪ নং লোয়ার সাকুলার রোডে স্থানান্তরিত হইয়াছে।

 উল্লিখিত সংক্ষিপ্ত বিবরণ হইতে যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতে কলিকাতাবাসীদিগের স্কন্ধে বিদ্যাশিক্ষার প্রতি ঔদাসীন্য ও উপেক্ষাপ্রদর্শন দোষের আবোপ করিতে পারা যায় না। বরং ইহাই বাধ হয় যে, সেকালে তাঁহারা ভবিষ্যৎ বংশের মানসিক ও নৈতিক শিক্ষার উন্নতিসাধনে প্রগাঢ় যত্ন ও অনুরাগ প্রদর্শন করিয়া- ছেন, এবং গবর্ণমেণ্ট ও অন্যান্য রাজপুরুষেরাও আপনাদের দায়িত্ব স্বীকার করিয়া তদনুরূপ কার্য করিতে পশ্চাৎপদ হন নাই। উদারচেতা ওয়ারেন হেষ্টিংস ১৭৮০ সালে ইউরোপীয় আদর্শে কলি- কাতা মাদ্রাসা স্থাপন করিয়া দেশের একটী মহা অভাব দূর করেন। আরবী ও পারসী ভাষায় শিক্ষাপ্রদানের উদ্দেশ্যে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, কারণ তৎকালে ঐ দুই ভাষাই আদালতের প্রচলিত ভাষা ছিল। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ে মহারাজ নব- কৃষ্ণ বাহাদুর এককালীন ৩,০০,০০০ টাকা দান করিয়া আপনার বদান্যতার পরিচয় প্রদান করেন। ওয়ারেন হেষ্টিংস হিন্দু পণ্ডিত গণের প্রতিও অনুগ্রহ বিস্তারে কুণ্ঠিত হন নাই। প্রায় এই সময়ে তাঁহারই উৎসাহে আনুকূল্যে হিন্দু ও মুসলমান গ্রন্থসমূহের অনুবাদ আরব্ধ হয়। তাঁহারই আগ্রহে ও যত্নে এসিয়াটিক সোসাইটি স্থাপিত হয় এবং সার উইলিয়ম জো্নস্ তাহার প্রথম সভাপতি মনোনীত হন। লর্ড টেইনমাউথের মতে, হেষ্টিংস সাহেবের চেষ্টার ফলেই ইউরোপীয়ের প্রাচ্য ভাষাসমূহ শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন। ইংরেজ রাজপুরুষদিগের দেশীয় ভাষা শিক্ষার নিমিত্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সংস্থাপিত হয়। মাকুইস অব হেষ্টিংস মহোদয়ও সাধারণ শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনীয়তা বিশিষ্টরূপে হৃদয়- জম করিয়াছিলেন; কারণ তিনি কলিকাতার আদালতের বিচারকার্য্য সম্বন্ধে ১৮১৫ সালের ২রা অক্টোবর তারিখে যে মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন, তাহাতে এইরূপ মর্ম্মে লিখিছেন:—“এই সকল অনিষ্টের প্রতিবিধানের পথ দেখিতে হইলে, দেশীয়দিগের মানসিক ও নৈতিক উন্নতিসাধনই অতীব প্রয়োজনীয় বিষয় হইয়া দাঁড়ায়; সেই জন্যই আমি সাধারণ-শিক্ষারূপ গুরুতর বিষয়ের প্রতি ঔৎসুক্য- সহকারে মনোনিবেশ করিতে ত্রুটি করি নাই।”

 লর্ড হেষ্টিংস একটী উচ্চশ্রেণীর সংস্কৃত বিদ্যালয় সংস্থাপনেও অভিলাষী হইয়াছিলেন, কিন্তু সে ইচ্ছা কার্যে পরিণত করিতে পারেন নাই। তাঁহার উত্তরাধিকারী লর্ড আমহাষ্ট্রের শাসনকালে ১৮২৪ অব্দে কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়; তৎকালে ইহার আয় বাষিক ৩০,০০০ টাকা ছিল। ইহার পুর্বে ১৭৯১ সালে কাশীর সংস্কৃত কলেজ এবং ১৮২৩ সালে আগ্রা কলেজ স্থাপিত হইয়াছিল। লর্ড হার্ডিঞ্জও শিক্ষাবিস্তারে, বিশেষতঃ দেশীয় ভাষার শিক্ষাবিস্তারে, সাতিশয় যত্নশীল ছিলেন। শিক্ষাসম্বন্ধীয় আলোচনা করিবার সময়ে এক ব্যক্তি লিখিয়াছেন যে হুগলি নগ- রেই ইংরাজী শিক্ষার প্রথম বীজ উপ্ত হইয়াছিল। রবার্ট মে নামক চুঁচুড়াবাসী একজন পাদরি, নিজ বাসভবনে ১৮১৪ সালের জুলাই মাসে ১৬টি বালক লইয়া একটি স্কুল খুলিয়া বসেন। পরে গবর্নমেণ্ট উহার সাহায্যার্থ অগ্রসর হইয়া মাসিক ৬০০ টাকা পর্যন্ত দিতেন। বদান্যবর বর্ধমানাধিপতি মহারাজাধিরাজ তেজচাঁদ বাহাদুরও এদেশে ইংরেজী শিক্ষার বিস্তারে সাতিশয় যত্নপ্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন।

 দেশীয় ভাষার শিক্ষাবিস্তারে খৃষ্টান মিশনরিদিগের চেষ্টা সৰ্বা- পেক্ষা অধিক প্রশংসার যোগ্য। কর্তৃপক্ষের নিকট কোনরূপ উৎ সাহ না পাইয়াও এবং কোম্পানি কর্তৃক নির্ধাসিত হইবার ভয়- সত্বেও তাহারা কেবল যে দেশীয়দিগকে খৃষ্টান করিবার কার্যে সোৎসাহে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন তাহা নহে, প্রত্যুত ইউরোপীয়দিগের মধ্যে তাহরিয়ার্বিপ্রথমে দেশীয় ভাষা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন। সার উইলিয়ম হণ্টার লিখিয়াছেনঃ— ১৮১০ খৃষ্টাব্দের সমকালে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিষ্ট মিশনরিরা বাঙ্গালাকে গদ্য সাধু- ভাষার শ্রেণীতে উন্নীত করেন। শিক্ষা বিষয়ে মিগনবিদিগের স্বত্ব অধুনা গবর্ণমেণ্টের ক্রিয়াশীলতায় অপেক্ষাকৃত মন্দীভূত বলিয়া প্রতীয়মান হইলেও প্রকৃতপক্ষে আজিও সম্পূর্ণ নিরস্ত হয় নাই; সেকালে শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁহাদের দুইটি স্বতন্ত্রভাব ছিল;—জন- সাধারণের নিকট ধর্মপ্রচার ও বাইবেলের অনুবাদ করিবার নিমিত্ত তাঁহারা নিজে দেশীয় ভাষা শিক্ষা করিতেন এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান প্রচারিত করিবার প্রণালীস্বরূপ ইংরাজী ভাষা শিক্ষা দিতেন।

 কথিত আছে যে, ১৮১৭ সালের পূর্বে ডেভিড 'হেয়ার রাজ সার রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের সহিত মিলিত হইয়। বাঙ্গালা বিদ্যা- লয়সমূহের উন্নতিবিধানার্থ অনেক সময় নিয়োজিত করিতেন। হেয়ার সাহেবের বঙ্গবিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্র তাঁহার যত্ন সম্বন্ধে এইরূপ লিখিয়াছেন:—

 “হেয়ার সাহেব শিক্ষা বিষয়ে মনোযোগী হইয়া প্রথমে বাঙ্গালা- শিক্ষার উৎসাহদানে সচেষ্ট হইয়াছিলেন। তৎকালে দেশে যে বহুসংখ্যক গুরুমহাশয়ের পাঠশালা ছিল, তাহাতে তিনি নানাপ্রকা- রের অনেক ত্রুটি দেখিতে পান, এবং পরিদর্শক পণ্ডিত নিযুক্ত করিয়া ও মুদ্রিত পুস্তক বিতরণ করিয়া সেই সকল ত্রুটির সংশোধন করিতে চেষ্টা করিতেন। রাজা সার রাধাকান্ত বাহাদুরের বাগান- বাতে সময়ে সময়ে ছাত্রদিগকে পরীক্ষা করা হইত এবং তাহা দিগকে ‘প্রাইজ দেওয়া হইত। তৎপরে তিনি স্কুল সোসাইটীর প্রত্যক্ষ অধীনে একপ্রকার আদর্শ বঙ্গবিদ্যালয় হইয়া দাঁড়ায়। এই বিদ্যালয়টি বেশ জাকিয়া উঠিয়াছিল এবং ইহার ছাত্র সংখ্যাও প্রায় ২০০ শত হইয়াছিল। ইহার ন্যায় ভাল বাঙ্গালা স্কুল তৎকালে আর ছিল না। ছাত্রদিগের নিয়মিত উপস্থিতি বিষয়ে উৎসাহ দিবার নিমিত্ত তাহাদিগকে নগদ অর্থ পুরস্কার দেওয়া হইত। মাসের মধ্যে যারা একদিনও অনুপস্থিত না থাকিত, তাহারা প্রতি মাসে॥০ আট আনা করিয়া পাইত, যাহারা কেবল একদিন মাত্র অনুপস্থিত থাকিত, তাহারা।৺ আনা করিয়া পাইত, যাহারা দুইদিন অনুপস্থিত থাকিত, তাহারা।• আনা পাইত; আর যাহারা দুইদিনের অধিক অনুপস্থিত থাকিত, তাহারা কিছুই পাইত না। বঙ্গবিদ্যালয়সমূহের উৎকৃষ্ট ছাত্রেরা হিন্দুকলেজে প্রেরিত হইত, তথায় সোসাইটি ৩০ টি ছাত্রের ব্যয়ভার বহন করিতেন। কিছুদিন পরে উক্ত আদর্শ বঙ্গ- বিদ্যালয়ের সন্নিধানে একটি ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়া- ছিল। আদর্শ বঙ্গবিদ্যালয়ের বাছা বাছা ছাত্রেরা ইংরেজী শ্রেণীতেও পড়িতে পাইত। পাইবার ব্যবস্থা এইরূপ হইয়াছি সূর্যোদয় হইতে পূৰ্বাহ ১টা পর্যন্ত বাঙ্গালা; পূর্ব্বাহ্ন ১০॥০টা হইতে ১২॥০টা পর্যন্ত ইংরেজী; আর অপরাহ্ন ৩॥০টা হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুনর্বার বাঙ্গালা।

 ১৮৩৮ অব্দে আডাম সাহেব গবর্ণমেণ্ট-প্রদত্ত তিন লক্ষ টাকা ব্যয়ে বঙ্গ ও বিহারের দেশীয় ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা সম্বন্ধে তাঁহার লিখিত রিপোর্ট মুদ্রিত করেন। এই রিপোর্ট আলোচনা করিলে শিক্ষাবিষয়ে মিশনরি সম্প্রদায় ও বেসরকারি ব্যক্তিবর্গ কিরূপ যত্ন চেষ্টা করিয়াছেন এবং গবর্ণমেণ্টই বা স্বীয় কর্তব্য কিরূপ পালন করিয়াছেন, তাহা সুস্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। লর্ড ডালহাউসি এবং হ্যালিডে সাহেব দেশীয় ভাষার শিক্ষার বিস্তারকল্পে এত চেষ্টা করিয়াছিলেন। পরন্তু লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্কের শাসনকাল বিদ্যালয়ে ইংরেজী শিক্ষা বিষয়ে উৎসাহ দান ও তাহার প্রসারের নিমিত্ত প্রসিদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। তাহার শাসনকালে ১৮৩৩ অব্দে ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানি যে নুতন সনদ প্রাপ্ত হন, তাহাতে গভর্ণর জেনারেলের কাউন্সিলে একজন ল-মেম্বার (ব্যবস্থা-সভ্য) নিয়োগের নিয়ম হয়, এবং ব্যবস্থা হয় যে, কোম্পানির কর্মচারী না হইলেও যে কোনও ব্যক্তি ঐ পদ পাইতে পারিবেন। তদনুসারে টমাস ব্যাবিং উন মেকলে (পরে লর্ড মেকলে) প্রথম ল-মেম্বার নিযুক্ত হন। সেই সময়ে, এতদ্দেশে ইংরেজী শিক্ষায় বা দেশীয় শিক্ষায় গবর্ণমেণ্ট সাহায্য ও উৎসাহ দান করিবেন এই বিষয়ে মতভেদ উপস্থিত হইয়া তুমুল আন্দোলন চলিতেছিল। মেকলের আগমনে ইংরেজী শিক্ষাবর্তনের পক্ষপাতীরা একজন অমুল্য সহায় পাই- লেন। তাঁহার ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তারিখের 'মিনিট' প্রাচ্য-শিক্ষার পক্ষপাতীদিগের বিরুদ্ধে প্রবল যুক্তিপূর্ণ প্রতিপক্ষরূপে উপস্থিত হইল। মেকলে সাহেব আপনার মন্তব্যের উপসংহারে যে অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছেন, তাহার মর্মার্থ এইরূপঃ—

 “আমার বোধ হয়, ইহা, স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, ১৮১৩ অব্দের পার্লেমেণ্টের আইন আমাদের হস্তপদ শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখে নাই; স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হউক বা ভাবধারা অনুমেয়ই হউক, কোনও প্রকার প্রতিজ্ঞাও আমরা শৃঙ্খলাবদ্ধ নহি। আমাদের ভণ্ডের টাকা আমরা ইচ্ছানুরূপ নিয়োজিত করিতে পারি; সর্ব্বা পেক্ষা যাহা জানিবার অধিক উপযুক্ত, তাহার শিক্ষাদানেই সে অর্থ নিয়োজিত করা আমাদের উচিত। সংস্কৃত বা আরবী অপেক্ষা ইংরেজীই জানিবার অধিক উপযুক্ত; এতদ্দেশীয় লোকেও ইংরেজী শিখিতে চায়; সংস্কৃত বা আরবী শিখিতে চায় না। আইনের ভাষা বলিয়াই বা কি, আর ধর্মের ভাষা বলিয়াই বা কি, সংস্কৃত বা আরবী আমাদের উৎসাহ লাভের কোনও বিশেষ স্বত্বের অধিকারী নয়; এদেশীয়দিগকে ইংরেজী বিদ্যায় যৎপরোনাপ্তি সুপণ্ডিত কর সম্ভবপর, অতএব সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের যত্ন করা কর্তব্য।”[৬]

 লর্ড হালিফাক্সের প্রেরিত ডোস্প্যাচ (আদেশ-পত্র) অবলম্বন করিয়া বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্তিত হইয়াছে। লর্ড ডালহাউসির শাসনকালে পুরান হিন্দুকলেজ বর্তমান প্রসিডেন্সি কলেজে পরি- বর্তিত হইয়াছে। তদবধি নীতিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, তর্কশাস্ত, প্রাকৃতিক জ্ঞান প্রভৃতি পাঠরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছে। ১৮৫৭ সালে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরীক্ষক সমাজ ব্যতীত আর কিছুই নহে; তবে সাধারণ সাহিত্য, আইন, চিকিৎসা, ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উপাধি-প্রদানের অধিকার ইহার আছে। একজন চ্যান- সেলর (সভাপতি), একজন ভাইস-চ্যানসেলর (সহ-সভাপতি) ও একটি সেনেট (সদস্য-সমাজ) লইয়া ইহা গঠিত। ইহার কর্ম্ম- পরিচালনার ভার সিণ্ডিকেট নামক সভার উপর অর্পিত; তাহাতে ভাইস চ্যান্সেলর ও বিভিন্ন ফ্যাকালটি কর্তৃক নির্বাচিত কয়েকজন সেনে্টের সভ্য আছেন। ১৮৫৪ অব্দের প্রবর্তিত প্রণালীর পূর্ণতা সাধনের উপায়নিৰ্দ্ধারণার্থ লর্ড রিপণ ১৮৮২-৮৩ অব্দে একটি শিক্ষা কমিশন’ নিযুক্ত করেন। উক্ত কমিশনের সভাপতি স্বনামখ্যাত সার উইলিয়ম হণ্টার আপনার রিপোর্টের একস্থলে এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেনঃ—

 “শ্রী-শিক্ষা এবং সমাজের মুসলমান প্রভৃতি কতিপয় অনুন্নত শ্রেণীর বিদ্যাশিক্ষায় বিশিষ্টরূপ মনোযোগ দেওয়া হইয়াছে। কমি- শনের অনুরোধসমূহের স্কুল কথা এই যে, গবর্ণমেণ্টের সাধারণ শিক্ষাবিভাগটিকে উন্নত করিয়া ভারতের প্রকৃত জাতীয় শিক্ষা এরূপ প্রণালীতে পরিণত করা আবশ্যক, যেন প্রজারা নিজেই অধিকতর পরিমাণে তাহার পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করিতে পারে।”

 ভূতপুর্ব রাজপ্রতিনিধি লর্ড কর্জ্জনের শাসনকালে অপেক্ষকৃত বিস্তৃতভাবে একটি 'শিক্ষা কমিশন' নিযুক্ত হইয়াছিল। কমিশন- রে্রা বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরিয়া বেড়াইয়া অভিজ্ঞ শিক্ষাব্যবসায়ী ও অন্যান্য প্রধান ব্যক্তিদিগের সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রচলিত শিক্ষাপ্রণালী সূক্ষানুসূক্ষ্ণরূপে পরীক্ষা করিয়া তাহার ত্রুটি ও অভাবসমূহের নির্ধারণ এবং তৎপ্রতিকারের পন্থা নির্দেশ করাই এই কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল। যাহারা গবর্ণমেণ্টের শিক্ষানীতির বিস্তৃত বিবরণ জানিতে ইচ্ছা করেন, আমাদের অনুরোধ, তাহারা ভারত-বর্ণমেণ্টের হোম ডিপার্টমেণ্ট হইতে ১৯০৪ সালের মার্চ মাসে প্রচারিত রিজোলিউশন পাঠ করুন।

 বর্তমান সময়ে কলিকাতায় খাস গবর্ণমেণ্টের, মিশনারি সম্প্র- দায়সমুহের এবং বেসরকারী ভদ্রলোকদিগের অনেকগুলি প্রথম শ্রেণীর কলেজ আছে। ইহাদের মধ্যে কয়েকটি কলেজের কথা ইতঃপূর্বেই বলা হইয়াছে। দেশীয়দিগের প্রথম শ্রেণীর কলেজ- গুলির মধ্যে পরলোকগত পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত মেট্রপলিটান্ ইনষ্টিটিউশন ১৮৭৯ সালে, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠিত সিটি কলেজ ১৮৮১ সালে, বাবু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপধ্যায়ের এতিষ্ঠিত রিপন কলেজ ১৮৮৪ সালে, ও বাবু খুদিরাম বসুর প্রতিষ্ঠিত সেণ্ট্রাল কলেজ ১৮১৬ সালে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। তভিন্ন বঙ্গবাসী কলেজ প্রথমে ১৮৮৭ সালে বিতীয় শ্রেণীর কলেজরূপে এবং ১৮৯৬ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজ- রূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে।

 স্থলে প্রাতঃস্মরণীয় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। তাঁহার পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যো- পাধ্যায়, বর্তমান মেদিনীপুর (তদানীন্তন হুগলি জেলার অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ খৃষ্টাব্দে তাহার জন্ম হয়। ১৮২৯ সালের ১লা জুন তারিখে তিনি সংস্কৃত কলেজে প্রবিষ্ট হইয়া ১৮৪১ অব্দ পর্যন্ত তথায় অধ্যয়ন করিয়া বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি ১৮৪১-৪২ অব্দ হইতে ১৮৫৮ অব্দ পর্যন্ত মাসিক ৫০ টাকা হইতে আরম্ভ করিয়া, মাসিক ৫০০ টাকা পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন বেতনে ভিন্ন ভিন্ন পদে,—যথা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের হেড, পণ্ডিত ও হেড, রাইটার রূপে, সংস্কৃত কলেজের প্রথম অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষরূপে, এবং অবশেষে বর্ধমান, নদীয়া, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলার বিদ্যালয়সমূহের ইনস্পেক্টররূপে-গবর্ণমেণ্টের চাকুরিতে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৯১ সালের জুলাই মাসে তিনি ইহলোেক পরিত্যাগ করেন। তাহার সম্বন্ধে জনৈক লেখক যথার্থই লিখিয়াছেন—“সংস্কৃত কলেজের বর্তমান সুযোগ্য অধ্যক্ষ বেকন ও বপের ভাবে অনুপ্রাণিত ঈশ্বরচন্দ্রের যত্বে ইহা আর কেবল সংস্কৃত ভাষায় মানসিক শিক্ষার স্থান নহে, অধিকন্তু ভাষাবিজ্ঞান অনুশীলনের প্রধান স্থান, ভাঙ্গালা ভাষার রাজ- বিদ্যালয়, বিশুদ্ধ ভাষার উৎপত্তিস্থল, এবং সুক্ষ ভাষাতত্ত্ব- শিক্ষকের শিক্ষার বিদ্যালয়রূপে পরিণত হইয়াছে। তাঁহার যত্নে সংস্কৃত আর পুর্বের ন্যায় কেবল ব্রাহ্মণগণের কুসংস্কারের অস্ত্রস্বরূপ নাই, জনসাধারণের ভাষা সুমার্জিত হইয়া উন্নত হইয়া উঠিয়াছে। তর্ক-শাস্ত্রকে জনপ্রিয় করিবার নিমিত্ত হোয়েটলি যাহা করিয়াছেন, দর্শনশাস্ত্রকে জনপ্রিয় করিবার নিমিত্ত সক্রেটিস যাহা করিয়াছেন, সংস্কৃত ব্যাকরণের অধ্যয়নকে সহজসাধ্য করিবার নিমিত্ত ঈশ্বরচন্দ্র তাহাই করিয়াছেন; যে শাস্ত্রের অধ্যয়ন এতকাল নিতান্ত কঠিন ও নীরস ছিল, তাহাকে তিনি গ্রীকের স্যায় সহজ করিয়াছেন। তাঁহার কৃত ব্যাকরণ ও সরল সংস্কৃত গ্রন্থ বহু ইংরেজী বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্ধারিত হইয়াছে; ঐ সকল স্কুল ছাত্রেরা তাঁহার উদ্ভাবিত প্রবালীতে বাঙ্গালা সাধুভাষা শিক্ষা করে; এতদ্বারা অধ্যাপক উইলসনের সেই উক্তি সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে যে, দেশীদিগকে তিন চারি বৎসরে সংস্কৃত শিখান যাইতে পারে। পূর্বে বালকগণ চারি পাঁচ বৎসর সংস্কৃত ব্যাকরণ অধ্যয়নে নিযুক্ত থাকিয়াও ঐ শাস্ত্রে কয়েকটি সরল সূত্রের অধিক অগ্রসর হইতে পারিত না, কিন্তু এক্ষণে সেই স্কুলে তিন মাস শব্দরূপ ও ধাতুরূপ পড়িয়া তাহার সহজ সহজ সংস্কৃত বাক্য পড়িতে আরম্ভ করে, এবং, তংপরে সাধারণ সাহিত্য ও কাব্য অধ্যয়ন করিয়া আপনাদের মনকে উন্নত করে। ঈশ্বরচত্রের উন্নতপ্রণালীর বিষয় সবিশেষ অবগত হইতে হইলে সাধারণ-শিক্ষা-কমিটীর ১৮৫২ সালের রিপোর্ট পাঠ করা আবশ্যক। তাহার কৃত প্রথম শিক্ষার সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্যপাঠ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ ছাত্রগণকে বাঙ্গালা ভাষায় বিশেষ বাগ-বিন্যাস-প্রণালী ও শব্দের ব্যুৎপত্তি বিষয়ে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞ করিবার ও পারিভাষিক শব্দসমুহে তাহাদের বিশিষ্ট জ্ঞান জন্মাইবার প্রকৃষ্ট উপায় বলিয়া সেগুলি কলিকাতার প্রধান প্রধান মিশনরি বিদ্যালয়ে ও মফস্বলের অনেক স্কুলে পাঠ্যপুস্তক রূপে প্রচলিত হইয়াছে। দেশীয়েরা স্বয়ংই এক্ষণে মুগ্ধবোধকে ক্রমশঃ সরাইয়া দিতেছে। যে ডাক্তার ব্যালাণ্টাইন বেকনকে কাশীর পণ্ডিতমণ্ডলীর সুবোধ্য করিয়াছেন, তাঁহার নামের সহিত এবং সেহোরের উইলকিনসনের নামের সহিত ঈশ্বরের নামও ভবিষ্যবংশীয়দিগের নিকট চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে।”

 এই পূজনীয় পণ্ডিতের পাদমূলে বসিয়া তাহার জীবনচরিত পর্যালোচনা করিলে সুস্পষ্টরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারা যায় যে, “সাধু মানবই ঈশ্বরের উচ্চতম সৃষ্টি এই মহাৰাক্যের সত্যতা ঈশ্ব- রের জীবনে যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, তেমন বুঝি আর কাহারও জীবনে হয় নাই। ইনি দরিদ্রের গৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু দেশের উচ্চতম জাতির ঘরে জন্মিয়াছিলেন; এবং ইনি যে শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, সে শ্রেণীর লোকে ‘সামান্য জীবনযাপন ও উচ্চচিন্তার মহান আদর্শ প্রকৃত জীবনে প্রদর্শন করিয়া থাকেন। এই জন্যই আমরা দেখিতে পাই, ঈশ্বরচন্দ্র আপনার বিদ্যা বুদ্ধি উৎসাহ উদ্যম, অর্থ ক্ষমতা, এমন কি জীবন পর্যন্ত, সমস্তই মানব- জাতির হিতার্থে উৎসর্গ করিতে পারিয়াছিলেন। হিন্দু তিনি বাল- বিধবদের পুনর্বিবাহের যে আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহা- তেই তাহার পরদুঃখকাতরতার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁহার আর একটা বিশেষ গুণ ছিল এই যে, যাহা তিনি করিতেন, তাহা সর্বান্তঃকরণের সহিতই করিতেন। তাঁহার পরোপকারের কথা আর কি বলিব? সুপ্রসিদ্ধ লেখক এন, এন ঘোষ যথার্থই বলিয়াছেন যে, “যখন বিদ্যাসাগর মরিলেন, তখন বদান্যতা-দেবী আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন।” সর্বপ্রকার কপটতা ও কৃত্রিমতা তিনি অন্তরের সহিত ঘৃণা করিতেন। সাংসারিক শ্রীবৃদ্ধির নিমিত্ত তিনি বিবেকবুদ্ধিকে কখন জলাঞ্জলি দেন নাই, বিদ্যালয়সমূহের সংস্থাপনে, বিশেষতঃ মেট্রপলিটান কলেজের প্রতিষ্ঠায়, তিনি যেরূপ আয়াস স্বীকার করিয়াছিলেন, তাহা অতীব প্রশংসার বিষয়; কারণ তখন সকলেই মনে করিয়াছিল, বাঙ্গালীর এ চেষ্টা নিশ্চয়ই বিফল হইবে। এরূপ অবস্থায় তিনি একাকী, বাহিরের বিন্দুমাত্র সাহায্য না লইয়া, কেবল দেশীয় শিক্ষক দ্বারা যেরূপ উৎকৃষ্টভাবে বিদ্যালয়ের কার্য্য পরিচালনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা যৎপরো নাস্তি বিস্ময়জনক।

 পূর্বেই বলা হইয়াছে, লর্ড আমহার্ষ্ট ১৮২৪ অব্দে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন। সে সময়ে উহার কার্যপরিচালনার্থ একটি কমিটি নিযুক্ত হইয়াছিল। ছাত্রদিগের জন্য কতকগুলি মাসিক বৃত্তিও নির্ধারিত হইয়াছিল। পূর্বে কেবল ব্রাহ্মণ ছাত্রেরাই ঐ সকল বৃত্তি পাইত, এবং কেবল ব্রাহ্মণ বালকেরাই কলেজে পড়িতে পাইত। সে নিয়ম আর নাই, এক্ষণে সকল জাতীয় হিন্দু বালকই সংস্কৃত কলেজে পড়িতে পারে। সে কালে সংস্কৃত কলেজেই একটি ডাক্তারী শিক্ষার বিভাগ ও তাহার সহিত সংসৃষ্ট একটি শবব্যবচ্ছেদে শ্রেণী ছিল, কিন্তু শিক্ষকগণের অযোগ্যতায় তাহা উঠিয়া যায়। এই কলেজে একটি উৎকৃষ্ট সংস্কৃত পুস্তকালয় আছে।

 ১৮১৭ সালে কলিকাতা স্কুলবুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালে নিম্নলিখিত মর্ম্মের এক একখানি পত্র অনেকে ভদ্র লোকের নিকট প্রেরিত হইয়াছিল।

শ্রীযুক্ত গোপীমোহন দেব।
মহাশয় সমীপেষু।
কলিকাতা, ৭ই মে ১৮১৭।


প্রিয় মহাশয়,

 যথোপযুক্ত পুস্তক সংগ্রহ করিয়া দিয়া স্কুলের বিদ্যাশিক্ষার উৎকর্ষসাধনার্থ বেলি সাহেবের যত্নে ও অনুগ্রহে একটী সভার অধিবেশন হইবে, ঐ সভায় আপনার পুত্র যাহাতে উপস্থিত হন, এজন্য আপনার অনুমতি প্রার্থনা করিবার নিমিত্ত আমি আগামী কল্য আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে ইচ্ছা করি। আশা করি, আমাদের সকলের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার উন্নতিসাধনই যখন ইহার উদ্দেশ্য; তখন হিন্দু, মুসলমান ও ইংরাজ ভদ্রলোক মাত্রেরই ইহা তুশ্যরূপে বাঞ্ছনীয় হইবে এবং সকলেই ইহার সফলতার জন্য যত্ন- শীল হইবেন। আগামী মঙ্গলবারের সভাস সাধারণ রিজোলিউশন- গুলি স্থির করিবার নিমিত্ত কেবল আনুষ্ঠানিক মাত্র হইবে, দেশীয় ভদ্রলোকেরা যাহাতে রিজোলিউশনগুলি উত্তমরূপে বুঝিতে পারেন, এজন্য সেগুলিকে বাঙ্গলা ও পারসী ভাষায় অনুবাদ করিতে যা হইয়াছে; সেগুলি কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হইলে পর সাধারণ্যে প্রচার করা হইবে, এবং সর্বশ্রেণীর হিতৈষী মহোদয়গণের নিকট অর্থসাহায্য সংগ্রহ করিবার নিমিত্ত চাঁদার বহি খোলা হইবে। চাঁদার হার অধিক উচ্চ হইবে না, সুতরাং সে বিষয়ে আমাদের বন্ধুবান্ধবগণের ভয় পাইবার কোনও কারণ নাই। আমি আশা করি, আপনি নিজে এবং আমাদের যে সকল বন্ধুবান্ধবগণের নিকট এই প্রসঙ্গ উপস্থিত করিব, সকলেই এই উদ্দেশ্যটীকে আপনাদের অনুমোদন ও সমর্থনের ষোগ্য বিবেচনা করিবেন, কারণ ইহা সুপ্রসিদ্ধ হইলে আমাদিগকে ভাল ভাল পুস্তক সংগ্রহ করিয়া দিবার বিষয়ে আমাদের নিজ কলেজের পক্ষে অত্যন্ত হিতকর হইবে।

আপনার বিশ্বস্ত
(স্বাক্ষর) ঈ, এইচ,ঈষ্ট।

 ১৮২১ খৃষ্টাব্দের মে মাসে এই সোসাইটি গবর্ণমেণ্ট হইতে সাহায্যম্বরূপ এককালীন ৭০০০ টাকা এবং মাসিক ৫০০ টাকা চাদার অঙ্গীকার প্রাপ্ত হয়; এবং গর্ণমেণ্ট ইহাও স্বীকার করেন যে, যতকাল ইহার কাজ কর্ম সুবিবেচনায় সহিত পরিচালিত হইবে, ততকাল এই চাঁদা প্রদত্ত হইবে। এই সোসাইটি বাঙ্গালা ভাষায় ভূ-বৃত্তান্ত প্রাণ-বৃত্তান্ত প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ে বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করিয়া বাঙ্গালা শিক্ষার বিলক্ষণ সহায়তা করিয়াছে।

 ১৮৮১ সালে মার্কুইস অব হেষ্টিংস মহোদয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় কলিকাতা স্কুল সোসাইটি (বিদ্যালয়-সমিতি) প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালে বর্তমান বঙ্গ-বিদ্যালয়গুলির সাহায্য করিবার নূতন নূতন বঙ্গ-বিদ্যালয় স্থাপন করিবার, এবং মেধাবী ছাত্রগণকে শিক্ষক ও অনুযাজক হইবার উপযুক্ত করিয়া প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যেই উহার প্রতিষ্ঠা। ১৮২১ সালে ইহার তত্ত্বাবধানাধীনে ১১৫টা বঙ্গ-বিদ্যালয় এবং ৩,৮২৮ জন ছাত্র ছিল। ১৮২৩ সালে ইহা গবর্নমেণ্ট হইতে মাসিক ৫০০ টাকা সাহায্য পাইত। ডেভিড হেয়ার ইহার ইউরোপীয় সম্পাদক এবং রাজা সার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর ইহার দেশীয় সম্পাদক ছিলেন। সার আণ্টনি ব্টলার, জে, ব্যারিংটন প্রভৃতি মহাপুরুষেরা ইহার প্রতি বিলক্ষণ সহানুভূতি ও যন্ত্র প্রকাশ করতেন।

 বিদ্যালয় ও শিক্ষাসমাজ সম্বন্ধীয় এই প্রসঙ্গে স্ত্রী-শিক্ষাবিষয়ে যে সকল মহাত্মা আয়াস স্বীকার করিয়া গিয়াছেন, তাহাদের সম্বন্ধেও কিঞ্চিৎ বলা আবশ্যক; নচেৎ এই সংক্ষিপ্ত ও অসম্পূর্ণ বিবরণ আরও অসম্পূর্ণ রহিয়া যাইবে। কথিত আছে যে, মিসেস (বিবি) পিট নামী একা ইউরোপীয় মহিলাই এই কার্যে সর্ব্ব- প্রথম অগ্রসর হন।[৭] মিসিস্ ডুয়েলের বালিকাবিদ্যালয় সে সময়ে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। পাদরী লসন সাহেবের স্ত্রীবিদ্যালয়ও বেশ ভাল অবস্থাপন্ন ছিল; তিনি ইংরেজী-রচনার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতেন। তিনি নিজেও সুমিষ্ট কবিতা রচনায় পটু, উত্তম ভাস্কর, চিত্রকর ও সঙ্গীতজ্ঞ বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলেন। মিলিটারী অরফ্যান সোসাইটিও বালিকাদিগকে কার্যকরী শিক্ষা প্রদান করিতে ব্যাপৃত হইয়াছিল। টমসন নামক এক সাহেব গোরা সৈনিকদিগের সন্তানসন্ততির দুরবস্থাদর্শনে দয়ার্দ্রচিত্ত হইয়া সার্কুলার রোডে স্ত্রী-অনাথাশ্রম স্থাপন করে। গবর্নমেণ্ট এই আশ্রমে মাসিক ২০০ টাকা সাহায্য করিতেন। পাদরি হভেণ্ডন সাহেব বালিকাদের শিক্ষার নিমিত্ত এক অনাথ-সমিতি প্রতিষ্ঠিত করেন।

 ১৮১৯ সালে কলিকাতা স্ত্রী-যুব-সমিতি (The Calcutta Female Juvenile Society) প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙ্গালা স্ত্রী- বিদ্যালয়ের সাহায্য করিবার উদ্দেশ্যে ইহার প্রতিষ্ঠা। এই সমিতি প্রথমে ৩২টা ছাত্রী লইয়া একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এক বৎসরের মধ্যে উহাতে আরও ৮টী বালিকা প্রবিষ্ট হয়। পড়া, লেখা, ও সুচিকর্ম এই বিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়া হইত। ১৮২২ সালে এই সমিতি বঙ্গীয় খৃষ্টান স্কুল সোসাইটির সহিত মিলিত হইয়া যায়। উক্ত অব্দে দেশীয় বালিকাদের শিক্ষার নিমিত্ত এক মহিলা-সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। কুমারী কুক পরে মিসেস্ উইলসন) এই সমিতির উন্নতির নিমিত্ত বিস্তর শ্রম স্বীকার করিয়াছিলেন।

 পরলোকগত মাননীয় জে, ঈ, ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (বীটন) বঙ্গদেশে প্রকৃতপ্রস্তাবে স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তন করেন। ১৮৫০ সালের নবেম্বর মাসে বেথুন স্কুল নামে একটী বালিকাবিদ্যালয় কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে স্থাপিত হয়। এই বিদ্যালয়ের সহিত মহিলা অধ্যক্ষ ও ছাত্রীদিগের থাকিবার জন্য একটা বাসভবন সংলগ্ন আছে। বিদ্যালয়টি অধুনা প্রথমশ্রেণীর কলেজরূপে পরিণত হইয়াছে। এখানে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এ, পরীক্ষার পাঠ্য পর্যন্ত পড়ান হইয়া থাকে। রাজা সার রাধাকান্ত দেব বাহাদুরও স্ত্রীশিক্ষার উন্নতিকল্পে যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছিলেন। বেখুন সাহেব তৎসম্বন্ধে বলিয়াছিলেন ঃ—“বালিকাদিগকে একে বারে সম্পূর্ণ মুখ করিয়া রাখা যে নিতান্ত নির্বুদ্ধিতা ও দোষের কার্য্য এবং উহা যে হিন্দুশাস্ত্রের আদিষ্ট বা অনুমোদিত নহে, একথা আধুনিক কালে ভারতবাসীদিগের মধ্যে আপনিই সর্ব- প্রথমে বুঝাইয়া দিয়াছেন। এজন্য আপনি যথার্থ প্রশংসাৰ্হ; আমি এক্ষণে আপনাকে সেই ধন্যবাদ প্রদান করিতে সমুৎসুক হইয়াছি।” রাজা রাধাকান্ত দেবের বংশে স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তার চেষ্টা তাহার নূতন নহে; তাঁহার প্রখ্যাত পূর্বপুরুষেরাও এ বিষয়ে বিলক্ষণ অনুরাগী ছিলেন। পাদরি ওয়ার্ড সাহেব বলিয়া- ছেন যে, রাজা নবকৃষ্ণের পত্নীরা বিদুষী বলিয়া প্রসিদ্ধা ছিলেন।

 আরও অনেক বিখ্যাত ভারতবাসী এ বিষয়ে প্রভূত শ্রম স্বীকার করিয়া বিলক্ষণ আনুকূল্য করিয়া গিয়াছেন। পরলোক গত পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র, বাবু প্যারীচরণ সরকার প্রভৃতি খ্যাতনামা মহাত্মারা স্ত্রী-শিক্ষাবিস্তারের পক্ষপাতী হইয়া বিস্তর সাহায্য করিয়াছেন। মিশনরি সম্প্রদায়- গণও এ বিষয়ে যে সকল মহৎ কার্য্য করিয়াছেন, তাহাও অতীৰ প্রশংসনীয়। তাঁহারা কলিকাতার সর্বত্র ও তন্নিকটবর্তী স্থান- সমূহে হিন্দু অধিবাসীদিগের বাসভবনে যে সকল শিশু ও বালিকাবিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছেন, সেগুলি স্ত্রী-শিক্ষাবিস্তারের প্রধান সাধন। এই সমস্ত স্কুলের শিক্ষাপ্রদান বিষয়ে বিশেষত্ব এই যে, গ্রাম্য চলিত বাংলায় বাইবেলের উপদেশ প্রদত্ত হইত। কয়েক বৎসর হইল, হিন্দু-বালিকাদিগের জাতীয়ভাবে শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে “মহাকালী পাঠশালা” এবং কলিকাতা ও তন্নিকটবর্তী স্থানসমূহে উহার কতকগুলি শাখা-বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছে। নৈতিক ও ধর্মবিষক শিক্ষা দানই এই সমস্ত বিদ্যালয়ের বিশিষ্ট গুণ। মাতাজী মহারাণী তপস্বিনীর অনুগ্রহে এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা; এজন্য তিনি অশেষ ধন্যবাদের পাত্রী। হিন্দু জনসাধারণও এই সদাশয়া পরহিতৈষিণী মহিলার উদ্যোগে সর্বান্তঃকরণে যোগ- দান করিয়াছে, এবং এই বিদ্যালয়ও সমাজের সর্বশ্রেণীর লোকের অতি আদরের সামগ্রী হইয়া উঠিয়াছে। এতদ্ভিন্ন আরও অনেক গুলি স্ত্রী শিক্ষালয় আছে; সে সকলের কথা বলা হয় নাই। এ সম্বন্ধে ব্রাহ্মদিগের আগ্রহ ও যত্ন সবিশেষ প্রশংসনীয়। তদ্ব্যতিরিক্ত ইউরোপীয় বালিকাদের জন্যও কয়েকটি স্কুল ও কলেজ সুন্দররূপে পরিচালিত হইতেছে। মুসলমান-সমাজেও স্ত্রী-শিক্ষা প্রবেশলাভ করিয়াছে; অনেকগুলি মুসলমান-বালিকাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। কাশিমবাজারের মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বাহাদুর একটি মুসলমান-বালিকা-বিদ্যালয়ে প্রচুর অর্থসাহায্য করিয়া আপনার উদারতা প্রকাশ করিয়াছেন।

 পাদরি লঙ সাহেব বলেন, সেকালে ১৭৭০ সালেও পুরাতন কেল্লার ভিতর একটি সাধারণ পুস্তকাল ছিল। ওরিএণ্টাল কমার্স (প্রাচ্য বাণিজ্য) নামক পুস্তকে তৎকালে ইউরোপ হইতে আনীত গ্রন্থাবলীর একটি তালিকা দৃষ্ট হয়, মিষ্টার মণ্ডুরু নামক এক সাহেবের একটি লাইব্রেরি ছিল; অনেকে চাঁদা দিয়া তাহা হইতে পুস্তক বাড়ীতে লইয়া যাইয়া পাঠ করিতেন। সেকালে বৎসরে একমাত্র ইংলণ্ড হইতে পুস্তক আসিত; মুদ্রণব্যয় বর্তমান সময় অপেক্ষা পাঁচ গুণ অধিক ছিল। এসিয়াটিকস নামক এক- খানি ১২ পেজী ১৪২ পৃষ্ঠার পুস্তক ১৮০৩ সালে কলিকাতায় মুদ্রিত হয়; যাহারা উহার মূল্য অগ্রিম দেয় নাই, তাহাদের নিকট উহার এক একখণ্ড পুস্তক ২৪ টাকা মূল্যে বিক্রীত হইয়াছিল। ওলড হরকরা লাইব্রেরি নামক পুস্তকালয় বহু বৎসর চলিয়াছিল।

 কলিকাতা পাবলিক লাইব্রেরী ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। লোকে তথায় বসিয়া পড়িতে পাইত, অথবা ইচ্ছা করিলে পুস্তক বাড়ীতে লইয়া যাইয়াও পড়িতে পাইত। ইহা প্রথমতঃ এস- প্ল্যানেডের উপর ডাক্তার ই, পি, স্ট্রং সাহেবের বাসভবনে বিনা ভাড়ায় স্থাপিত হইয়াছিল। ১৮৪১ সালে ইহা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ বাড়ীতে স্থানান্তরিত হয়। পরে ১৮৪৪ সালে বর্তমান সদাশয় লর্ড মেটকাফের নামানুসারে ইহার নামকরণ হইয়াছে। প্রথম প্রথম ইউরোপীয় ও দেশীয় উভয় সম্প্রদায়ের লোকই ইহার চাঁদা-দাতা ও আজীবন সদস্য ছিলেন। ১৮৯০-৯১ সালে কলি- কাত। মিউনিসিপালিটি ইহাতে অর্থসাহায্য করিতে এবং আজীবন সদস্য সহিত একযোগে ইহার কার্য পরিচালনা করিতে আরম্ভ করেন। ১৯৭৩ সালে ভারত গবর্ণমেণ্টই ইহার সহিত ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি মিলিত করিয়া দিয়াছেন। পরন্তু গবর্নমেণ্ট ইহার সম্পূর্ণ কর্তৃত্বভার গ্রহণ করিবার পূর্বে আজীবন সদস্যগণের সম্মতি গ্রহণ করিয়াছিলেন। এতদ্ভিন্ন সহরের উত্তরাংশে অর্থাৎ দেশীয় অংশেও কতকগুলি পুস্তকালয় ও পাঠাগার দেশীয় ভদ্রলোকদিগের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। তন্মধ্যে বাজার সাধারণ পুস্তকালয় ও পাঠাগার, কম্বুলিয়াটোলা বালকদিগের পাঠাগার, চৈতন্য লাইব্রেরি, কর্ণওয়ালিস স্কোয়ার পুস্তকালয় ও পাঠাগার প্রভৃতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইহাদের প্রথম দুইটি মিলিত হইয়া এক হইয়া গিয়াছে। ইহার সর্বশ্রেণীর নর-নারীকে মান- সিক খাদ্য প্রদান করিতেছে। ইহাদের মধ্যে কোন কোনটীর নিজের বাড়ী আছে। কোন কোনটা ভাড়াটীয়া বাটীতে এবং অপর কয়েকটি ভদ্রলোকের বাসভবনে বিনা ভাড়ায় অবস্থিত। এই সকল লাইব্রেরী দ্বারা সমাজের অনেক হিত সাধন হয়। এই সকল লাইব্রেরীর যত্নে বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়, পুস্তক পুস্তিকা মুদ্রিত হয়, আবার কখন কখন সাময়িক পত্রও প্রচারিত হয়। সাধারণতঃ এই সকল লাইব্রেরী রাজনীতির ধার ধারে না। বহু পদস্থ ইউ- রোপীয় ও দেশীয় ভদ্রলোক এই সকল পুস্তকালয়ের প্রতি বিলক্ষণ সহানুভূতি ও অনুরাগ প্রদান করিয়া থাকেন।

 এসিয়াটিক লাইব্রেরী।—সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠান সমুহের মধ্যে, এসিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল কলিকাতার মধ্যে যেমন অতি প্রাচীন, তেমনই ভারতের অত্যন্ত উপকারও করিয়াছে। ১৭৮৪ অব্দের ১৫ই জানুয়ারি তারিখে ইহা প্রতিষ্ঠিত হয়। এশিয়ার সর্বত্র মানুষে যাহা কিছু করে বা প্রকৃতি হইতে যাহা কিছু উৎপন্ন হয়, তৎসমস্তের অনুসন্ধান করাই ইহার উদ্দেশ্য। ওয়ারেন হেষ্টিংস ইহার প্রথম পেট্রন ও উইলিয়াম জোনস্ ইহার প্রথম প্রেসিডেণ্ট। ইহা দ্বারা যে সমস্ত নানাপ্রকারের ও বহুসংখ্যক উপকার সাধিত হইয়াছে, অল্প কথায় তাহা বুঝান দুঃসাধ্য। গবেষণা- বিষয়ে ইহার উপকারিতার তুলনা নাই। সংস্কৃত বিদ্যার পূনরভ্যুদয় ও সাহিত্যরাজ্যে উহার প্রকৃতাবস্থা নির্ধারণ প্রধানতঃ ইহারই ধারা হইয়াছে। এই সভা যদি সংস্কৃত গ্রন্থসমূহ মুদ্রিত করিয়া সভা- জগতে বিতরণ না করিত, তাহা হইলে ঐ সকল অমূল্য পুস্তক ইউরোপীয় নির্জনসমাজে অপরিচিত থাকিত। পরলোকগত ডাক্তার হোরেস হেমান উইলসন, টমাস কোলব্রুক, জেমস্ প্রিন্সেন, ও ডাক্তার রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রভৃতি স্বনামখ্যাত মহোদয়গণ ইহার সদস্য ছিলেন। এই সমাজের সহিত সম্পৃক্ত একটি ত্রিশা- লিকা (যাদুঘর) আছে; তাহাতে নানাপ্রকার বহুসংখ্যক খনিজ পদার্থ ও মানবজাতির আদর্শ সংগৃহীত হইয়াছে; অভিন্ন উহাতে অনেক অতি পুরাকালীন নিদর্শন, প্রতিমূর্তি, মুদ্রা দুষ্প্রাপ্য চিত্র তাম্ৰানুশাসনলিপি, মনুষ্যের উত্তমাঙ্গের প্রতিমূর্তি চিত্রপট প্রভৃতি আছে। ইহাতে এক উৎকৃষ্ট পুস্তকালয়ও আছে; তাহাতে অন্যান্য অনেক পদার্থের মধ্যে বহুসংখ্যক সংস্কৃত, আরবী, পারসী, হিন্দু- স্থানী, বৰ্মী ও নেপালী ভাষায় হস্তলিখিত পুথি আছে। চৌরঙ্গি রোডের পার্শ্বস্থ চিত্রশালিকার ভবনটা যেমন বৃহৎ ও দৃঢ়, তেমনি সুদৃশ্য ও মনোহর। এসিয়াটিক সোসাইটি এখন ৫৭ নং পার্ক- স্ট্রীটে অবস্থিত।

  ভারতীয় কৃষিসমিতি (The Agri-Hori-Horticultural Society of India):–—ব্যাপটিষ্ট মিশনারি জেমস ক্যারি সাহে- বের আনূকুল্যে এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত। অধুনা মেটকাফ হল নামে পরিচিত কলিকাতা সাধারণ পুস্তকালয়ের সর্ব নিম্নতলে ইহার সভার অধিবেশন হইয়া থাকে। প্রথম প্রথম রাজা সার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর ও বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি খ্যাতনামা দেশীয় ভদ্র- লোকগণ ইহার উন্নতিকল্পে সবিশেষ যত্ন প্রকাশ করিতেন। আলিপুরে এই সমিতির একটা উদ্যান আছে; তথায় সকল প্রকার গাছ পালা ও ফুল উৎপাদন করিয়া সাধারণকে বিক্রয় বা সদস্য- গণকে বিতরণ করা হয়। প্রতি বৎসর তথায় একটা ফুলের মেলা বসিয়া থাকে।

 আর্ট স্কুলঃ— ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দের প্রথমভাগে হজসন প্র্যাট সাহে- বের ভবনে একটা সমিতির অধিবেশন হইয়া কয়েকজন ভদ্রলোককে লইয়া যে কমিটি গটিত হয়, তাঁহাদেরই চেষ্টায় ঐ বৎসরই এই বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। চিত্রপট অঙ্কন, ধাতু পাত্রের উপর চিত্রা- স্কন, এবং খোদাই ও ঢালাই কাজ শিক্ষা দেওয়াই ইহার উদ্দেশ্য। মোসিয়া রিগো নামক জনৈক ফরাসী ইহার প্রথম শিক্ষক ছিলেন। ১৮৬৪ অব্দে বেঙ্গল গবর্নমেণ্ট এই বিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ ভার গ্রহণ করিয়াছেন। ইহাতে একটা সুন্দর চিত্রশালা আছে। ইহা এক্ষণে একজন সাহেব অধ্যক্ষের অধীন। সকলেই এখানে শিক্ষালাভ করিতে পারে। পুর্বে ইহা বৌবাজার স্ট্রীটে ছিল, কিন্তু সম্প্রতি চৌরঙ্গি রোডে যাদুঘরের নিকট ইহার নিজের সুন্দর বাটীতে উঠিয়া গিয়াছে।

 বেথুন সোসাইটিঃ— সাহিত্য ও বিজ্ঞান আলোচনায় অনুরাগ জন্মাইবার এবং ইউরোপীয় ও দেশীয়দিগের মধ্যে জ্ঞানানুশীলন বিষয়ক সংযোগসংস্থাপনের উদ্দেশ্যে এই সমিতির প্রতিষ্ঠা। মাননীয় জষ্টিস ফিয়ার, কর্ণেল ম্যাপস, পাদরি কে, এম, বন্দ্য, প্রখ্যাত ব্যারিষ্টার মনোমোহন ঘোষ, বাবু প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী প্রমুখ মহাত্মা ইহার কার্যে অন্তরের সহিত যোগ দিয়া প্রবন্ধ পাঠ ও বক্তৃতা করিতেন।

 বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান-সম্মিলনী (The Bengali social Science Association):—কুমারী মেরি কার্পেণ্টারের সঙ্গে এবং মাননীয় জষ্টিস ফিয়ায় ও বেভালি, পাদরি লঙ, নবাব আবদুল লতিফ যাঁ বাহাদুর প্রমুখ মহোদগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৬৭ সালে এই সম্মিলনী প্রতিষ্ঠিত হয়। জনসাধারণের সামাজিক, মানসিক ও নৈতিক অবস্থার তথ্য সংগ্রহ বিষয়ে ইউরোপীয় ও দেশীয়গিকে সম্মিলিত করিয়া বন্ধুদেশে সমাজিক উন্নতির সহায়তা করাই ইহার উদ্দেশ্য ছিল। এতৎসম্পর্কে আইন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাণিজ্য বিষয়ে বহু হিতকর বক্তৃত এই সম্মিলনীর অধিবেশন হইয়া গিয়াছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ বেথুন সোসাইটি ও এই সম্মিলনী উভয়েরই অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইয়াছে।

 মুসলমান-সাহিত্য-সমিতি (The Mahammedan literary Society) ঃ—১৮৬৩ অব্দে ইহা প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বশ্রেণীর জনগণের মধ্যে, বিশেষতঃ মুসলমান-সমাজে, সামাজিক ভাব সাহিত্য-বিষয়ে অনুরাগ উদ্দীপিত করিবার উদ্দেশ্যে ইহার প্রতিষ্ঠা। পরলোকগত নবাব আবদুল লতিফ খাঁ বাহাদুর ইহার প্রাণস্বরূপ ছিলেন। বস্তুতঃ নবাব বাহাদুর ভারতবাসী সকল সম্প্রদায়েরই একজন প্রধান নেতা বলিয়া বিবেচিত হইতেন। সকল সমাজে এই সভার প্রতিষ্ঠালাভ কেবল আবদুল লতিফ বাহাদুরেরই যত্নের ফল, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাঁহারই যত্নে টাউনহলে ইহার বার্ষিক অধিবেশনের সময় ভারতের রাজপ্রতিনিধি ও প্রধান সেনা- ধ্যক্ষ এবং বঙ্গীয় লেপটেন্যাণ্ট গবর্ণরগণ উপস্থিত হইতেন।

 যুবকগণের উচ্চতর শিক্ষাসমিতি বা কলিকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট The Society for the Higher Training of young Men or The Calcutta University Institute:—বঙ্গের ভূতপূর্ব লেফটেন্যাণ্ট গভর্ণর সার চার্লস ইলিয়টের ঐকান্তিক ইচ্ছায় ইহার উদ্ভব। বঙ্গীয় ছাত্র- বৃন্দের মানসিক, নৈতিক ও শারীরিক অবস্থার উন্নতি সাধন হইবার উদ্দেশ্যে প্রসিদ্ধ লেখক ও বক্তা প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, সংস্কৃত কলেজের ভূতপুর্ব অধ্যক্ষ মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর, পরলোকগত রায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাহাদুর, হাইকোর্টের ভূতপূর্ষ জজ সার ডাক্তার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিগণ প্রথম অবস্থায় ইহার সহিত সংসৃষ্ট ছিলেন। বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ইহার সম্পাদক ও রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর খনাধ্যক্ষ হন। বক্তৃতা সামাজিক সম্মিলনী, এবং নির্দোষ ও স্বাস্থ্যকর ক্রীড়া ও আমোক প্রমোদের ব্যবস্থা হইত, এবং ঐ সকল ব্যাপারে বঙ্গের শাসন- কর্তারা অবাধে ছাত্রবৃন্দের সহিত মিশিতেন। কিছুদিন পরে পরলোকগত অধ্যাপক সি, আর, উইলসন সম্পাদক হইলেন, এবং সেই সময়ে ইহার পুর্ব্বনামের পরিবর্তে বর্তমান ইউনিভার্সিটি ইনষ্টিটিউট নাম হইল। ইহা সংস্কৃত কলেজের পুর্বপার্শ্বে অব স্থিত। ইহার সংস্রবে একটী উৎকৃষ্ট লাইব্রেরী আছে। ইহারই প্রত্বে মার্কস স্কোয়ার ক্রীড়াভূমির উদ্ভব হইয়াছে; তথায় কলি- কাতায় সমস্ত কলেজের ছাত্রগণের নিমিত্ত স্বাস্থ্যকর ক্রীড়ার ব্যবস্থা হইয়া থাকে। রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর এতদর্থে বেঙ্গল গবর্ণ- মেণ্টের হস্তে যে অর্থ প্রদান করেন, তাহা হইতেই সার চার্লস ইলিয়ট এই মহাসমিতির সূত্রপাত করেন। ইহার কাজকর্মের তত্ত্বাবধান করিবার জন্য একটি কমিটী আছে।

 বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎঃ—রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুরের যত্নে তাহারই ভবনে ইহা প্রথমে স্থাপিত হয়। এল, লিয়টাভ সাহেব, পরলোকগত বাবু ক্ষেত্রগোপাল চক্রবর্তী এবং রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব এই তিন জনই ইহার প্রাণপ্রতিষ্ঠাতা। তৎকালে প্রতীচ্য পণ্ডিত মসীর নিকট বাঙ্গালা ভাষাকে পরিচিত করিয়া দেওয়া এবং তৎ- প্রতি তাহাদের অনুরাগ উক্তি করা, ইহার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। মানয়ীয় অধ্যাপক মাকস মুলার ও জন বিমূস্ ইহার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। এই সময়ে অধি- কাংশ খ্যাতনামা বাঙ্গালা লেখকগণের মতানুসারে ইহার কার্য- বিবরণীতে ইংরেজী ভাষার পরিবর্তে বাঙ্গালা ভাষার ব্যবহারই স্থিরীকৃত হইল। রাজা বাহাদুরের অনুরোধে পরলোকগত পণ্ডিত উমেশচন্দ্র বটব্যাল ইহার নাম “বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ” রাখেন। এই সভার বেশ আয় দাঁড়াইয়াছে, নিজের আয়েই ইহার ব্যয় নির্বাহ হইয়া থাকে। এক্ষণে কর্ণওয়ালিস স্ত্রীটে একটা বাটীতে ইহার কার্য্য হইয়া থাকে, কিন্তু শীঘ্রই সভার নিজের বাটী নির্ম্মিত হইবে।

 সাহিত্য-সভা:—ইহাও রাজা বিনয়কৃষ্ণ বাহাদুরের ঐকান্তিক যত্নে ও অর্থানুকূল্যে এবং তাহারই বাটীতে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহার অনুষ্ঠাতৃগণের মধ্যে রায় রাজেন্দ্রচন্দ্র শাস্ত্রী এম, এ, বাহাদুর, মহারাজকুমার শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ দেব বাহাদুর, মাননীয় জষ্টিস সারদাচরণ মিত্র, পরলোকগত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, মহামহোপাধ্যায় কামাখ্যানাথ তর্কবাগীশ, পণ্ডিত কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, রায় বাহাদুর ডাক্তার চুনিলাল বসু, রায় বাহাদুর ডাক্তার সূর্য্যকুমার সৰ্বাধিকারী, বাবু শশিভূষণ চট্টোপাধ্যায়, বাবু অমৃতলাল বসু, বাবু নরেন্দ্রনাথ সেন, পণ্ডিত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি প্রমুখ শিক্ষিত মহোদয়গণের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস, ভূগোলবিবরণ, সমাজতত্ত্ব গণিত, প্রকৃতি-বিজ্ঞান, প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দর্শন, ও অন্যান্য বিদ্যার আলোচনাই ইহার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ইহার বিশেষ গুণ এই যে, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শ্রেণীর প্রতি ইহা বিল- ক্ষণ শ্রদ্ধাভক্তি ও সহানুভূতি প্রদর্শন করিয়া থাকে, কারণ তাঁহ- দের সহায়তা ও সহযোগিতা ব্যতিরেকে সংস্কৃত সাহিত্যের পুন- কুদ্ধার অসম্ভব। সাহিত্য-সংহিতা নামে এই সভার একখানি মুখ- পত্র আছে; পার্লেমেণ্ট মহাসভার ব্লু-বুকেও তাহার যথেষ্ট সুখ্যাতি বাহির হইয়াছে। বঙ্গের ভূতপূর্ব্ব লেফটেনাণ্ট গভর্ণর পরলোকগত সরজন উড বর্ণ ইহার কার্যকারিতা হৃদয়ঙ্গম করিয়া ইহার পেট্রন হইয়াছিলেন। বর্তমান লেফটেনাণ্ট গভর্ণর মহোদয় ইহার পেট্রন পদ গ্রহণ করিয়াছেন, এবং বহু প্রধান প্রধান রাজপুরুষ ইহার সহিত যোগদান করিয়া আপনাদের সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছেন।

  1. এ সম্বন্ধে খৃষ্টান মার্শম্যান সাহেব লিখিয়াছেন;— গত সপ্তাহে গবর্ণমেণ্টের প্রতিনিধি কতকগুলি ইংরেজ কালীঘাটে গিয়াছিলেন, এবং ইংরেজরা সংপ্রতি এদেশে যে সকল বিজয় লাভ করিয়াছেন, তন্নিমিণ্ড কম্পানির নামে হিন্দুদেব দেবীর নিকট পূজা দিয়াছেন। পাঁচ হাজার টাকা পূজা দেওয়া হইয়াছে। সহস্র সহস্র বাঙ্গালী এই প্রতিমার নিকট ইংরেজদিগের পূজা দেওয়া দেখিয়াছে। এই কার্য্যে আমরা সবিশেষ মর্মাহত হইয়াছি, কারণ এই ব্যাপারে বাঙ্গালীরা কেন আমাদিগকে টিটকারী দিবার জন্যই উল্লাস প্রকাশ করিতেছে।”
  2. কথিত আছে যে, যে দিন হিন্দু ছাত্র মধুসূদন গুপ্ত মানবদেহের প্রথম শবব্যবচ্ছেদ করেন, সেই দিন ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গাকার হইতে তাহার সম্মানার্থ তোপধ্বনি হইয়াছিল। মধুসূদনের চিত্রপট অদ্যাপি মেডিক্যাল কলেজের শবব্যবচ্ছেদাগারে দেখিতে পাওয়া যায়। জে, ডবলিউ, কে, সাহেব লিখিয়াছেন:—
     “যখন লর্ড বেণ্টিঙ্ক প্রথম ভারতে পদার্পণ করিলেন, তম বুদ্ধিমান ও বহু- দর্শী লোকেরা মস্তক কম্পিত করিয়া বলিতে লাগিল, ভারতবাসীদিগের পক্ষে স্পর্শই যখন। যৎপরোনাতি ঘৃণাজনক, তখন তাহাদিগকে ইউরোপীয় ছাত্রগণের ন্যায় শবব্যবচ্ছেদাগারে শারীর-বিজ্ঞান শিক্ষা করিতে প্রতি করা অসাধ্য হইবে। পরন্তু তাঁহার যত্নে এ বিষয়টি পরীক্ষিত হইল। কেবল যে পরীক্ষিত হইল তাহা নহে, পরীক্ষায় সফলতা লাভ হইল। কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হইল; এবং সর্বোচ্চজাতীয় হিন্দুরা শারীরবিদ্যা শিক্ষা করিতে লাগিল; শিখিতে লাগিল,—মোম বা কাঠের আদর্শ হইতে নহে প্রকৃত মানবদেহ হইতে। প্রারম্ভ খুব স্বল্পই হইয়াছিল বটে, কিন্তু উহার ক্রমোন্নতি দেখিয়া সকলে বিস্মিত হইল। এখন বৎসরের হিসাব রাখা হইয়া- ছিল। ঐ বৎসরে ১৮৩৭ সালে— ছাত্রদের সমক্ষে ৬০টি শবদেহের ব্যবচ্ছেদ করা হয়। পর বৎসর ঐ সংখ্যা ঠিক দ্বিগুণিত হইয়াছিল। ১৮৪৪ সালে শবসংখ্যা পাঁচ শতেও অধিক হইয়াছিল। কলেজটী অত্যন্ত লোকপ্রিয় হইয়া উঠিল। দেশীয় যুবকদিগের ঔষধ-চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞানলাভের প্রবল বাসনা সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হইতে লাগিল।”
     ১৮৪৪ অকে সেই সুশিক্ষিত ও বদান্য দেশীয় ভদ্রলোক দ্বারকানাথ ঠাকুর মেডিক্যাল কলেজের দুইজন ছাত্রকে নিজ ব্যয়ে ইংল্যাণ্ডে লইয়া যাইয়া তথায় তাহাদের শিক্ষার সমস্ত ব্যভার বহন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করি- নেন। কলেজের অন্যতম অধ্যাপক ডাক্তার গুভীডও নিজ বায়ে আর একটি ছাত্রকে লইয়া যাইতে চাহিলেন, এবং চতুর্থ আর একটিকে লইয়া যাইবার উপযুক্ত অর্থ লোকের নিকট চাঁদা করিয়া সংগ্রহ করিলেন। যে চারিজন ছাত্র অধ্যাপকের সহগামৗ হইয়া ৮ই মার্চ তারিখে বেণ্টিঙ্ক নামক স্টিমারে আরোহণ করেন, তাহাদের নাম-(১) ভোলানাথ বসু, ইনি লর্ড অকৃল্যাণ্ডের বরাকপুর স্কুলের ভুতপুর্ন ছাত্র; লর্ড অকল্যাণ্ড ইহাঁকে পাঁচ বৎসর নিজ ব্যয়ে মেডিকেল কলেজে পড়াইয়াছিলেন, এবং গ্রিফিথ সাহেব ইহাকে কলেজের মধ্যে উদ্ভিদূবিদ্যার সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্র জ্ঞান করিতেন। (২) গোপালচন্দ্র শীল। (৩) দ্বারকানাথ বসু; ইনি একজন নেটিভ খৃষ্টান। পুঝে জেনারেল এসেমবিলিজ ইনষ্টিটিউশন নামক বিদ্যালয়ে পড়িয়াছিলেন এবং কিছুদিন স্বাদুঘরে সহকারীর পদে কার্য্য করিয়াছিলেন। (৪) সূর্য্যকুমার চক্র বর্ত্তী নামক কুমিল্লাবাসী একজন ব্রাহ্মণ; ইনি অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর ছাত্র কিন্তু সাতিশয় তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও তেজস্বী।”
  3. কেহ কেহ বলেন ১৪ই মে। কিন্তু রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর বলেন, তিনি পরলোকগত রাজা সার রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের আলমারিতে উক্ত সভার কার্যবিবরণের যে অনুলিপি দেখিয়াছেন, তাহাতে ৪ঠা মে তারিখ আছে; রাজা রাধাকান্ত হিন্দু-কলেজের গভর্ণর এবং তাহার পিতা উহার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
  4. ইহারই পৌত্র সুপ্রসিদ্ধ উকিল অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কিছুদিন হাইকোর্টের জজ হইয়াছিলেন।
  5. অধ্যাপক উইলসনের বিবিধ বিদ্যায় পারদর্শিতা ও নানা গুণের পশ্চাদুক্ত সংক্ষিপ্ত পরিচয়টি সত্য সত্যই অতিরঞ্জিত নহে। যিনি ইহা লিপিবদ্ধ করিয়া- ছেন, তিনি উক্ত অধ্যাপক হইতে অনেক গুরুর বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন-প্রকৃতি ছিলেন, এবং উভয়ের মধ্যে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও ছিল না যাহার জন্য তিনি অদ্ভুক্তি করিবেন। তিনি বলেন-“বোধ হয়, সুপ্রসিদ্ধ ক্রাইটনের সময়ের পর এ পর্যন্ত কোনও ব্যক্তিই একাধারে এরূপ বিবিধ, সঠিক, ও অপাতদৃষ্টির বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন বলিয়া প্রতীয়মান বহু গুণ ও বিদ্যার অধিকারী হইতে পারেন নাই। তিনি একদিকে যেমন প্রগাঢ় সংস্কৃত পণ্ডিত, বৈয়াকরণ, দার্শনিক ও কবি ছিলেন অপরদিকে তেমনই সমাজের জীবন-স্বরূপ ও মার্জিতবুদ্ধি প্রকৃত কাজের লোক ছিলেন। স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত অভিনেতারূপে রঙ্গমঞ্চেই হউক, আর আমাদের সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাচ্যভাষাবিশারদরূপে অধ্যাপকের আসনেই হউক, সর্বত্রই তিনি আপনার কার্য্য যথাযথরূপে সম্পন্ন করিতেন। তিনি হিন্দুস্থানের পুরাতত্ত্ব, মুদ্রাত, ইতিহাস, সাহিত্য, ঐতিহাসিক কালনিরূপণ, মানবতা, সকল বিষয়েই গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন; আর এই সকল বিষয়ে স্বয়ং কোলব্রুকও এত অধিক ও এরূপ উৎকৃষ্ট রচনা করিতে পারেন নাই। তাঁহার গ্রন্থসমুহে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়; তাহাতে অসুচিত গুরুগম্ভীর্য, গর্ব্ব বা অহমি- কার লেশমাত্র নাই। আর তাহার ভাষাও সকলের ভাষা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ সুশি- ক্ষিত ইংরেজ ভলোকর ভাষা।”
  6. পরলোকগত রাজা রামমোহন রায়ও এই সময়ে ইংরাজী শিক্ষার পক্ষ সমর্থন করিয়া গভর্ণর জেনারেলের নিকট আবেদনপত্র প্রেরণ করেন।
  7. রেইলি সাহেব কিন্ত বলেন:—
     ১৭৬০ অব্দের সময়কালে মিসিস হেজেস একটা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সম্ভবতঃ উহাই কলিকাতার প্রথম বালিকাবিদ্যালয়। ঐ বিদ্যালয়ে মৃত্য ও ফরাসী ভাষা শিখান এই বলিয়া প্রকাশ •••••••তৎকালে খিদিরপুর স্কুলের অস্তিত্ব ছিল না; সুতরাং মিসিল হজে ১৭৮০ সালে বেশ সঙ্গতি করিয়া লইয়া অবসর গ্রহণ করিতে সমর্থ হন। কথিত আর যে, হেজেস বিবির বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা শিষ্টবৎ, গর্ব্বিতা।,ধূর্তা, নীচস্বভাবা ও স্বেচ্ছাচারিণী ছিল।