চিঠিপত্র (দশম খণ্ড, ১৯৬৭)/দীনেশচন্দ্র সেন —লিখিত পত্রাবলী/৫

২৮ নং শ্যামপুকুর ষ্ট্রীট
কলিকাতা
২৬শে আগষ্ট ১৯০০

পরম শ্রদ্ধাস্পদেষু

 বহুদিন হয় মহাশয়ের অপূর্ব্ব গীতিকাব্য ক্ষণিকা উপহার পাইয়া সম্মানিত হইয়াছি কিন্তু নিতান্ত পীড়িত থাকায় এ পর্যন্ত ক্ষণিকার দৈব প্রতিভাশালী কবির প্রতি চিত্তের ঐকান্তিক অনুরাগ ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিবার আনন্দ লাভ করিতে পারি নাই। আমার স্নায়ব দুর্ব্বলতা এতদুর বৃদ্ধি পাইয়াছে যে একখানি সামান্য পত্র লিখিলেও অবসন্ন হইয়া পড়ি।

 ক্ষণিকা সামাজিক হিসাবে একটুকু উচ্ছৃঙ্খল এবং বোধ হয় তজ্জন্যই উহা বিশেষরূপ উপাদেয় হইয়াছে। আমাদের মায়াবাদী সমাজ, রূপ মিথ্যা, জীবন মিথ্যা, যৌবন মিথ্যা প্রভৃতি সংস্কারাধীন হইয়া বাগ্দেবীর প্রবেশ একরূপ রোধ করিয়া রাখিয়াছি বলিলে অত্যুক্তি হয় না। যে স্থানে সংসারের সকলই মিথ্যা, সেখানে কবি কোন্ সৌন্দর্য্য উপভোগ করিবেন! আপনার দৈব কবিত্ব পৃথিবীর প্রতি সৌন্দর্য্যটুকুর আস্বাদ অঙ্গীকার করিয়া এই তত্ত্বকণ্টকসংকুল সংসারকে ক্ষণেকের জন্য আবাস যোগ্য করিয়া তুলিয়াছে। কবির সুখের হাস্যে আমাদের ‘নশ্বর’ ‘অসার’ সংসার মুখরিত হইয়া নবশ্রী লাভ করিয়াছে এবং মায়াবাদ যেন আপনা হইতে লজ্জিত হইয়া পড়িয়াছে। কবির উচ্ছৃঙ্খলতায় নব জীবনের আনন্দ সূচিত হইয়াছে এবং উষর দুঃখময় ক্ষেত্রে গঙ্গাধারার ন্যায় একটি পুণ্য প্রবাহ সঞ্চারিত করিয়াছে। কবি অশ্লেষাতে যাত্রা করিয়া অসময়ে অপথে চলিয়াছেন, শপথ করিয়া বিপথ ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন, মাতাল হইয়া গান গাহিয়াছেন, শুষ্ক ঋষির চিত্তে ও জ্যামিতির সূত্রে সত্যের আলয় নির্দ্দেশ করিয়া “মিথ্যা যদি মধুর রূপে, আসত কাছে চুপে চুপে, তাহা হ’লে কাহার হত ক্ষতি। স্বপ্ন যদি ধরত সে মুরতি।” বলিয়া কল্পনার সৌন্দর্য্য অঙ্গীকার করিয়াছেন, পুষ্প পল্লব শোভিত, আলোক চূর্ণ বিক্ষেপে উজ্জ্বল বনের সৌন্দর্য্য সম্যক রূপে উপলব্ধি করিয়া যৌবনের জন্য বানপ্রস্থের ব্যবস্থা করিয়াছেন, কবি কলঙ্ক ও নিন্দাপঙ্কে তিলক টানিয়া হাসিতে হাসিতে প্রেমের গীতি গাহিয়াছেন, গীতিগুলির সর্ব্বত্রই উচ্ছৃঙ্খলতা ও সৌন্দর্য্য। এই অসংযতবাক্ অথচ সুন্দর কবিকে সামাজিকগণ কি বলিবেন? ইহার রমণীয়তা প্রতিরোধ করিবার উপায় নাই। ইনি হাসিয়া গাহিয়া চিত্ত অধিকার করিবেন, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের প্রাচীন পুঁথি ছিঁড়িয়া তাঁহাদের টিকি ধরিয়া টানা হেঁচড়া করিবেন, ইহাকে কে কি বলিবে? ইনি অতৃপ্তির চক্ষু তৃপ্তির ফুলশার দ্বারা বিঁধাইয়া শিক্ষা দিয়াছেন অতীত ও ভবিষ্যত হইতে বর্ত্তমানই শ্রেষ্ঠ। এই মুহূর্ত্তের শ্রেষ্ঠত্বের বিজ্ঞাপনী লইয়া ক্ষণিকা আমাদের নিকট আসিয়াছে। কিন্তু ঈষৎ বিদ্রূপাত্মক, প্রকৃত সৌন্দর্য্যের প্রতি কটাক্ষক্ষেপী আপাতচপল কবি মধ্যে মধ্যে যে সুগভীর রাগিণী জাগাইয়াছেন, তাহা ক্ষণিকায় ক্ষণ স্বপ্নকে গূঢ় তত্ত্বসমাবেশে মহান করিয়া তুলিয়াছে। “অন্তরতম” শীর্ষক কবিতার গুরুত্ব অনেক বিপুলকায় কাব্যও বহন করে না।

 আমার শরীর অসুস্থ। লিখিতে অত্যন্ত কষ্ট হয়। হৃদয়ের আনন্দ কিছুই ব্যক্ত করিতে সক্ষম হইলাম না।

 “বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে”র পুনর্মুদ্রণের জন্য, কলিকাতা আসিয়াছি। আশা করি মহাশয় কুশলে আছেন,— আমার সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা গ্রহণ করিবেন।

বিনীত নিবেদক
শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন