আট

বনগাঁএ শ্যামার একে একে আরও চার বছর কাটিয়া গেল।

 কলিকাতার বাড়িটা তাহাকে বিক্রয় করিয়া দিতে হইয়াছে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করিয়া বিধান যখন কলিকাতায় পড়িতে গেল তখন—শীতলের প্রত্যাবর্তনের এক বছর পরে।

 শীতলের অসুখের জন্য অনেক টাকা খরচ করিতে না হইলে রাখাল হয়ত শেষ পর্যন্ত বিধানের পড়ার খরচ দিতে রাজি হইত। বড় খারাপ অসুখ হইয়াছিল শীতলের। বেশি জ্বর, অনাহার, দারুণ শীতে উপযুক্ত আবরণের অভাব, মানসিক পীড়া এই সব মিলিয়া শীতলের স্নায়ুরোগ জন্মাইয়া দিয়াছিল। দেহের সমস্ত স্নায়ু তাহার উঠিয়াছিল ফুলিয়া। চিকিৎসার জন্য তাহাকে কলিকাতা লইয়া যাইতে হইয়াছিল। তিনমাস সে পড়িয়া ছিল হাসপাতালে। তারপর শ্যামার কাঁদা-কাটায় রাখাল আরও তিনমাস তাহার বৈদ্যুতিক চিকিৎসা চালাইয়াছিল। তার ফলে যতদূর সুস্থ হওয়া সম্ভব শীতল তা হইয়াছে। কিন্তু জীবনে সে যে কাজকর্ম কিছু করিতে পারিবে সে ভরসা আর নাই। যতখানি তাহার অক্ষমতা নয়, ভান করে সে তার চেয়ে বেশি শুইয়া বসিয়া অলস অকর্মণ্য দায়িত্বহীন জীবন যাপনের সুখটা টের পাইয়া হয়ত সে মুগ্ধ হইয়াছে। হযত সে সত্যই বিশ্বাস করে, দারুণ সে অসুস্থ, কর্ম-জীবনের তাহার অবসান হইয়াছে। হয়ত সে হিষ্টিরিয়াগ্রস্ত, অসুখের অজুহাতে সকলের দয়া ও সহানুভূতি, মমতা ও সেবা লাভ করার চেয়ে বড় আর তার কাছে কিছুই নাই। তবে সবটা শীতলের ফাঁকি নয়, শরীরে তাহার গোলমাল আছে, মাথাটা ভোঁতা হইয়া যাওয়াও কাল্পনিক নয়, অসুখের যে বাড়াবাড়ি ভানটুকু সে করে তার ভিত্তিও তো মানসিক রোগ।

 তবু ছেলের পড়া চালানোর জন্য বাড়িটা শ্যামার হয়ত বিক্রয় করিতে হইত না, যদি বাঁচিয়া থাকিত হারান ডাক্তার। বিধানকে হারানের বাড়ি পাঠাইয়া সে লিখিত, বাবা, জীবনপাত করে ওর স্কুলের পড়া সাঙ্গ করেছি, আর তো আমার সাধ্য নেই, এবার দিন বাবা, ওর আপনি কলেজে পড়ার একটা ব্যবস্থা করে। হারান তা দিত। শ্যামার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু হারানের অনেক বয়স হইয়াছিল, বিধানের স্কুলের পড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত সে বাঁচিয়া থাকিতে পারিল কৈ?

 হারান মরিয়াছে। মরিবে না? কপাল যে শ্যামার মন্দ। হারান বাঁচিয়া থাকিলে শ্যামার ভাবনা কি ছিল? বাড়িতে শ্যামার ভাড়াটে আসিয়াছিল, তারা কুড়ি টাকা পাঠাইত শ্যামাকে আর হারান পাঠাইত পঁচিশ। হারানের মনি অর্ডারের কুপনে কোন অজুহাতের কথা লেখা থাকিত না, শুধু অপাঠ্য হাতের লেখায় স্বাক্ষর থাকিত হারানচন্দ্র দে। শ্যামা তো তখন ছিল বড়লোক। কয়েক মাসে শ’ দেড়েক টাকাও সে জমাইয়া ফেলিয়াছিল। কেন মরিল হারান? কত মানুষ সত্তর আশি বছর বাঁচিয়া থাকে। পঁয়ষট্টি পার হইতে না হইতে হারানের মরিবার কি হইয়াছিল?

 শ্যামা কি করিবে? ভগবান যার প্রতি এমন বিরূপ বাড়ি বিক্রি করিয়া না দিয়া তার উপায় কি।

 শহরতলীর বাড়ি, তাও বড় রাস্তার উপরে নয়, দক্ষিণ খোলা নয়। একতলাটা পুরানো। বাড়ি বেচিয়া শ্যামা হাজার পাঁচেক টাকা পাইয়াছিল।

 টাকা থাকিলে খরচ কেন বাড়িয়া যায় কে জানে। আগে ছোট-বড় অনেক খরচ মন্দার উপর দিয়া চালানো যাইত, কিন্তু পুঁজি যার পাঁচ হাজার টাকা সে কেন তা পারিবে? মন্দাই বা দিবে কেন? দুধের কথাটা ধরা যাক। দুধ অবশ্য কেনা হয় না, বাড়িতে পাঁচ ছ'টা গরু আছে। কিন্তু গরুর পিছনে খরচ তো আছে? শ্যামার ছেলেমেয়েরা দুধ তো খায়? শ্যামা পাঁচ হাজার টাকা পাওয়ার মাসখানেক পরে মন্দা বলে, পয়সা কড়ি হাতে নেই বৌ, এ-মাসের খোল কুঁড়োর দামটা দিয়ে দাও না,—সামনের মাসে আনাব'খন আমি।

 কুঁড়ো কেনা হইবে কেন? সেদিন যে দু’মণ চাল করা হইল তার কুঁড়ো গেল কোথায়? এবার মন্দা ধান ভানার মজুরি নগদ দেয় নাই: ধান যে ভানিয়াছে কুঁড়ো পাইয়াছে সে। মন্দা তাহা হইলে শ্যামার টাকাগুলি খরচ করাইয়া দিবার মতলব করিয়াছে? ঘরের ধানের কুঁড়ো পরকে দিয়া শ্যামাকে দিয়া সে কুঁড়ো কিনাইবে!

 মাসের শেষে মুদি তাহার সাঁইত্রিশ টাকা পাওনা লইতে আসিয়াছে, মন্দা তিনখানা দশ টাকার নোট গুনিয়া দেয়, একটু ইতস্তত করিয়া নগদ টাকাও দেয় একটা, তারপর শ্যামাকে বলে, ছ'টা টাকা কম পড়ল, দাও না বৌ টাকাটা দিয়ে?

 বর্ষাকালে জল পড়িতে আরম্ভ হইয়াছে শ্যামার ঘর দিয়া, দু'খানা টিন বদলানো দরকার,—কে বদলাইবে টিন? বাড়ি মন্দার, ঘরখানা মন্দার, শ্যামা তো শুধু আশ্রিতা অতিথি—মন্দারই তো উচিত ঘরখানা সারাইয়া দেওয়া। বলিলে মন্দা চুপ করিয়া থাকে। একটু পরেই সংসার খরচের দু'টি একটি টাকা বাহির করিয়া দিবার সময় মন্দা এমন করিয়া বলিতে থাকে যে আর সে পারিয়া উঠিল না, এ যেন রাজার বাড়ি ঠাওরাইয়াছে সকলে, খরচ খরচ খরচ, চারদিকে শুধু খরচ, খরচ ছাড়া আর কথা নাই—যে মনে হয় সে বুঝি শ্যামার ঘর সারাইয়া দিবার অনুরোধেরই জবাব দিতেছে এতক্ষণ পরে।

 বাড়ি বেচিয়া এমনি কত খরচ যে শ্যামার বাড়িয়াছে বলিবার নয়।

 বিধানের কলিকাতার খরচ, মণি স্কুলে যাইতেছে তার খরচ, শীতলের জন্য খরচ, অসুখবিসুখের খরচ,—শ্যামার তো মনে হইত মন্দার নয়, খরচ খরচ খরচ, চারিদিকে শুধু খরচ, তার।

 আর বকুল? বকুলের জন্য শ্যামার খরচ হয় নাই?

 গত বৈশাখে তেরশ' টাকা খরচ করিয়া বকুলের শ্যামা বিবাহ দিয়াছে। কমিতে কমিতে পাঁচ হাজারের যা অবশিষ্ট ছিল, বকুল একাই প্রায় তা শেষ করিয়া দিয়াছে।

 বকুলের বিবাহ হইয়াছে, আমাদের সেই বকুলের? কার সঙ্গে বিবাহ হইয়াছে বকুলের, শঙ্করের সঙ্গে নাকি? পাগল! শঙ্করের সঙ্গে বকুলের বিবাহ হয় না।

 যে বৈশাখে আমাদের বকুলের বিবাহ হইল, তার আগের ফাল্গুনে বিবাহ হইয়াছিল সুপ্রভার মেয়েটির, বিবাহের তিন চার দিন আগে কলিকাতা হইতে বিধানের সঙ্গে শঙ্করও আসিয়াছল। বয়সের আন্দাজে বকুল মস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, শঙ্কর ভাবিতে পারে নাই বকুল এত বড় হইয়াছে, আর এত লজ্জা হইয়াছে বকুলের, আর এত সুন্দর হইয়াছে সে। মেয়ের সম্বন্ধে শ্যামা যে এত সাবধান হইয়াছে তাও কি শঙ্কর জানিত? বিবাহের পরদিন দুপুরবেলা বকুলকে আর শ্যামা দেখিতে পায় না। কোথায় গেল বকুল? বাড়িতে পুরুষ গিজগিজ করিতেছে, যেখানে যেখানে মেয়েরা একত্র হইয়াছে বকুল তো সেখানে নাই? হাতের কাজ ফেলিয়া রাখিয়া শ্যামা এখানে খোঁজে ওখানে খোঁজে, একে তাকে জিজ্ঞাসা করে। একজন বলিল, এই তো দেখলাম এখানে খানিক আগে, দেখ না কলাবাগানে গেছে নাকি?

 বাড়ির পিছনে কলাবাগান, কলাবাগানে সেই ঢেঁকিঘর। তাই বটে, ঢেঁকিঘরে ঢেঁকিটার উপর বসিয়া শঙ্কর আর বকুল কথা বলিতেছে বটে। ঘরের কোণে এখানে বকুল আর এখন পুতুল খেলা করে না, খেলাঘর তার ভাঙিয়া গেছে, শুধু আছে চিহ্ণ, কতবার ঘর লেপা হইয়াছে, আজো চারিদিকে উঁচু আলের চিহ্ণ, পুকুরের গর্ত, উনানের গর্ত মিলাইয়া যায় নাই, বেড়ায় যে শিউলিবোঁটার রঙে ছোপানো ন্যাকড়াটি গোঁজা আছে সে তো বকুলের পুতুলেরই জামা। পুতুল খেলার ঘরে কি ছেলেখেলা আজ করিতেছে বকুল? একটু বাড়াবাড়ি রকম কাছাকাছি বসিয়া আছে ওরা আর কিছু নয়। না, বকুলের হাতটিও শঙ্করের হাতে ধরা নাই। শ্যামা বলিয়াছিল, ও বকুল, এখানে বসে আছিস তুই? মেয়ে জামাই যাবে যে এখন, আয় চলে আয়।

 বকুল তো আসিল, কিন্তু মেয়ের মুখ রাঙা কেন, চোখ কেন ছলো ছলো?—শঙ্কর আসিয়াছে চার পাঁচদিন, সকলের সামনে শঙ্করের সঙ্গে কত কথা বকুল বলিয়াছে, দু'চার মিনিট একা কথা বলিবার সময়ও কতবার শ্যামা হঠাৎ আসিয়া ওদের দেখিয়াছে, শ্যামাকে দেখিয়াও কথা শঙ্কর বন্ধ করে নাই, বকুল হাসি থামায় নাই। ঢেঁকি ঘরে আজ ওরা কোন্‌ নিষিদ্ধ বাণীর আদান প্রদান করিতেছিল, বকুলের মুখে যা রঙ আনিয়াছে, চোখে আনিয়াছে জল? কি বলিতেছিল শঙ্কর বকুলকে?

 শ্যামা একবার ভাবিয়াছিল বকুলকে জিজ্ঞাসা করিবে। শেষে কিছু না বলাই ভাল মনে করিয়াছিল। কিছুই হয় তো নয়। হয় তো নির্জন ঢেঁকি ঘরে শঙ্করের কাছে বসিয়া থাকার জন্যই বকুল লজ্জা পাইয়াছিল, ওখানে ও ভাবে বসিয়া থাকা যে তার উচিত হয় নাই বকুল কি আর তা বোঝে না।

 তারপর যে কদিন শঙ্কর এখানে ছিল, আর তিনটি দিন মাত্র, বকুলকে শ্যামা একদণ্ডের জন্য চোখের আড়াল করে নাই।

 বকুল রাগ করিয়া বলিয়াছিল, সারাদিন পেছন পেছন ঘুরছ কেন বলত?

 বকুলের বোধ হয় অপমান বোধ হইয়াছিল।

 শ্যামা বলিয়াছিল, পেছন পেছন আবার তোর ঘুরলাম কখন?

 তারপর বকুল কাঁদিয়া ফেলিয়াছিল। গিয়া বসিয়া ছিল শীতলের কাছে, সারাটা দিন।

 দুমাস পরে বৈশাখ মাসে বকুলের বিবাহ হইয়াছিল। ছেলের নাম মোহিনী, ছেলের বাপের নাম বিভূতি, নিবাস কৃষ্ণনগর। বিভূতি ছিল পোষ্টমাষ্টার, এখন অবসর লইয়াছে। মোহিনী পঞ্চাশ টাকায় ঢুকিয়াছে পোষ্টাপিসে, আশা আছে বাপের মত সেও পোস্টমাষ্টার হইয়া অবসর লইতে পারিবে। মোহিনী কাজ করে কলিকাতায়, থাকে কাকার বাড়ি, যার নাম শ্রীপতি এবং যিনি মার্চেণ্ট আপিসের কেরাণী।

 ছেলেটি ভাল, আমাদের বকুলের বর মোহিনী। শান্ত নম্র স্বভাব। পঞ্চাশ টাকার চাকরী করে বলিয়া এতটুকু গর্ব নাই, প্রায় শঙ্করের মতই লাজুক। দেখিতে মন্দ নয়, রঙ একটু ময়লা কিন্তু কি চোখ।—বকুলের চোখের মতই বড় হইবে।

 জামাই দেখিয়া শ্যামা খুসী হইয়াছে, সকলেই হইয়াছে। জামাইএর বাপখুড়ার ব্যবহারেও কারো অখুসী হওয়ার কারণ ঘটে নাই, শ্বশুর বাড়ি হইতে বকুল ফিরিয়া আসিলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানা গিয়াছে শাশুড়ী ননদেরাও বকুলের মন্দ নয়, বকুলকে তারা পছন্দও করিয়াছে, আদর যত্ন মিষ্টি কথারও কমতি রাখে নাই, কেবল এক পিস্‌শাশুড়ী আছে বকুলের, সেই যা রুঢ় কথা বলিয়াছে দু'একটা—বলিয়াছে, ধেড়ে মাগী, বলিয়াছে তালগাছ। ধোয়া পাকা মেঝেতে পা পিছলাইয়া পড়িয়া গিয়া বকুল যখন ডান হাতের শাঁখাটি ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছিল বিশেষ কিছু কেহ তখন তাহাকে বলে নাই, কেবল ওই পিস্‌শাশুড়ী অনেকক্ষণ বকাবকি করিয়াছিল, বলিয়াছিল অলক্ষ্মী, বলিয়াছিল বজ্জাত।

 বলুক, পিস্‌শাশুড়ী কে? শাশুড়ী ননদই আসল, তারা ভাল হইলেই হইল।

 বকুল বলিয়াছিল, না মা, পিস্‌শাশুড়ীর প্রতাপ ওখানে সবার চেয়ে বেশি, সবাই তার কথায় ওঠে বসে। ঘরদোর তার কিনা সব, নগদ টাকা আর সম্পত্তিও নাকি অনেক আছে শুনলাম, তাইতে সবাই তাকে মেনে চলে। বুড়ীর ভয়ে কেউ জোরে কথাটি কয় না মা।

 তাহা হইলে ভাবনার কথা বটে। শ্যামা অসন্তুষ্ট হইয়া বলিয়াছিল, কদিন ছিলি তার মধ্যে শাঁখা ভেঙ্গে বুড়ীর বিষনজরে পড়লি। বৌ-মানুষ তুই সেখানে, একটু সাবধানে চলাফেরা করতে হয়।

 বকুল বলিয়াছিল, পা পিছলে গেল, আমি কি করব? আমি তো ইচ্ছে করে পড়িনি!

 সুপ্রভা বালয়াছিল, মরুক পিস্‌শাশুড়ী, জামাই ভাল হলেই হল। সব তো আর মনের মত হয় না।

 তা বটে। স্বামীই তো স্ত্রীলোকের সব। স্বামী যদি ভাল হয়, স্বামী যদি ভালবাসে, হাজার দজ্জ্বাল পিস্‌শাশুড়ী থাক, কি আসিয়া যায় মেয়েমানুষের?

 মোহিনী ভালবাসে না বকুলকে?

 মোটা মোটা চিঠি তো আসে সপ্তাহে দু'খানা! ভালবাসার কথা ছাড়া কি আর লেখে মোহিনী অত সব? আর কি লিখিবার আছে তাহার?

 সুপ্রভার মেয়েকে বকুল বরের চিঠি পড়িতে দেয়। শ্যামা, সুপ্রভা, মন্দা সকলে আগ্রহের সঙ্গে একবার তাকে প্রশ্ন করিয়াছিল, সে হাসিয়া বলিয়াছিল, ভেবো না মামী ভেবো না, যা কবিত্ব করে চিঠিতে, জামাই তোমার ভেড়া বনে গেছে।

 তবু, লুকাইয়া মেয়ের একখানা চিঠিতে শ্যামা চোখ বুলাইতে ছাড়ে নাই। টাঙ্গানো লেপের বস্তার কোথায় কোন ফাঁকে চিঠিখানা আপাতত গোপন করিয়া বকুল স্নান করিতে গিয়াছিল, শ্যামার কি তা নজর এড়াইয়াছে! চোরের মত চিঠিখানা পড়িয়া শ্যামা তো অবাক। এসব কি লিখিয়াছে মোহিনী? সব কথার মানেও যে শ্যামা বুঝিতে পারিল না?

 কে জানে, হয় তো ভালবাসার চিঠি এমনি হয়। শীতল তো কোনদিন তাকে প্রেমপত্র লেখে নাই, সে কি জানে প্রেমপত্রের?

 না জানুক, জামাই যে মেয়েকে পছন্দ করিয়াছে তাই শ্যামার ঢের। একটি শুধু ভাবনা তাহার আছে। বকুল তো পছন্দ করিয়াছে মোহিনীকে? কে জানে কি পোড়া মন তাহার, ঢেঁকিঘরে সেই যে বকুল আর শঙ্করকে সে একসঙ্গে দেখিয়াছিল বার বার সে কথা তাহার মনে পড়িয়া যায়। বকুলের সেই রাঙ্গা মুখ আর ছল ছল চোখ সর্বদা চোখের সামনে ভাসিয়া আসে।

 পূজার সময় বকুলকে নেওয়ার কথা ছিল। পূজার ছুটির সঙ্গে আরও কয়েকদিনের ছুটি লইয়া মোহিনী ষষ্ঠীর দিন বনগাঁ আসিল। বিধানের কলেজ অনেক আগে বন্ধ হইয়াছিল, কিন্তু সে শঙ্করের সঙ্গে কাশী গিয়াছে। শঙ্করের কে এক আত্মীয় থাকেন কাশীতে, সেখানে পূজা কাটাইয়া বিধান বাড়ি আসিবে।

 মোহিনী থাকিতে চায় না। অষ্টমীর দিনই বকুলকে লইয়া বাড়ি যাইবে বলে। সকলে যত বলে, তাকি হয়? এসেছ, পূজোর কদিন থাকবে না? লাজুক মোহিনী ততই সলজ্জভাবে একটু হাসিয়া বলে, না, তার যাওয়াই চাই।

 কেন, যাওয়াই চাই কেন? সকলে জিজ্ঞাসা করে। পনেরদিনের ছুটি তো নিয়েছ, দুদিন এখানে থেকে গেলে ছুটি তো তোমার ফুরিয়ে যাবে না?

 শেষে মোহিনী স্বীকার করে, এটা তার ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার নয়, পিসীমার হুকুম অষ্টমীর দিন রওনা হওয়াই চাই।

 সুপ্রভা অসন্তুষ্ট হইয়া বলে, এ কি রকম হুকুম বাছা তোমার পিসীর? বেয়াই বর্তমানে পিসীই বা হুকুম দেবার কে? বেয়াইকে টেলিগ্রাম করে আমরা অনুমতি আনিয়ে নিচ্ছি, লক্ষ্মীপূজো পর্যন্ত তুমি থাকবে এখানে।

 মোহিনী ভয় পাইয়া বলে, টেলিগ্রাম যদি করতে হয় পিসীকে করুন। কিন্তু তাতে কিছু লাভ হবে না, অনুমতি পিসী দেবে না, মাঝ থেকে শুধু চটবে।

 কেহ আর কিছু বলে না, মনে মনে সকলে অসন্তুষ্ট হইয়া থাকে। বুঝিতে পারিয়া মোহিনী বড় অস্বস্তি বোধ করে। সুপ্রভার মেয়েকে সে বুঝাইবার চেষ্টা করে যে এ ব্যাপারে তার কোন দোষ নাই, পিসী তিনখানা চিঠিতে লিখিয়াছে অষ্টমীর দিন সে যেন অবশ্য অবশ্য রওনা হয়, কোন কারণে যেন অন্যথা না ঘটে। কথা না শুনিলে পিসী বড় রাগ করে। সুপ্রভার মেয়ে শুনিয়া বলে, বোঝো তো ভাই, আসার মত আসা এই তো তোমার প্রথম, দুদিন না থাকলে কেমন লাগে আমাদের?

 মোহিনী কয়েক ঘণ্টা ভাবে, তারপর সুপ্রভার মেয়েকে ডাকিয়া বলে, আচ্ছা দশমী পর্যন্ত থাকব।

 শুনিয়া শ্যামা আসিয়া বলে, থাকলে পিসী রাগ করবে বলছিলে?

 গিয়ে বুঝিয়ে বলব'খন।—মোহিনী বলে।

 শ্যামা তবু ইতস্ততঃ করে: জোর করে ধরে রেখেছি বলে পিসী তো শেষে—?

 মনটা শ্যামার খুঁত খুঁত করে। কি যে জবরদস্তি সকলের। যাইতে দিলেই হইত অষ্টমীর দিন। তার মেয়ে জামাই, পিসীর নাম শুনিয়া সে চুপ করিয়া গেল, সকলের এত মাথাবাথা কেন? ওরা কি যাইবে পিসীর রাগের ফল ভোগ করিতে? ভুগিবে তার মেয়ে। সুপ্রভার মেয়ে একসময় তাহাকে একটা খবর দিয়া যায়। বলে, জান মামী, জামাই তোমার তার পাঠালে পিসীর কাছে। কি লিখেছে জান, এখানে এক গণৎকার বলেছে পূজোর কদিন ওর যাত্রা নিষেধ।

 শ্যামা নিশ্বাস ফোলিয়া বলে, কি সব কাণ্ড মা! আমার ভাল লাগছে না খুকী, এমন করে কাউকে রাখতে আছে!

 আমরা রেখেছি নাকি? জামাই নিজেই তো বললে থাকবে।

 তখন শ্যামা হাসিয়া সুপ্রভার মেয়ের চিবুক ধরিয়া বলে, আরেকটি জামাই তো আমার এল না মা?

 সে লক্ষ্মীপূজার পরেই আসিবে, শ্যামা তাই হাসিয়া একথা বলে, ব্যথার সঙ্গে বলিবার প্রয়োজন হয় না।

 পূজা উপলক্ষে মন্দা সাধারণ ভাবে খাওয়া দাওয়ার ভাল ব্যবস্থা করিয়াছে, শ্যামা খরচপত্র করিয়া আরও বেশি আয়োজন করিল। আসার মত আসা এই তো জামাইএর প্রথম। মোহিনীকে সে একপ্রস্থ ধুতিচাদর জামা জুতা কিনিয়া দিল, দিল দামী জিনিস, জামাই যে পঞ্চাশ টাকার চাকরে। শ্যামার টাকা ফুরাইয়া আসিয়াছে, কিন্তু কি করিবে? এসব তো না করিলে নয়।

 কাজ করিতে করিতে শ্যামা বকুলের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে। মোহিনী আসিয়াছে বলিয়া খুসি হয় নাই বকুল? এমন চাপা মেয়েটা তার, মুখ দেখিয়া কিছু কি বুঝিবার যো আছে। খাওয়া দাওয়া শেষ হইতে অনেক রাত্রি হয়। বকুল আসিয়া শ্যামার বিছানায় শুইয়া পড়ে, শ্যামা বলে, রাত অনেক হল। আর এখানে কেন মা? ঘরে যাও।

 এখানে শুই না আমি?—বকুল বলে।

 শ্যামা ভয় পাইয়া সুপ্রভার মেয়েকে ডাকিয়া আনে। সে টানাটানি করে, বকুল যাইতে চায় না। শ্যামার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করিতে থাকে। শেষে ধৈর্য হারাইয়া শ্যামা দাঁতে দাঁত ঘষিয়া বলে, পোড়ারমুখি! কেলেঙ্কারি করে সকলের মুখে তুই চূণকালি দিবি? যা বলছি যা। মেরে ছেঁচে ফেলব তোকে আমি।

 সুপ্রভার মেয়ে বলে, আহা মামী বকো না গো। যাচ্ছে।

 তারপর বকুল উঠিয়া যায়। শ্যামা চুপ করিয়া তক্তপোষে বসিয়া ভাবে। নানা কারণে সে বড় বিষাদ বোধ করে। কে জানে কি আছে মেয়েটার মনে। পূজার সময় চারিদিকে আনন্দ উৎসব, বিধানও কাছে নাই যে ছেলের মুখ দেখিয়া মনটা একটু শান্ত হয়। ছেলে বড় হইয়াছে, তাই আর কলেজ ছুটি হইলে ছুটিয়া মার কাছে আসে না, বন্ধুর সঙ্গে বেড়াইতে যায়।

 শীতল বোধ হয় বাহিরে তাসের আড্ডায় বসিয়া আছে। শ্যামার বারণ না মানিয়া সে আজ সিদ্ধি গিলিয়াছে একরাশি। কে আছে শ্যামার? সারাদিনের খাটুনির পর শরীর শ্রান্ত অবসন্ন হইয়া আসিয়াছে, মনের মধ্যে একটা দুঃসহ ভার চাপিয়া আছে, কত যে একা আর অসহায় মনে হইতেছে নিজেকে সেই শুধু তা জানে, এতটুকু সান্ত্বনা দিবারও কেহ নাই।

