কাহিনী (১৯১২)/গান্ধারীর আবেদন

কাহিনী


গান্ধারীর আবেদন


দুর্য্যোধন

প্রণমি চরণে তাত!

ধৃতরাষ্ট্র

  ওরে দুরাশয়
অভীষ্ট হয়েছে সিদ্ধ?

দুর্য্যোধন

  লভিয়াছি জয়।

ধৃতরাষ্ট্র

এখন হয়েছ সুখী?

দুর্যোধন


  হয়েছি বিজয়ী।

ধৃতরাষ্ট্র


অখণ্ড রাজত্ব জিনি সুখ তোর কই
রে দুর্ম্মতি?

দুর্য্যোধন


  সুখ চাহি নাই মহারাজ!
জয়। জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।
ক্ষুদ্র সুখে ভরেনাক ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা
কুরুপতি,—দীপ্তজালা অগ্নিঢালা সুধা
জয়রস—ঈর্ষাসিন্ধু মন্থন সঞ্জাত
সদ্য করিয়াছি পান,—সুখী নহি, তাত,
অদ্য আমি জয়ী। পিতঃ, সুখে ছিনু, যবে
একত্রে আছিনু বদ্ধ পাণ্ডবে কৌরবে,
কলঙ্ক যেমন থাকে শশাঙ্কের বুকে
কর্মহীন গর্বহীন দীপ্তিহীন সুখে।
সুখে ছিনু, পাণ্ডবের গাণ্ডীব টঙ্কারে
শঙ্কাকুল শত্রুদল আসিত না দ্বারে,
সুথে ছিনু, পাণ্ডবেরা জয়দৃপ্ত করে
ধরিত্রী দোহন করি, ভ্রাতৃপ্রতিভরে
দিত অংশ তার—নিত্য নব ভোগসুখে
আছি নিশ্চিন্ত চিত্তে অনন্ত কৌতুকে।

সুখে ছিনু, পাণ্ডবের জয়ধ্বনি যবে
হানিত কৌরব-কর্ণ প্রতিধ্বনিরবে;
পাণ্ডবের যশােবিশ্ব-প্রতিবিম্ব আসি
উজ্জ্বল অঙ্গুলি দিয়া দিত পরকাশি’
মলিন-কৌরবকক্ষ। সুখে ছিনু পিতঃ
আপনার সর্ব্বতেজ করি নির্ব্বাপিত
পাণ্ডব-গৌরবতলে স্নিগ্ধশান্তরূপে
হেমন্তের ভেক যথা জড়ত্বের কুপে।
আজি পাণ্ডুপুত্রগণে পরাভব বহি
বনে যায় চলি,―আজ আমি সুখী নহি,
আজ আমি জয়ী।

ধৃতরাষ্ট্র

ধিক্ তাের ভ্রাতৃদ্রোহ!
পাণ্ডবের কৌরবের এক পিতামহ
সে কি ভুলে গেলি?

দুর্য্যোধন

ভূলিতে পারিনে সে যে,―
এক পিতামহ তবু ধনে মানে তেজে
এক নহি।―যদি হ’ত দূরবর্ত্তী পর
নাহি ছিল ক্ষোভ; শর্ব্বরীর শশধর
মধ্যাহ্নের তপনেরে দ্বেষ নাহি করে,—
কিন্তু প্রাতে এক পূর্ব্ব-উদয়-শিখরে
দুই ভ্রাতৃ সূর্য্যলােক কিছুতে না ধরে।

আজ দ্বন্দ্ব ঘুচিয়াছে, আজি আমিজয়ী,
আজি আমি একা।

ধৃতরাষ্ট্র

ক্ষুদ্র ঈর্ষ্যা! বিষময়ী
ভুজঙ্গিনী।

দুর্য্যোধন

ক্ষুদ্র নহে, ঈর্ষ্যা সুমহতী।
ঈর্ষ্যা বৃহতের ধর্ম্ম। দুই বনস্পতি
মধ্যে রাখে ব্যবধান,―লক্ষ লক্ষ তৃণ
একত্রে মিলিয়া থাকে বক্ষে বক্ষে লীন;
নক্ষত্র অসংখ্য থাকে সৌভ্রাত্র-বন্ধনে,―
এক সূর্য্য এক শশী। মলিন কিরণে
দূর বন-অন্তরালে পাণ্ডু চন্দ্রলেখা
আজি অস্ত গেল,―আজি কুরুসূর্য্য একা,
আজি আমি জয়ী।

ধৃতরাষ্ট

  আজি ধর্ম্ম পরাজিত।

দুর্য্যোধন

লােকধর্ম্ম রাজধর্ম্ম এক নহে পিতঃ!
লােকসমাজের মাঝে সমকক্ষজন
সহায় সুহৃদ্‌রূপে নির্ভর বন্ধন,―

কিন্তু রাজা একেশ্বর, সমকক্ষ তার
মহাশত্রু, চিরবিঘ্ন, স্থান দুশ্চিন্তার,
সম্মুখের অন্তরাল, পশ্চাতের ভয়,
অহর্নিশি যশঃশক্তিগৌরবের ক্ষয়,
ঐশ্বর্য্যের অংশ-অপহারী। ক্ষুদ্রজনে
বলভাগ করে লয়ে বান্ধবের সনে
রহে বলী; রাজদণ্ডে যত খণ্ড হয়
তত তার দুর্ব্বলতা, তত তার ক্ষয়।
একা সকলের ঊর্দ্ধে মস্তক আপন
যদি না রাখিবে রাজা, যদি বহুজন
বহুদূর হতে তাঁর সমুদ্ধত শির
নিত্য না দেখিতে পায় অব্যাহত স্থির,
তবে বহুজন পরে বহুদূরে তাঁর
কেমনে শাসন দৃষ্টি রহিবে প্রচার?
রাজধর্ম্মে ভ্রাতৃধর্ম্ম বন্ধুধর্ম্ম নাই,
শুধু জয়ধর্ম্ম আছে, মহারাজ, তাই
আজি আমি চরিতার্থ, আজি জয়ী আমি,―
সম্মুখের ব্যবধান গেছে আজি নামি’
পাণ্ডব গৌরবগিরি পঞ্চচূড়াময়।

ধৃতরাষ্ট্র

জিনিয়া কপটদ্যূতে তারে কোস্ জয়?
লজ্জাহীন অহঙ্কারী!

দুর্য্যোধন

যার যাহা বল
তাই তার অস্ত্র পিতঃ, যুদ্ধের সম্বল।
ব্যাঘ্রসনে নখেদন্তে নহিক সমান
তাই বলে’ ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ
কোন্ নর লজ্জা পায়? মূঢ়ের মতন
ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুমাঝে আত্মসমর্পণ
যুদ্ধ নহে,—জয়লাভ এক লক্ষ্য তার,―
আজি আমি জয়ী পিতঃ, তাই অহঙ্কার।

ধৃতরাষ্ট

আজি তুমি জয়ী তাই তব নিন্দাধ্বনি
পরিপূর্ণ করিয়াছে অম্বর অবনী
সমুচ্চ ধিক্কারে।

দুর্য্যোধন

নিন্দা! আর নাহি ডরি,
নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি।
নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী
স্পর্দ্ধিত রসনা তার দৃঢ়বলে চাপি
মাের পাদপীঠতলে। “দুর্য্যোধন পাপী”
“দুর্য্যোধন ক্রুরমনা” “দুর্য্যোধন হীন”
নিরুত্তরে শুনিয়া এসেছি এতদিন,
রাজদণ্ড স্পর্শ করি কহি মহারাজ
আপামর জনে আমি কহাইব আজ

“দুর্য্যোধন রাজা!—দুর্য্যোধন নাহি সহে
রাজনিন্দা-আলােচনা, দুর্য্যোধন বহে
নিজহস্তে নিজনাম।”

ধৃতরাষ্ট্র

ওরে বৎস, শােন্!
নিন্দারে রসনা হতে দিলে নির্ব্বাসন
নিম্নমুখে অন্তরের গূঢ় অন্ধকারে
গভীর জটিল মূল সুদূরে প্রসারে,
নিত্য বিষতিক্ত করি রাখে চিত্ততল।
রসনায় নৃত্য করি’ চপল চঞ্চল
নিন্দা শ্রান্ত হয়ে পড়ে,—দিয়ো না তাহারে
নিঃশব্দে আপন শক্তি বৃদ্ধি করিবারে
গােপন হৃদয়দুর্গে। প্রীতিমন্ত্রবলে
শান্ত কর বন্দী কর নিন্দা সর্পদলে
বংশীরবে হাস্য মুখে।—

দুর্য্যোধন

অব্যক্ত নিন্দায়
কোন ক্ষতি নাহি করে রাজ মর্য্যাদায়,
ভ্রূক্ষেপ না করি তাহে। প্রীতি নাহি পাই
তাহে খেদ নাহি—কিন্তু স্পর্দ্ধা নাহি চাই
মহারাজ!—প্রীতিদান স্বেচ্ছার অধীন,—
প্রীতিভিক্ষা দিয়ে থাকে দীনতম দীন,—

সে প্রীতি বিলাক্ তারা পালিত মার্জ্জারে,
দ্বারের কুক্কুরে, আর পাণ্ডবভ্রাতারে,
তাহে মাের নাহি কাজ। আমি চাহি ভয়
সেই মাের রাজপ্রাপ্য,—আমি চাহি জয়
দর্পিতের দর্প নাশি। শুন নিবেদন
পিতৃদেব,―এতকাল তব সিংহাসন
আমার নিন্দুকদল নিত্য ছিল ঘিরে,
কণ্টক তরুর মত নিষ্ঠুর প্রাচীরে
তােমার আমার মধ্যে রচি ব্যবধান;
শুনায়েছে পাণ্ডবের নিত্য গুণগান
আমাদের নিত্য নিন্দা,―এই মতে পিতঃ
পিতৃস্নেহ হতে মােরা চির নির্ব্বাসিত।
এই মতে পিতঃ মােরা শিশুকাল হতে
হীনবল,—উৎসমুখে পিতৃস্নেহস্রোতে
পাষাণের বাধা পড়ি মােরা পরিক্ষীণ
শীর্ণ নদ, নষ্টপ্রাণ, গতিশক্তিহীন,
পদে পদে প্রতিহত; পাণ্ডবেরা স্ফীত
অখণ্ড অবাধগতি;―অদ্য হতে পিতঃ
যদি সে নিন্দুকদলে নাহি কর দূর
সিংহাসনপার্শ্ব হতে, সঞ্জয় বিদুর
ভীষ্ম পিতামহে,—যদি তারা বিজ্ঞবেশে
হিতকথা ধর্ম্মকথা সাধু উপদেশে
নিন্দায় ধিক্কারে তর্কে নিমেষে নিমেষে
ছিন্ন ছিন্ন করি দেয় রাজকর্ম্মডোর,

ভারাক্রান্ত করি রাখে রাজদণ্ড মোর,
পদে পদে দ্বিধা আনে রাজশক্তিমাঝে,
মুকুট মলিন করে অপমানে লাজে,
তবে ক্ষমা দাও পিতৃদেব,―নাহি কাজ
সিংহাসন কণ্টক শয়নে,―মহারাজ
বিনিময় করে লই পাণ্ডবের সনে
রাজ্য দিয়ে বনবাস, যাই নির্ব্বাসনে!

ধৃতরাষ্ট্র

হায় বৎস অভিমানী! পিতৃস্নেহ মাের
কিছু যদি হ্রাস হত শুনি সুকঠোর
সুহৃদের নিন্দাবাক্য,―হইত কল্যাণ।
অধর্ম্মে দিয়েছি যোগ, হারায়েছি জ্ঞান,
এত স্নেহ! করিতেছি সর্ব্বনাশ তাের,
এত স্নেহ! জ্বালাতেছি কালানল ঘোর
পুরাতন কুরুবংশ-মহারণ্যতলে,―
তবু পুত্র দোষ দিস্ স্নেহ নাই বলে!
মণিলােভে কালসর্প করিলি কামনা,
দিনু তােরে নিজহস্তে ধরি তার ফণা
অন্ধ আমি!―অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে
চিরদিন,―তােরে লয়ে প্রলয় তিমিরে
চলিয়াছি,―বন্ধুগণ হাহাকার-রবে
করিছে নিষেধ,―নিশাচর গৃধ্রসবে

করিতেছে অশুভ চিৎকার,—পদে পদে
সঙ্কীর্ণ হতেছে পথ,—আসন্ন বিপদে
কণ্টকিত কলেবর,—তবু দৃঢ় করে
ভয়ঙ্কর স্নেহে বক্ষে বাঁধি লয়ে তােরে
বায়ুবলে অন্ধবেগে বিনাশের গ্রাসে
ছুটিয়া চলেছি মূঢ় মত্ত অট্টহাসে
উল্কার আলােকে,―শুধু তুমি আর আমি,―
আর সঙ্গী বজ্রহস্ত দীপ্ত অন্তর্যামী,―
নাই সন্মুখের দৃষ্টি, নাই নিবারণ
পশ্চাতের, শুধু নিম্নে ঘোর আকর্ষণ
নিদারুণ নিপাতের।―সহসা একদা
চকিতে চেতনা হবে, বিধাতার গদা
মুহূর্ত্তে পড়িবে শিরে,—আসিবে সময়,
ততক্ষণ পিতৃস্নেহে কোরােনা সংশয়,
আলিঙ্গন কোরােনা শিথিল,—ততক্ষণ
দ্রুত হস্তে লুটি লও সর্ব্ব স্বার্থধন,
হও জয়ী, হও সুখী, হও তুমি রাজা
একেশ্বর।―ওরে তােরা জয়বাদ্য বাজা।
জয়ধ্বজা তােল শূন্যে। আজি জয়ােৎসবে
ন্যায় ধর্ম্ম বন্ধু ভ্রাতা কেহ নাহি র’বে,—
না র’বে বিদুর ভীষ্ম, না র’বে সঞ্জয়,
নাহি র’বে লােকনিন্দা লােকলজ্জা ভয়,
কুরুবংশ-রাজলক্ষ্মী নাহি র’বে আর,
শুধু র’বে অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার

আর কালান্তক যম,—শুধু পিতৃস্নেহ
আর বিধাতার শাপ—আর নহে কেহ।

(চরের প্রবেশ)

চর

মহারাজ, অগ্নিহােত্র, দেব উপাসনা,
ত্যাগ করি বিপ্রগণ, ছাড়ি সন্ধ্যার্চ্চনা,
দাঁড়ায়েছে চতুষ্পথে, পাণ্ডবের তরে
প্রতীক্ষিয়া;―পৌরগণ কেহ নাহি ঘরে,
পণ্যশালা রুদ্ধ সব; সন্ধ্যা হল তবু
ভৈরব মন্দির মাঝে নাহি বাজে প্রভু
শঙ্খঘণ্টা সন্ধ্যাভেরী, দীপ নাহি জ্বলে;―
শােকাতুর নরনারী সবে দলে দলে
চলিয়াছে নগরের সিংহদ্বার পানে
দীন বেশে সজল নয়নে।

দুর্য্যোধন

নাহি জানে,
জাগিয়াছে দুর্য্যোধন। মূঢ় ভাগ্যহীন!
ঘনায়ে এসেছে আজি তােদের দুর্দ্দিন।
রাজায় প্রজায় আজি হবে পরিচয়
ঘনিষ্ট কঠিন। দেখি কতদিন রয়
প্রজার পরম স্পর্দ্ধা,—নির্ব্বিষ সর্পের
ব্যর্থ ফণা-আস্ফালন,― নিরস্ত্র দর্পের
হুহুঙ্কার।

(প্রতিহারীর প্রবেশ)

প্রতিহারী

মহারাজ, মহিষী গান্ধারী
দর্শন প্রার্থিনী পদে।

ধৃতরাষ্ট্র


রহিনু তাঁহারি
প্রতীক্ষায়।

দুর্য্যোধন


পিতঃ আমি চলিলাম তবে।

(প্রস্থান)


ধৃতরাষ্ট্র


কর পলায়ন। হায় কেমনে বা সবে
সাধ্বী জননীর দৃষ্টি সমুদ্যত বাজ
ওরে পুণ্যভীত! মােরে তাের নাহি লাজ!

(গান্ধারীর প্রবেশ)


গান্ধারী


নিবেদন আছে শ্রীচরণে। অনুনয়
রক্ষা কর নাথ।

ধৃতরাষ্ট্র


কভু কি অপূর্ণ রয়
প্রিয়ার প্রার্থনা!

গান্ধারী

  ত্যাগ কর এইবার—

ধৃতরাষ্ট্র

কারে হে মহিষী!

গান্ধারী

  পাপের সংঘর্ষে যার
পড়িছে ভীষণ শানধর্ম্মের কৃপাণে
সেই মুঢ়ে।

ধৃতরাষ্ট্র

কে সে জন? আছে কোন্‌ খানে?
শুধু কহ নাম তার।

গান্ধারী

  পুত্র দুর্য্যোধন।

ধৃতরাষ্ট্র

তাহারে করিব ত্যাগ?}}

গান্ধারী

  এই নিবেদন
তব পদে।

ধৃতরাষ্ট্র

 দারুণ প্রার্থনা হে গান্ধারী
রাজমাতা!

গান্ধারী

এ প্রার্থনা শুধু কি আমারি
হে কৌরব? কুরুকুল-পিতৃ-পিতামহ
স্বর্গ হতে এ প্রার্থনা করে অহরহ
নরনাথ! ত্যাগ কর ত্যাগ কর তারে―
কৌরব-কল্যাণলক্ষ্মী যার অত্যাচারে
অশ্রুমুখী প্রতীক্ষিছে বিদায়ের ক্ষণ
রাত্রি দিন।

ধৃতরাষ্ট্র


ধর্ম্ম তারে করিবে শাসন
ধর্ম্মেরে যে লঙ্ঘন করেছে,―আমি পিতা―

গান্ধারী


মাতা আমি নহি? গর্ভভার-জর্জ্জরিতা
জাগ্রত হৃৎপিণ্ডতলে বহি নাই তারে?
স্নেহ-বিগলিত চিত্ত শুভ্র দুগ্ধধারে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে নাই দুই স্তন বাহি’
তার সেই অকলঙ্ক শিশুমুখ চাহি?
শাখাবন্ধে ফল যথা, সেই মত করি
বহু বর্ষ ছিল না সে আমারে আঁকড়ি
দুই ক্ষুদ্র বাহুবৃন্ত দিয়ে,—লয়ে টানি
মোর হাসি হতে হাসি, বাণী হতে বাণী
প্রাণ হতে প্রাণ?—তবু কহি, মহারাজ,
সেই পুত্র দুর্য্যোধনে ত্যাগ কর আজ।

ধৃতরাষ্ট্র

কি রাখিব তারে ত্যাগ করি?

গান্ধারী


ধর্ম্ম তব।

ধৃতরাষ্ট্র


কি দিবে তোমারে ধর্ম্ম?

গান্ধারী


দুঃখ নবনব।
পুত্রসুখ রাজ্যসুখ অধর্ম্মের পণে
জিনি লয়ে চিরদিন বহিব কেমনে
দুই কাঁটা বক্ষে আলিঙ্গিয়া?

ধৃতরাষ্ট্র


হায় প্রিয়ে,
ধর্ম্মবশে একবার দিনু ফিরাইয়ে
দ্যূতবদ্ধ পাণ্ডবের হৃত রাজধন।
পরক্ষণে পিতৃস্নেহ করিল গুঞ্জন
শতবার কর্ণে মোর―“কি করিলি ওরে!
এককালে ধর্ম্মাধর্ম্ম দুই তরী পরে
পা দিয়ে বাঁচে না কেহ। বারেক যখন
নেমেছে পাপের স্রোতে কুরুপুত্রগণ
তখন ধর্ম্মের সাথে সন্ধি করা মিছে,
পাপের দুয়ারে পাপ সহায় মাগিছে।

কি করিলি, হতভাগ্য, বৃদ্ধ, বুদ্ধিহত,
দুর্ব্বল দ্বিধায় পড়ি। অপমান-ক্ষত
রাজ্য ফিরে দিলে তবু মিলবে না আর
পাণ্ডবের মনে—শুধু নব কাষ্ঠভার
হুতাশনে দান। অপমানিতের করে
ক্ষমতার অস্ত্র দেওয়া মরিবার তরে।
সক্ষমে দিয়োনা ছাড়ি দিয়ে স্বল্প পীড়া,―
করহ দলন। কোরোনা বিফল ক্রীড়া
পাপের সহিত; যদি ডেকে আন তারে,
বরণ করিয়া তবে লহ একেবারে।”―
এই মত পাপবুদ্ধি পিতৃস্নেহরূপে
বিঁধিতে লাগিল মোর কর্ণে চুপে চুপে।
কত কথা তীক্ষ সূচিসম। পুনরায়
ফিরানু পাণ্ডবগণে,—দ্যূতছলনায়
বিসর্জ্জিনু দীর্ঘ বনবাসে। হায় ধর্ম্ম,
হায় রে প্রবৃত্তিবেগ! কে বুঝিবে মর্ম্ম
সংসারের।

গান্ধারী


ধর্ম্ম নহে সম্পদের হেতু
মহারাজ, নহে সে সুখের ক্ষুদ্র সেতু,―
ধর্ম্মেই ধর্ম্মের শেষ। মূঢ় নারী আমি,
ধর্ম্মকথা তোমারে কি বুঝাইব স্বামী,

জান ত সকলি। পাণ্ডবেরা যাবে বনে
ফিরাইলে ফিরিবে না, বদ্ধ তারা পণে,—
এখন এ মহারাজ্য একাকী তোমার
মহীপতি,―পুত্রে তব ত্যজ এইবার,―
নিষ্পাপেরে দুঃখ দিয়ে নিজে পূর্ণ সুখ
লইয়োনা,―ন্যায়ধর্ম্মে কোরোনা বিমুখ
পৌরব প্রাসাদ হতে,―দুঃখ সুদুঃসহ
আজ হতে ধর্ম্মরাজ লহ তুলি লহ
দেহ তুলি মোর শিরে।

ধৃতরাষ্ট্র


হায় মহারাণী,
সত্য তব উপদেশ, তীব্র তব বাণী।

গান্ধারী


অধর্ম্মের মধুমাখা বিষফল তুলি
আনন্দে নাচিছে পুত্র;―স্নেহমোহে ভুলি
সে ফল দিয়োনা তারে ভোগ করিবারে,
কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।
ছললব্ধ পাপস্ফীত রাজ্যধনজনে
ফেলে রাখি সেও চলে যাক্‌ নির্ব্বাসনে,
বঞ্চিত পাণ্ডবদের সমদুঃখভার
করুক্‌ বহন।

ধৃতরাষ্ট্র

ধর্ম্মবিধি বিধাতার,―
জাগ্রত আছেন তিনি, ধর্ম্মদণ্ড তাঁর
রয়েছে উদ্যত নিত্য,―অয়ি মনস্বিনী,
তাঁর রাজ্যে তাঁর কার্য্য করিবেন তিনি।
আমি পিতা―

গান্ধারী


তুমি রাজা, রাজ-অধিরাজ,
বিধাতার বামহস্ত;―ধর্মরক্ষা কাজ
তােমা পরে সমর্পিত। শুধাই তােমারে
যদি কোন প্রজা তব, সতী অবলারে
পরগৃহ হতে টানি করে অপমান
বিনা দোষে—কি তাহার করিবে বিধান?

ধৃতরাষ্ট্র


নির্ব্বাসন।

গান্ধারী


তবে আজ রাজ-পদতলে
সমস্ত নারীর হয়ে নয়নের জলে
বিচার প্রার্থনা করি। পুত্র দুর্য্যোধন
অপরাধী প্রভু! তুমি আছ, হে রাজন্,
প্রমাণ আপনি। পুরুষে পুরুষে দ্বন্দ্ব
স্বার্থ লয়ে বাধে অহরহ,―ভাল মন্দ

নাহি বুঝি তার,―দণ্ডনীতি, ভেদনীতি,
কূটনীতি কতশত,—পুরুষের রীতি
পুরুষেই জানে। বলের বিরােধে বল,
ছলের বিরােধে কত জেগে উঠে ছল,
কৌশলে কৌশল হানে,—মােরা থাকি দূরে
আপনার গৃহকর্ম্মে শান্ত অন্তঃপুরে।
যে সেথা টানিয়া আনে বিদ্বেষ অনল
বাহিরের দ্বন্দ্ব হতে,—পুরুষেরে ছাড়ি
অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া নিরুপায় নারী
গৃহধর্ম্মচারিণীর পুণ্যদেহ পরে
কলুষ-পুরুষ স্পর্শে অসম্মানে করে
হস্তক্ষেপ,—পতি সাথে বাধায়ে বিরােধ
যে নর পত্নীরে হানি লয় তার শােধ
সে শুধু পাষণ্ড নহে, সে যে কাপুরুষ।
মহারাজ, কি তার বিধান! অকলুষ
পুরুবংশে পাপ যদি জন্মলাভ করে
সেও সহে,—কিন্তু প্রভু, মাতৃগর্ব্বভরে
ভেবেছিনু গর্ভে মোর বীরপুত্রগণ
জন্মিয়াছে,—হায় নাথ, সে দিন যখন
অনাথিনী পাঞ্চাণীর আর্ত্তকণ্ঠরব
প্রাসাদ-পাষাণ-ভিত্তি করি দিল দ্রব
লজ্জা ঘৃণা করুণার তাপে,—ছুটি গিয়া
হেরিনু গবাক্ষে, তার বস্তু আকর্ষিয়া
খল খল হাসিতেছে সভামাঝখানে

গান্ধারীর পুত্র পিশাচেরা,―ধর্ম্ম জানে
সে দিন চূর্ণিয়া গেল জন্মের মতন
জননীর শেষ গর্ব্ব। কুরুরাজগণ!
পৌরুষ কোথায় গেছে ছাড়িয়া ভারত।
তােমরা, হে মহারথী জড়মুর্ত্তিবৎ
বসিয়া রহিলে সেথা চাহি মুখে মুখে
কেহ বা হাসিলে, কেহ করিলে কৌতুকে
কানাকানি,―কোষমাঝে নিশ্চল কৃপণ
বজ্র-নিঃশেষিত লুপ্ত বিদ্যুৎ সমান
নিদ্রাগত।―মহারাজ, শুন মহারাজ
এ মিনতি। দূর কর জননীর লাজ,
বীরধর্ম্ম করহ উদ্ধার, পদাহত
সতীত্বের ঘুচাও ক্রন্দন, অবনত
ন্যায়ধর্ম্মে করহ সম্মান,―ত্যাগ কর
দুর্য্যোধনে।

ধৃতরাষ্ট্র


পরিতাপ-দহনে জর্জ্জর
হৃদয়ে করিছ শুধু নিষ্ফল আঘাত
হে মহিষী!

গান্ধারী


শতগুণ বেদনা কি, নাথ,
লাগিছে না মােরে? প্রভু, দণ্ডিতের সাথে

দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে
সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। যার তরে প্রাণ
কোন ব্যথা নাহি পায় তারে দণ্ডদান
প্রবলের অত্যাচার। যে দণ্ডবেদনা
পুত্রেরে পার না দিতে সে কারে দিয়ােনা,―
যে তোমার পুত্র নহে তারো পিতা আছে,
মহা অপরাধী হবে তুমি তার কাছে।
বিচারক। শুনিয়াছি বিশ্ববিধাতার
সবাই সন্তান মােরা,―পুত্রের বিচার
নিয়ত করেন তিনি আপনার হাতে
নারায়ণ; ব্যথা দেন, ব্যথা পান সাথে,
নতুবা বিচারে তাঁর নাই অধিকার,―
মূঢ় নারী লভিয়াছি অন্তরে আমার
এই শাস্ত্র।—পাপী পুত্রে ক্ষমা কর যদি
নির্ব্বিচারে, মহারাজ, তবে নিরবধি
যত দণ্ড দিলে তুমি যত দোষী জনে
ফিরিয়া লাগিবে আসি দণ্ডদাতা ভূপে,―
ন্যায়ের বিচার তব নির্ম্মমতারূপে
পাপ হয়ে তােমারে দাগিবে। ত্যাগ কর
পাপী দুর্য্যোধনে।

ধৃতরাষ্ট্র


প্রিয়ে, সংহর, সংহর,
তব বাণী। ছিঁড়িতে পারিনে মোহডাের,

ধর্ম্মকথা শুধু আসি হানে সুকঠোর
ব্যর্থ ব্যথা। পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার,
তাই তারে ত্যজিতে না পারি,—আমি তার
একমাত্র; উন্মত্ত তরঙ্গ মাঝখানে
যে পুত্র সঁপেছে অঙ্গ তারে কোন্ প্রাণে
ছাড়ি যাব।—উদ্ধারের আশা ত্যাগ করি,
তবু তারে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরি,
তারি সাথে এক পাপে ঝাঁপ দিয়া পড়ি,
এক বিনাশের তলে তলাইয়া মরি
অকাতরে,—অংশ লই তার দুর্গতির,
অর্দ্ধ ফল ভােগ করি তার দুর্ম্মতির,―
সেই ত সান্ত্বনা মাের,—এখন ত আর
বিচারের কাল নাই—নাই প্রতিকার,
নাই পথ,—ঘটেছে যা ছিল ঘটিবার,
ফলিবে যা ফলিবার আছে।

(প্রস্থান)


গান্ধারী।


হে আমার
অশান্ত হৃদয়, স্থির হও। নতশিরে
প্রতীক্ষা করিয়া থাক বিধির বিধিরে
ধৈর্য্য ধরি। যে দিন সুদীর্ঘ রাত্রি পরে
সদ্য জেগে উঠে কাল, সংশোধন করে

আপনারে, সেদিন দারুণ দুঃখদিন।
দুঃসহ উত্তাপে যথা স্থির গতিহীন
ঘুমাইয়া পড়ে বায়ু—জাগে ঝঞ্ঝাঝড়ে
অকস্মাৎ, আপনার জড়ত্বের পরে
করে আক্রমণ, অন্ধ বৃশ্চিকের মত
ভীমপুচ্ছে আত্মশিরে হানে অবিরত
দীপ্ত বজ্রশূল, সেই মত কাল যবে
জাগে, তারে সভয়ে অকাল কহে সবে।
লুটাও লুটাও শির, প্রণম, রমণী,
সেই মহাকালে; তার রথচক্রধ্বনি
দূব রুদ্রলােক হতে বজ্র-ঘর্ঘরিত
ওই শুনা যায়। তাের আর্ত্ত জর্জ্জরিত
হৃদয় পাতিয়া রাখ্ তার পথতলে।
ছিন্ন সিক্ত হৃৎপিণ্ডের রক্ত শতদলে
অঞ্জলি রচিয়া থাক্‌ জাগিয়া নীরবে
চাহিয়া নিমেষহীন।―তার পরে যবে
গগনে উড়িবে ধূলি, কাঁপিবে ধরণী,
সহসা উঠিবে শূন্যে ক্রন্দনের ধ্বনি―
হায় হায় হা রমণী, হায় রে অনাথা,
হায় হায় বীরবধূ, হায় বীরমাতা,
হায় হায় হাহাকার—তখন সুধীরে
ধূলায় পড়িস্ লুটি’ অবনত শিরে
মুদিয়া নয়ন।―তার পরে নমো নমঃ
সুনিশ্চিত পরিণাম, নির্ব্বাক নির্ম্মম

দারুণ করুণ শান্তি; নমো নমাে নমঃ
কল্যাণ কঠোর কান্ত, ক্ষমা স্নিগ্ধতম।
নমো নমো বিদ্বেষের ভীষণা নির্ব্বৃতি।
শ্মশানের ভস্মমাখা পরমা নিষ্কৃতি।

(দুর্য্যোধন-মহিষী ভানুমতীর প্রবেশ)


ভানুমতী


(দাসীগণের প্রতি)


ইন্দুমুখি! পরভৃতে! লহ তুলি শিরে
মাল্যবস্ত্র অলঙ্কার।

গান্ধারী


বৎসে, ধীরে! ধীরে!
পৌরব ভবনে কোন্ মহােৎসব আজি!
কোথা যাও নব বস্ত্রঅলঙ্কারে সাজি
বধূ মাের?

ভানুমতী


শত্রুপরাভব-শুভক্ষণ
সমাগত।

গান্ধারী


শত্রু যার আত্মীয় স্বজন
আত্মা তার নিত্য শত্রু, ধর্ম্ম শত্রু তার,

অজেয় তাহার শত্রু। নব অলঙ্কার
কোথা হতে, হে কল্যাণি!

ভানুমতী


জিনি বসুমতী
ভুজবলে, পাঞ্চালীরে তার পঞ্চপতি
দিয়েছিল যত রত্ন মণি অলঙ্কার,
যজ্ঞদিনে যাহা পরি ভাগ্য-অহঙ্কার
ঠিকরিত’ মাণিক্যের শত সূচীমুখে
দ্রৌপদীর অঙ্গ হতে,—বিদ্ধ হ’ত বুকে
কুরুকুলকামিনীর—সে রত্নভূষণে
আমারে সাজায়ে তারে যেতে হল বনে।

গান্ধারী


হা রে মূঢ়, শিক্ষা তবু হল না তোমার,
সেই রত্ন নিয়ে তবু এত অহঙ্কার।
একি ভয়ঙ্করী কান্তি, প্রলয়ের সাজ।
যুগান্তের উল্কাসম দহিছে না আজ
এ মণি-মঞ্জীর তোরে? রত্ন-ললাটিকা
এ যে তোর সৌভাগ্যের বজ্রানলশিখা।
তোরে হেরি অঙ্গে মোর ত্রাসের স্পন্দন
সঞ্চারিছে,—চিত্তে মোর উঠিছে ক্রন্দন,―
আনিছে শঙ্কিত কর্ণে, তোর অলঙ্কার
উন্মাদিনী শঙ্করীর তাণ্ডব-ঝঙ্কার।

ভানুমতী

মাতঃ মােরা ক্ষত্রনারী! দুর্ভাগ্যের ভয়
নাহি করি। কভু জয়, কভু পরাজয়,―
মধ্যাহ্ন গগনে কভু, কভু অস্তধামে
ক্ষত্রিয়মহিমা সূর্য্য উঠে আর নামে।
ক্ষত্রবীরাঙ্গনা মাতঃ সেই কথা স্মরি
শঙ্কার বক্ষেতে থাকি সঙ্কটে না ডরি
ক্ষণকাল। দুর্দ্দিন-দুর্য্যোগ যদি আসে,
বিমুখ ভাগ্যেরে তবে হানি’ উপহাসে
কেমনে মরিতে হয় জানি তাহা দেবি,
কেমনে বাঁচিতে হয়, শ্রীচরণ সেবি’
সে শিক্ষাও লভিয়াছি।

গান্ধারী।


বৎসে, অমঙ্গল
একেলা তােমার নহে। লয়ে দলবল
সে যবে মিটায় ক্ষুধা, উঠে হাহাকার,
কত বীর-রক্তস্রাতে কত বিধবার
অশ্রুধারা পড়ে আসি―রত্ন অলঙ্কার
বধূহস্ত হতে খসি পড়ে শত শত
চূতলতা-কুঞ্জবনে মঞ্জরীর মত
ঝঞ্চাবাতে। বৎসে, ভাঙিয়োনা বদ্ধ সেতু!
ক্রীড়াচ্ছলে তুলিয়ােনা বিপ্লবের কেতু

গৃহমাঝে। আনন্দের দিন নহে আজি।
স্বজন-দুর্ভাগ্য লয়ে সর্ব্ব অঙ্গে সাজি
গর্ব্ব করিয়ো না মাতঃ! হয়ে সুসংযত
আজ হতে শুদ্ধচিত্তে উপবাসব্রত
কর আচরণ,—বেণী করি উন্মোচন
শান্ত মনে কর বৎসে দেবতা-অর্চ্চন।
এ পাপ-সৌভাগ্য দিনে গর্ব্ব-অহঙ্কারে
প্রতিক্ষণে লজ্জা দিয়ােনাক বিধাতারে।
খুলে ফেল অলঙ্কার, নব রক্তাম্বর,
থামাও উৎসরবাদ্য, রাজআড়ম্বর,
অগ্নিগৃহে যাও, পুত্রি, ডাক পুরােহিতে,
কালেরে প্রতীক্ষা কর শুদ্ধসত্ত্ব চিতে।

(ভানুমতীর প্রস্থান)

(দ্রৌপদীসহ পঞ্চপাণ্ডবের প্রবেশ)


যুধিষ্ঠির


আশীর্বাদ মাগিবারে এসেছি জননী
বিদায়ের কালে।

গান্ধারী


সৌভাগ্যের দিনমণি
দুঃখরাত্রি-অবসানে দ্বিগুণ উজ্জ্বল
উদিবে হে বৎসগণ! বায়ু হতে বল,

সূর্য্য হতে তেজ, পৃথা হতে ধৈর্য্যক্ষমা
কর লাভ, দুঃখব্রত পুত্র মাের! রমা
দৈন্যমাঝে গুপ্ত থাকি দীন ছদ্মরূপে
ফিরুন্ পশ্চাতে তব, সদা চুপে চুপে।
দুঃখ হতে তােমা তরে করুন্ সঞ্চয়
অক্ষয় সম্পদ। নিত্য হউক্‌ নির্ভয়
নির্ব্বাসনবাস।—বিনা পাপে দুঃখভােগ
অন্তরে জ্বলন্ত তেজ করুক্ সংযােগ―
বহ্নিশিখাদগ্ধ দীপ্ত সুবর্ণের প্রায়।
সেই মহদুঃখ হবে মহৎ সহায়
তােমাদের।—সেই দুঃখে রহিবেন ঋণী
ধর্ম্মরাজ বিধি,—যবে শুধিবেন তিনি
নিজহস্তে আত্মঋণ, তখন জগতে
দেবনর কে দাঁড়াবে তােমাদের পথে।
মাের পুত্র করিয়াছে যত অপরাধ
খণ্ডন করুক্‌ সব মাের আশীর্ব্বাদ
পুত্রাধিক পুত্রগণ! অন্যায় পীড়ন
গভীর কল্যাণসিন্ধু করুক্‌ মন্থন।

(দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন পূর্ব্বক)


ভূলুণ্ঠিতা স্বর্ণলতা, হে বৎসে আমার,
হে আমার রাহুগ্রস্ত শশি! একবার
তােল শির, বাক্য মাের কর অবধান।
যে তােমারে অবমানে তারি অপমান

জগতে রহিবে নিত্য, কলঙ্ক অক্ষয়।
তব অপমানরাশি বিশ্বজগন্ময়
ভাগ করে লইয়াছে সর্ব্ব কুলাঙ্গনা
কাপুরুষতার হস্তে সতীর লাঞ্ছনা।
যাও বৎসে, পতি সাথে অমলিন মুখ,
অরণ্যেরে কর স্বর্গ, দুঃখে কর সুখ।
বধূ মাের, সুদুঃসহ পতিদুঃখব্যথা
বক্ষে ধরি, সতীত্বের লভ সার্থকতা।
রাজগৃহে আয়ােজন দিবস যামিনী
সহস্র সুখের; বনে তুমি একাকিনী
সর্ব্বসুখ, সর্ব্বসঙ্গ, সর্বৈশ্বর্য্যময়,
সকল সান্ত্বনা একা সকল আশ্রয়,
ক্লান্তির আরাম শান্তি, ব্যাধির শুশ্রূষা,
দুর্দ্দিনের শুভলক্ষ্মী, তামসীর ভূষা
ঊষা মুর্ত্তিমতী। তুমি হবে একাকিনী
সর্ব্বপ্রীতি, সর্ব্বসেবা, জননী, গেহিনী,―
সতীত্বের শ্বেতপদ্ম সম্পূর্ণ সৌরভে
শতদলে প্রস্ফুটিয়া জাগিবে গৌরবে।