কাহাকে?/উনবিংশ পরিচ্ছেদ

উনবিংশ পরিচ্ছেদ।

 দৃষ্টির সম্মুখে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পরিব্যাপ্ত অথচ কিছুই চোখে পড়িতেছে না; মস্তিষ্ক চিন্তাতরঙ্গে আলোড়িত, অথচ কি ভাবিতেছি কিছুই জানি না। মন স্থানহিসাবেও অতিদূরে, সময় হিসাবেও অতিদূরে, নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত অনুভব করিতেছি কি না করিতেছি! মাঝে মাঝে কেবল সচেতন বেদনার অনুভূতি, দেহবন্ধন হইতে পলায়নের জন্য একটা নিষ্ফল ব্যাকুলতা, অন্ধকারের মধ্যে আলোক দেখিবার জন্য নিদারুণ প্রয়াস, দুর্বল এক হস্তে দৃঢ় লৌহ শৃঙ্খল ভাঙ্গিবার জন্য বৃথা চেষ্টায় প্রাণান্ত পরিশ্রান্তি, অক্ষম কষ্ট ও অসহায় ক্রোধ! আর ছোটু যাহাকে এত ভালবাসিয়াছি এত বন্ধু মনে করিয়াছি—সেই আমার এই কষ্টের কারণ! সহসা ভাবিতে ভাবিতে প্রাণের মধ্যে দৈববাণী শুনিলাম,—“তাহা হইতেই পারেন, চিরদিন সে তোমার বন্ধু ছিল—চিরদিন বন্ধু থাকিবে, এ বিপদে সেই তোমাকে উদ্ধার করিবে।”-অন্ধকার সমুদ্রে মুহূর্ত্তে যেন দিশা উন্মুক্ত হইয়া গেল; তাছাকে সমস্ত খুলিয়া বলিতে সংকল্প করিলাম। বুঝিলাম তাহা- তেই আমার একমাত্র আশাভরসা। পুরাকালের স্বর্ণপ্রস্তুত উপায়চিন্তানিমগ্ন রসায়ণবিদের মত এই আবিষ্কারের আনন্দ আমার ক্ষুদ্র হৃদয়ের পক্ষে অপরিমিত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল,—কিন্তু কাহাকে ইহার ভাগ দিব? এখানে আমার সখী কে!

 একটু পরে একজন চাকর আসিয়া আমার হাতে একখানি কার্ড আনিয়া দিল। কি আশ্চর্য্য! ডাক্তার ঘে! আনন্দে নহে বিস্ময়ে আমার হৃদকম্পন স্তম্ভিত হইয় পড়িল। আমি কলের পুতুলের মত চাকরকে বলিলাম—“আসিতে বল।”

 সে চলিয়া গেলে তখন মনে হইল, আমার কি এখন তাহার সহিত দেখা করা উচিত! কিন্তু উচিত অনুচিত ভাবিয়া আদেশ পরিবর্ত্তনেত তখন আর অবসর ছিল না। প্রায় তখনি ডাক্তার আসিয়া পড়িলেন। এইখানে বলা আবশ্যক, আমি এতক্ষণ ড্রয়িংরুমেই ছিলাম। অন্তঃপুরের গোলমাল ছাড়াইয়া দুপর বেল প্রায়ই আমি এই বিজন গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করি —বাবা না থাকিলে এখানে বাহিরের লোক কেহই প্রায় আসেন না, কদাচ কেহ আসিলেও আমি আগে খবর পাই।

 ডাক্তার জাসিয়া প্রথম অভিবাদনের পর বলিলেন—“আপনাকে ভারী রোগ দেখাচ্ছে—আপনার কি এখনো অসুখ যাচ্ছে?”

 অসাধারণ সহানুভূতির কথা নহে, যে কোন আলাপী আমাকে এখন দেখিতেন—সম্ভবতঃ ইহাই বলিতেন; তবে এ কথায় আমি এতদূর বিচলিত হইলাম কেন? বহুকষ্টে অশ্রু সংযত করিয়া তাড়াতাড়ি বলিলাম “আপনি এখানে য়ে? কোথা থেকে আসছেন?”  তিনি বিস্মিত ভাবে বলিলেন—“আমি এখানে আসব তা আপনি জানতেন না? মিষ্টার মজুমদারকে ত (আমার বাবা) আগেই লিখেছি!"

 হাসি পাইল, বাবা যেন সব কথা আমাকে বলিতে যাইবেন! বুলিলাম “কই না, আমি তা শুনিনি। কোনও কেসে এসেছেন বুঝি?”

 তিনি একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন—“না আপনাদের সঙ্গে দেখা করা ছাড়া আসার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই।”

 আশ্চর্য্য হইলাম। আমাদের সহিত দেখা করিতে এতদূর আসিয়াছেন। বিস্ময়ের আবেগে সহসা বলিয়া ফেলিলাম,— “আশ্চর্য্য বই কি? কলকাতা থাকতে কবার দেখা করতে এসেছেন—তা এতদূরে—”

 তিনি একটু হাসিলেন; হাসিয়া চশমার মধ্য হইতে আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টি করিয়া বলিলেন—“আমার বিশ্বাস ছিল—অনেক কথা খুলে না বলাতেই আরো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু জীবনের অনেক ভুলের মত দেখছি এঃ আমার আর একটা ভুল! আমি যে কেন আসতুম না তাকি বোঝেননি আপনি?”

 “কি করে বুঝব?”

 তিনি আইপ্লাসটা একবার খুলিয়া আবার ভাল করিয়া চোখে আঁটিয়া উন্নত মধুর দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন—"বেশী আসতে ইচ্ছা করত বলেই আসিনি।”

 “তাহলে কি মনে করব এখন ইচ্ছা নেই বলেই”—

 “তাহলে আর একটা ভুল করবেন” তাহার পর একটু খামিয় আবার বলিলেন “একটু যে অবস্থান্তর ঘটেছে তা অস্বীকার করতে পারিনে। তখন শুনেছিলুম আপনি engaged; এখন সে সঙ্কোচ ঘুচেছে-তাই তাই —”

 ঘর্ম্মাক্ত হইয়া উঠিলাম! একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সমস্ত দেহে পরিব্যাপ্ত হইল। তাই—তাই-কি? তিনি একটু থামিয়া আবার বলিলেন—“তাই আমার জীবন প্রাণ সর্ব্বস্ব আপনাকে সমর্পণ করতে এসেছি—এখন আপনি যা করেন।”

 বিশ্ব ব্রহ্মাও আমার চারিদিকে ঘুরিয়া উঠিল; একটা মধুরতার আবর্ত্তে আমি আবর্তিত হইতে লাগিলাম।—কি করিয়া বলিব তাহা কি মধুর! পুরুষের নিকট হইতে—যে পুরুষকে ভালবাসি তাহার নিকট হইতে প্রথম শোনা সে আমারি! “পৃথিবীতে যদি স্বর্গ থাকে তবে ইহাই তাই ইহাই তাই!” কিন্তু পৃথিবী সত্যই স্বর্গ নহে সেইজন্য এত অমিশ্র অসীম সুখ জীবনে কাহারে অধিকক্ষণ থাকেন। মুহূর্ত্ত না যাইতে মুখের অসীমতা দুঃখ আসিয়া সীমাবদ্ধ করে। কিছু পরেই প্রকৃতিস্থ হইলাম, স্বপ্ন ভাঙ্গিল; অনতিক্রমণীয় বাধা বিঘ্ন আবার চক্ষের উপর স্তূপাকৃতি দেখিলাম —বুঝিলাম এত মধুর আলোক শুধু অন্ধকারের পূর্ব্বসূচনা, তাহার এই আত্মসমর্পণ শুধু চির বিদায় গ্রহণ করিতে; এমিলন শুধু চিরবিচ্ছেদ, চিরব্যবধানের জন্য —

 আমাকে নিরুত্তর দেখিয় তিনি বলিলেন—“তুমি-তুমি,— আমার কেমন সমস্ত ভূল হয়ে যাচ্ছে মাপ করবেন,—বিলাত থেকে এসে যেদিন আপনাকে দেখেছি সে দিন থেকে বুঝেছি আপনি ছাড়া আমার জীবন নিষ্ফল; সেই থেকে বহুদিনের”—

 হঠাৎ বলিলাম-"কিন্তু আপনি না engaged!"

 “আমি engaged! এ খবর কোথায় পেলেন?”  “আপনার মা নাকি বলেছিলেন।”

 তিনি হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন “মায়ের কথা!—মে মেয়েটিকে তাঁর পছন্দ হয়—অবশ্য সেজন্য মূর্ত্তিমতী লক্ষ্মী সরস্বতীর যে আবশ্যক তা বলতে পারছিনে—তাকেই তিনি বৌ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এখন বহু বিবাহ প্রচলিত না থাকায় তাঁর বোধ হয় বিশেষ কষ্টের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। সে যাক, আমার কথার কি কোন উত্তর নেই?”

