গল্পস্বল্প/সুবুদ্ধির উপদেশ

সুবুদ্ধির উপদেশ।

বস্তু নিঃশ্রেয়সং বাক্যং মােহান্ন প্রতিপদ্যতে।
স দীর্ঘসূত্রেহীনার্থঃ পশ্চাত্তাপেন যুজ্যতে।

 যে ব্যক্তি মোহহেতু হিতবাক্য গ্রহণ না করে সে দীর্ঘসূত্রী হইয়া মনুষ্যত্ব হইতে ভ্রষ্ট হয় এবং পশ্চাৎ সন্তাপে পতিত হয়।


 মনুষ্যের দুইরূপ বুদ্ধি আছে—সুবুদ্ধি ও কুবুদ্ধি। যে বুদ্ধি আমাদিগকে শুভ কর্ম্মে উত্তেজিত ও অন্যায় কর্ম্ম হইতে বিরত রাখে তাহাই সুবুদ্ধি, আর যে বুদ্ধির দ্বারা আমরা অন্যায় কাজ করি তাহাই কুবুদ্ধি। কুবুদ্ধির পরামর্শ শুনিয়া চলিলে তুমি পশুর মত হইয়া পড়িবে, সুবুদ্ধির পরামর্শ শুনিলে তােমার ধর্ম্মভাব ফুটিয়া উঠিবে, তুমি মনুষ্যত্ব লাভ করিবে। সুতরাং সাবধানে কুবুদ্ধিকে পরিত্যাগ করিয়া সুবুদ্ধির অনুসরণ করিও।


 একটি সুন্দর বাগানে লাবণ্য বসিয়া আছে। চারিদিকে কত রকম ফুল ফুটিয়াছে, কত ফোয়ারা ছুটিতেছে, সুন্দর সুন্দর পাথরের পুতুল সাজান রহিয়াছে। কিন্তু লাবণ্যের সে সব কোন দিকেই মন নাই, তাহার হাতের একটি পুতুল লইয়াই সে ব্যস্ত। সে কখনও তাহাকে কাপড় পরাইতেছে, কখনও আদর করিতেছে, কখনও তাহার সহিত কথা কহিতেছে। এমন সময় সহসা যেন আকাশের একটা দিক অত্যন্ত লাল হইয়া উঠিল। লাবণ্য আশ্চর্য হইয়া সেই দিকে চাহিল অমনি লাল মেঘের মধ্য হইতে যেন একটা পরী নামিয়া আসিয়া তাহার কাছে দাঁড়াইলেন। লাবণ্য আরও আশ্চর্য্য হইয়া স্থিরদৃষ্টে পরীর মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল। ক্রমে তাহার চক্ষে সকলি মিলাইয়া যাইতে লাগিল, গাছ পাতা, ফুল, ফোয়ারা, সকলি মিলাইয়া গেল, পৃথিবী আকাশ সমস্ত সরিয়া পড়িল;— কেবল সেই পরীর প্রতিমাখানি ভিন্ন আর কিছুই সে দেখিতে পাইল না। কিন্তু এ আবার কি? পরীমুর্ত্তিও যে অদৃশ্য হইয়া পড়িল! তখন তাহার আবার চমক ভাঙ্গিল, সবিস্ময়ে সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল,—সে পরী নাই, সে বাগান নাই—সে কিছুই আর নাই, তাহা অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর আর একটি বাগানে সে একাকী আসিয়া পড়িয়াছে। কি চমৎকার বাগান। এমন বাগান সে জন্মে কখনও দেখে নাই। এ কি নন্দন কানন? দিদিমার কাছে লাবণ্য স্বর্গের যে নন্দন কাননের গল্প শুনিয়াছে, এ কি সেই কানন! বাগান আলো করিয়া গাছে গাছে কি সুন্দর ফুল ফুটিয়া আছে! ও গুলি কি পারিজাত? অমন চমৎকার ফুল ত লাবণ্য জীবনে কখনো দেখে নাই। কি শোভা! কি সুবাস। সরোবর তীরে ও আবার কিরূপ বন? ও যে ফুলের বন? ফুলে ফুলে দলে দলে ঘেঁষাঘেষি করিয়া মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া রহিয়াছে! এত ফুল ওখানে কে ফুটাইল? সরোবরের পদ্মপত্রে ঐ রাঙ্গা পাখীগুলি—কি পাখী? ময়ূর না হাঁস? না উহারা ময়ূরও নহে—হাঁসও নহে, উহার যে গান করিতেছে! কি মধুর সঙ্গীত!—এ কাননের কোকিল এমন সুন্দর দেখিতে! তাহারা পদ্মপত্রে ভাসিয়া গান গাহিয়া বেড়ায়। লাবণ্য উল্লাসে উৎফুল্ল হইয়া পুতুলটিকে বক্ষে লইয়া বাগানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। বেড়াইতে বেড়াইতে দেখিল, বাগানের এই নানা রকম সুগন্ধ সুদৃশ্য অপরিচিত পুষ্পবৃক্ষের এক পাশে একটি গোলাপের গাছ, সেই গাছে একটি সুন্দর প্রস্ফুটিত গোলাপ। লাবণ্য সেই গোলাপটি তুলিতে হাত বাড়াইল! এই সময় সহসা কোথা হইতে পূর্ব্বেকার পরীটি আসিয়া বলিলেন, “ইহা তুলিও না, ঐ দেখ কত ধৈর্য্য ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে—উহার একটি তোল, গোলাপ অপেক্ষা দেখ ঐ ফুলগুলি কত সুন্দর। গোলাপ ত তোমাদের বাগানে অনেক আছে। ঐ ধৈর্য্যফুল একটি তুলিয়া লইয়া যাও, উহা মর্ত্ত্যলোকে পাইবে না, ও ফুল তোমাদের বাগানে রাখিলে বাগান শোভা করিয়া চিরদিন নবীন ভাবে ফুটিয়া থাকিবে। উহা নন্দন কাননের ফুল, পৃথিবীর ফুলের মত শুকাইয়া যায় না। আর ঐ গোলাপের গাছ পৃথিবী হইতে আনিয়া এ কাননে রোপণ করা হইয়াছে, তুলিতে না তুলিতে শুকাইবে।”

 কিন্তু লাবণ্য তখন গোলাপ তুলিতে হাত বাড়াইয়াছে— হাতের ফুল ফেলিয়া কে আবার তখন দূরে যায়, সে বলিল— “অত দূরে আমি আর যাইতে পারি না”—বলিয়া তাড়াতাড়ি গোলাপটি ছিঁড়িয়া লইল,—তাড়াতাড়িতে গোলাপের কাঁটায় বিঁধিয়া তাহার হাত হইতে বিন্দু বিন্দু রক্তপড়িতে লাগিল, তখন সে গোলাপটি ফেলিয়া দিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল। ' পরী বলিলেন “দেখ আমার কথা শুনিলে তোমাকে এই কষ্টভোগ করিতে হইতনা—ঐ যে ধৈর্য্যফুল দেখিতেছ উহার কাঁটা নাই। ভাল কথা না শুনিয়া কাজ করিলে দেখ কি রূপ বিপদে পড়িতে হয়—”

 পরীর এই উপদেশে লাবণ্য আরো রাগিয়া গেল, সে কাহারো উপদেশ শুনিতে ভাল বাসিত না। লাবণ্য রাগ করিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল। কিছু দূর গিয়া একবার ফিরিয়া দেখিল—পূর্ব্বের বাগানের আর চিহ্ণও নাই, তাহা হইতে অনেক দূরে সে চলিয়া আসিয়াছে। তাহার বড় কষ্ট হইল। এই সময় সে নিকট দিয়া একটি বালককে চলিয়া যাইতে দেখিয়া বলিল “ভাই, এতক্ষণ বড় একটি সুন্দর বাগানে খেলা করিতেছিলাম—রাগ করিয়া চলিয়া আসিয়া ভাল করি নাই, আমাকে পথ দেখাইয়া সেখানে আবার লইয়া যাইতে পার?”

 বালক বলিল “আমাদের এখানে ত কোন বাগান নাই— কোথায় লইয়া যাইব?” বালিকা আবার রাগ করিয়া বলিল “নাই বই কি? আমি এই মাত্র সেখান হইতে আসিতেছি। সেখানে ফুল তুলিতে গিয়া এই দেখ আমার হাতে কাঁটা বিঁধিয়া গিয়াছে—”

 বালক বলিল—“পরী তোমাকে এত বারণ করিলেন, তুমি কেন ফুল তুলিতে গেলে? তিনি ত তোমার ভালর জন্যই বারণ করিয়াছিলেন, তাঁহার কথা ত শুনিলেই না—আবার রাগ করিয়া চলিয়া আসিলে—এ জন্য তোমার নিতান্ত লজ্জা পাওয়া উচিত।”

 কিন্তু লজ্জিত হইবার পরিবর্ত্তে লাবণ্য তাহার কথায় ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল। পথে তাহার আর একটি বালিকার সহিত সাক্ষাৎ হইল—বালিকা তাহার হাতের পুতুলটি দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল—“ভাই তোমার হাতে ওটি কি?”

 লাবণ্য বলিল—“আমার পুতুল।”

 বা। এটি আমাকে দিবে?

 লা। না।

 বালিকা বলিল—“না বই কি” বলিয়া জোর করিয়া লাবণ্যেরর হাত হইতে পুতুলটি কাড়িয়া লইল, লাবণ্য তাহার জোরে পারিল না পুতুলটি হারাইয়া তাহার বড় কষ্ট হইল—সে কাঁদিয়া ফেলিল। চক্ষু দিয়া জল পড়িবা মাত্র অমনি তাহার আর একটি ঘটনা মনে পড়িয়া গেল, এতক্ষণ সে কথা এক মুহুর্ত্তের জন্যও তাহার মনে হয় নাই। লাবণ্যের মনে পড়িল—পুতুলটি তাহার নহে, তাহার ছোট বোন মালতীর। মালতী প্রথম ভাগ শেষ করিয়াছে তাই মা আহ্লাদ করিয়া এই পুতুলটি আজ সকালে তাহাকে পুরস্কার দিয়াছেন। লাবণ্য তাহা দেখিয়া মায়ের কাছে তখনি পুতুল চাহে—মা বলেন—“বাছা তোমাকেও ত আমি তোমার প্রথম ভাগ শেষ হইলে এইরূপ একটি পুতুল দিয়াছি। আবার দ্বিতীয় ভাগ শেষ হইলে আর একটি দিব, তুমি যত্ন করিয়া বইখানি শেষ কর দেখি”—

 কিন্তু দ্বিতীয় ভাগ শেষ করা পর্য্যন্ত অতদিন ধৈর্য্য সহকারে পুতুলের জন্য অপেক্ষা করা লাবণ্যের কাজ নহে; সে সেইদিনই জোর করিয়া মালতীর পুতুলটি কাড়িয়া লইল। বেচারা মালতী তাহার সহিত পারিল না, কাঁদিয়া নিরস্ত হইল। লাবণ্য আরো বলিল—“যদি মাকে এ কথা বলিস্ ত তোকে মারিব।” মালতী তাই ভয়ে ভয়ে সে কথা মাকেও বলিল না।

 সকালের এই ঘটনা এখন লাবণ্যের সমস্ত মনে পড়িয়া গেল। পুতুল কাড়িয়া লওয়ায় মালতীর কত কষ্ট হইয়াছিল লাবণ্য তাহা এখন বুঝিতে পালি, তাহার বড়ই অনুতাপ হইতে লাগিল, পুতুলটি বোনকে ফিরাইয়া দিতে সে ব্যগ্র হইয়া উঠিল—কিন্তু পুতুলটি এখন সে কোথায় পাইবে—তাহা আর এখন লাবণ্যের নহে, আর একজন কাড়িয়া লইয়াছে। এই সময় সেই পরী পুতুলটি হাতে করিয়া তাহার নিকট আসিয়া দাঁড়াইলেন। লাবণ্য তখন কাঁদিতে কাঁদিতে পরীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বোনকে পুতুলটি-ফিরাইয়া দিবার ইচ্ছায় তাঁহার নিকট তাহা চাহিয়া লইল।

 পুতুলটি হাতে পাইবা মাত্র তাহার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল, দেখিল কোথায় বা পরী কোথায় বা বাগান, পুতুলটিকে কোলে করিয়া যেখানে সে শুইয়া পড়িয়াছিল—সেইখানেই শুইয়া আছে।

 লাবণ্য জাগিয়া তাড়াতাড়ি উঠিল, উঠিয়া পুতুলটি লইয়া তখনি মালতীকে ফিরাইয়া দিল, এবং সেই পর্য্যন্ত আর সে ভাই বোনকে কাঁদাইয়া তাহাদের কোন খেলেনা পত্র লইত না, ধৈর্য্যসহকারে ভাল সময়ের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিত।


 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, যে বুদ্ধি আমাদিগকে শুভ কর্ম্মে চালিত ও অন্যায় কর্ম্ম হইতে বিরত করে তাহাই সুবুদ্ধি।

 লাবণ্যের সুবুদ্ধির উদ্রেক হওয়াতেই লাবণ্য এইরূপ স্বপ্ন দেখিয়াছিল, এবং এই বুদ্ধির অনুসরণ করিয়াই লাবণ্য পরে ভাল হইল। লাবণ্যের মত সকলেরি সুবুদ্ধির অনুসরণ করিয়া চলা কর্ত্তব্য।