 ভাল করিয়া আলো হওয়ার আগে উঠিয়া শ্যামা বকুলের ঘরের দরজায় চোখ পাতিয়া দাওয়ায় বসিয়া রহিল। বকুল বাহির হইলে একবার সে তাহার মুখখানা দেখিবে। খানিক বসিয়া থাকিয়া শ্যামার লজ্জা করিতে লাগিল, এদিক ওদিক সে একটু ঘুরিয়া আসিল, পুকুর ঘাটে গিয়া মুখে চোখে জল দিল। এও এক শরৎকাল, শ্যামার জীবনে এমন কত শরৎ আসিয়া গিয়াছে। পুকুরের শীতল জল, ঘাসের কোমল শিশির শ্যামার মুখে আর চরণে কত কি নিবেদন জানায়। সে কি একদিন বকুলের মত ছিল? কবে?

 তারপর ভিতরে গিয়া শ্যামা দেখিল, বকুলের ঘরের দরজা খোলা। কিন্তু বকুল কোথায়? শ্যামা এদিক ওদিক তাকায়, সম্মুখ দিয়া পার হইয়া যাওয়ার সময় ভিতরে চাহিয়া দ্যাখে মশারি তোলা, বিছানা খালি, বকুল বা মোহিনী কেউ ঘরে নাই। এত ভোরে কোথায় গেল ওরা? শ্যামা গালে হাত দিয়া সিঁড়িতে বসিয়া রহিল।

 রান্নাঘরের পাশ দিয়া চোরের মত বাড়িতে ঢুকিয়া শ্যামাকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া দুজনেই তাহারা লজ্জা পাইল। মোহিনী ঘরে চলিয়া গেল। বকুল শ্লথ পদে মার কাছে আসিল।

 কোথা গিয়েছিলি বকুল?

 বকুল কথা বলে না। পাশে বসাইয়া শ্যামা একটা হাতে তাহাকে বেষ্টন করিয়া থাকে। তাই বটে, তেমনি রাঙ্গা বটে বকুলের মুখ, ঢেঁকিঘরে সেদিন শ্যামা যেমন দেখিয়াছিল। শুধু আজ ওর চোখ দুটি ছলছল নয়।


 দশমীর দিন বেলা দশটার সময় অপ্রত্যাশিত ভাবে বিধান আসিল। শ্যামা আনন্দে অধীর হইয়া বলিল, তুই যে চলে এলি খোকা? মন টিঁকল না বুঝি সেখানে তোর?

 হঠাৎ শ্যামার মন হাল্কা হইয়া গিয়াছে। সেদিন ভোরে মোহিনীর সঙ্গে বেড়াইয়া আসিয়া বকুলের মুখ যে রাঙ্গা হইয়াছিল তা দেখিবার পরেও শ্যামার মন কি ভার হইয়া ছিল? ছিল বৈকি! শ্যামার ভাবনা কি শুধু বকুলের জন্য। এমনি শরৎকালে যাকে শ্যামা কোলে পাইয়াছিল, সোনার টুকরার সঙ্গে লোকে যাকে তুলনা করে, তাকে না দেখিলে শ্যামার ভাল লাগে না। মোহিনীর জন্য মাছ মাংস রাঁধিতে রাঁধিতে উন্মনা হইয়া চোখের জল সে ফেলিয়াছিল কার জন্য?

 বিধান আসিয়াছে। আর শ্যামার দুঃখ নাই। পৃথিবীতে শরৎ আসিয়াছে হাসির মত, এতদিন শ্যামা হাসিতে পারে নাই। এবার শ্যামার মুখেও হাসি ফুটিয়াছে।

 পরদিন বকুলকে বিদায় দিয়াও শ্যামার মুখ তাই বেশিক্ষণ ম্লান রহিল না। রান্না ঘরে গিয়া তার কাছে পিঁড়ি পাতিয়া বিধান বসিতে না বসিতে কখন যে সে ভুলিয়া গেল মেয়ের বিরহ।