 কি উত্তর দিব? আমি কি সমস্ত প্রাণে তাঁহারি নহি; তবে কোন প্রাণে বলিব আমি অন্যের হইতে চলিয়াছি। তবুও বলিলাম, কি করিয়া বলিলাম ঠিক জানিনা,—

 “আমি engaged; বাবা অন্যের সঙ্গে আমার বিয়ে স্থির করেছেন।”

 একটা শোক নিস্তব্ধতায় আনন্দোচ্ছাস নিমেষে ডুবিয়া গেল। কিছু পরে তিনি বলিলেন,—যেন আপনার বিক্ষিপ্ত চিন্তারাশি সংহত একত্রীভূত করিতে করিতে আপন মনেই বলিলেন—“কিন্তু মিষ্টার মজুমদার এরূপ ব্যবহার করবেন? আমাকে,—থাক সে কথা তাঁর সঙ্গে —আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, আপনারো কি তাই ইচ্ছা?”

 তখন আমার লজ্জা সঙ্কোচ জ্ঞান ছিল না, আমি পুরুষের মত সুস্পষ্ট ভাবে বলিলাম—“না অন্য কাউকে ভাল বাসতে আমার শক্তি নেই।”

 একটা বৈদ্যুতিক স্ফুরণ তাঁঁহাতে প্রত্যক্ষ করিলাম, ইহা কি আনন্দের? কিছু পরে তিনি বলিলেন “সে কথা কি আপনার বাবাকে বলেছিলেন?”  আমি বিস্ময়ে বলিলাম “সে কথা বাবাকে কি করে বলব? এইটুকু বলেছিলুম আমার বিবাহে ইচ্ছা নেই—তাতে আমি সুখী হব না।”

 “তিনি কি বল্লেন?”

 “বল্লেন আমাকে বিবাহ করতেই হবে —বুঝলুম তাঁর আজ্ঞা লঙ্ঘন করতে আমি অক্ষম। তাকে সুখী করাই আমার সর্ব্বপ্রধান কর্তব্য।”

 “কিন্তু ভালবাসার কি একটু সামান্য কর্তব্যও নেই! তুমি-আপনি যাকে ভাল বাসেন, যে আপনাকে ভাল বাসে, আপনা ব্যতীত যার জীবন মরণ সমানই-তার প্রতি—কেবল তাঁর প্রতি না—নিজের প্রতিও এতে যে গুরুতর অন্যায় করা হচ্ছে তার প্রতিকারের চেষ্টাও কি কন্যাধর্ম্মের বিরোধী? আমার বিশ্বাস মজুমদার মহাশয় সমস্ত জানলে কখনই আপনাকে অন্তের সহিত বিবাহে বাধ্য করবেন না।”

 চুপ করিয়া রহিলাম। যাহা বলিতেছেন সবইত ঠিক। নীরব দেখিয়া তিনি অধীর ভাবে বলিলেন—“আপনার সঙ্কোচ হয় আচ্ছ। আমি বলব, আমাকে অনুমতি দিন।”

 আমি বলিলাম—“না না আপনার বলতে হবেনা; আমিই বলব। কিন্তু বাবাকে না, তাকে বলে কোন ফল নেই, তিনি আমার ভাব বুঝবেন না, নিশ্চয়ই sentimental দুর্ব্বলতা বলে মনে করবেন। আমি তাকে বলব; যার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা, তাকে— ছোটুকেই বলব —তার উদারতার প্রতি আমার খুব বিশ্বাস আছে। আমি বেশ জানি তার থেকেই আমি মুক্তি পাব। যদিও আমি তাকে কখনও হৃদয় দিতে পারব না; কিন্তু আমি ছেলে বেলা থেকে তাকে ভালবাসি, বন্ধু মনে করি, তার স্মৃতি চিরদিন আমার মনে সুখ জাগায়। সে যে আমার কষ্ট্রের কারণ হবে আমি কিছুতেই মনে করতে পারিনে।”

 “ছোটু! ছোটুর সঙ্গে বিবাহের কথা? নিশ্চয়ই—তার যদি একটুও মনুষ্যত্ব থাকে অবশ্যই সে সহায় হবে।”

 অতিরিক্ত আশানন্দে তিনি নিতান্ত যেন অপ্রকৃতিস্থ হইয়া এইরূপ বলিলেন। আমি বলিলাম—“তাকে চেনেন কি?”

 তিনি সে কথার উত্তর করিলেন না; বোধ হইল যেন তাহা শুনিতে পাইলেন না। নিজের ভাবে ভোর হইয়াই বলিলেন— “কেমন যেন সমস্ত মায়ার খেলা মনে হচ্ছে! আপনি তাহলে তাকে বলবেন। আমি এখন যাই, তার সঙ্গে কথা কয়ে কি ফল হয় যেন শুনতে পাই। হয়ত নিজেই আসব; যদি আবার কালই আসি কিছু মনে করবেন না; আপনার বাবার সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি।”

 বলিয়া কেমন যেন অতি সহসা তিনি চলিয়া গেলেন, আমাকে একটি কথা কহিবার পর্য্যস্ত আর সময় দিলেন না।