চিঠিপত্র (দশম খণ্ড, ১৯৬৭)/দীনেশচন্দ্র সেন —লিখিত পত্রাবলী/৭

[অগ্রহায়ণ ১৩২৫]

ভক্তিভাজনেষু,

 আমার এখন হিসাব-নিকাশের সময় আসিয়াছে। আপনার কাছে আজ উপস্থিত হওয়ার তাহাও অন্যতম কারণ।

 পারিবারিক কথা লইয়া যদি কোন সময়ে আমার সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটিয়া থাকে, অবশ্যই এতদিনে সে মেঘ কাটিয়া গিয়াছে। বিশেষ যেদিন আপনি লিখিয়াছেন “যে কেহ মোরে দিয়েছে দুঃখ, চিনিয়েছে পথ তাঁর, তাহারে নমি আমি” সে দিনই আপনার শত্রুরা আপনার নিকট হার মানিয়াছে এবং নিতান্ত ছোট হইয়া গিয়াছে। আমি কোন সময়ে যদি আপনার মনে কষ্ট দিয়া থাকি, তজ্জন্য অনুতপ্ত আছি। তবে আমি যদি কিছু বলিয়া থাকি, তাহা ইচ্ছাকৃত নহে, সাময়িক উত্তেজনার ফলে এবং আমি কখনও আপনার নিন্দুকের দলে মিশি নাই। যাহা হউক আমি আপনাকে প্রণামপূর্ব্বক পুনরায় নিবেদন করিতেছি যে আমার ত্রুটি ক্ষমা করিবেন।

 আমার ‘নীলমাণিক’ নামক একখানা ছোট বই কয়েকদিন হয় আপনার নিকট পাঠান হইয়াছে। এই বইখানি সম্ভবতঃ আপনার ভাল লাগে নাই। কিন্তু আমি আপনার নিকট শিক্ষার্থী এবং চিরদিনই উপদেশ পাইতে ইচ্ছা করি। আপনি যদি ঐ সম্বন্ধে কিছু লিখেন, তবে তাহার কোন অংশ পুস্তক বিক্রয়ের বিজ্ঞাপনে প্রকাশ করিব না, এই প্রতিশ্রুতি দিতেছি। আমি মন্ত্রগুপ্তি রক্ষা করিব এবং শোধরাইবার চেষ্টা করিব।

 আপনি বাংলায় এম, এ পরীক্ষার সম্বন্ধে “মডার্ণ রিভিউ”তে যে চিঠি লিখিয়াছেন তাহা আমরা পড়িয়াছি এবং আশুবাবু অতি আগ্রহের সহিত তাহা পড়িয়াছেন। তিনি বলেন ভাষার মুখে প্রাচীন আবর্জনা ফেলিয়া তিনি তাহার প্রবাহ রোধ করিতে ইচ্ছুক নহেন। এ সম্বন্ধে আপনার মত উপদেষ্টা কেহ নাই। আপনি এম-এ পরীক্ষার বোর্ডে যদি থাকিতে সম্মত হন, তবে আপনার ইচ্ছানুযায়ী অনেক কাজ হইবে। আশুবাবু আপনার সঙ্গে দেখা করিতে ইচ্ছুক, কিন্তু তিনি ইউনিভার্সিটির কমিশনের কার্য্যে সারাদিন এত ব্যাপৃত যে বোলপুরে যাইতে পারিতেছেন না। আপনি এখানে আসিলে খবর পাইলে দেখা করিতে চেষ্টা পাইবেন।

 সূচনায় হিসাব নিকাশের কথা লিখিয়াছি, ইহা কথার কথা নহে। আমি ৩ ১/২ মাস যাবত ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগিতেছি, রোজ সন্ধ্যার পরে জ্বর হয় এবং সারারাত্রি প্রবল জ্বর অনুভব করি। আত্মীয় ও ডাক্তাররা ভয় পাইয়াছেন, কারণ এখন আমার বয়স ৫০ এর উপরে। কিন্তু সংসারের হিসাব নিকাশ লইয়া চিরকালই গোল করিয়া মরিব, আমার স্রষ্টার এ উদ্দেশ্য নহে বোধ হয়।

 আমার শরীর দিনের বেলায় কখনও কখনও ভাল থাকিলে গাড়ীতে কতকটা যাইতে পারি, কিন্তু সে শক্তিও বোধ হয় বেশী দিন থাকিবে না। আপনি এখানে আসিলে একবার আমাকে দেখিতে আসিবেন, তাহা হইলেই দেখিতে পাইব। আপনার পায়ের ধূলা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ীতে পড়িয়াছে, এই ভরসায় এই অনুরোধ করিলাম।

 বঙ্গভাষা সম্বন্ধে আমি যাহা করিয়াছি, তাহা যদি ছেঁড়া কাগজের দামেই বিকায়, তজ্জন্য আমার কোন দুঃখ নাই, কারণ এখন আমার নিকট প্রতিষ্ঠা ও অপ্রতিষ্ঠা দুইই সমান। আমি কলিকাতায় যে ঠিকানায় আছি তাহা নীচে দিলাম।

 আশা করি আপনি কুশলে আছেন।

৪৯।১এ রাজা রাজবল্লভ ষ্ট্রীট
বাগবাজার

প্রণত
শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন