দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মোগল-পাঠান

 নিশীথকালে জগৎসিংহ শৈলেশ্বরের মন্দির হইতে যাত্রা করিলেন আপাততঃ তাঁহার অনুগমনে অথবা মন্দিরাধিষ্ঠাত্রী মনোমোহিনীর সংবাদকপনে পাঠকমহাশয়দিগের কৌতূহল নিবারণ করিতে পারিলাম। জগৎসিংহ রাজপুত, কি প্রয়োজনে বঙ্গদেশে আসিয়াছিলেন, কেনই বা প্রান্তরমধ্যে একাকী গমন করিতেছিলেন, তৎপরিচয় উপলক্ষে এই সময়ের বঙ্গদেশসম্বন্ধীয় রাজকীয় ঘটনা কতক কতক সংক্ষেপে বিবৃত করিতে হইল। অতএব এই পরিচ্ছেদ ইতিবৃত্তসম্পর্কীয়। পাঠকবর্গ একান্ত অধীর হইলে, ইহা ত্যাগ করিতে পারেন, কিন্তু গ্রন্থকারের পরামর্শ এই যে, অধৈর্য্য ভাল নহে।

 প্রথমে বঙ্গদেশে বখ্তিয়ার খিলিজি মহম্মদীয় জয়ধ্বজা সংস্থাপিত করিলে পর, মুসলমানেরা অবাধে কয়েক শতাব্দী তদ্রাজ্য শাসন কম্নিতে থাকেন। ৯৭২ হেঃ অব্দে সুবিখ্যাত সুলতান বাবর রণক্ষেত্রে দিল্লীর বাদসাহ ইব্রাহিম লদীকে পরাভূত করিয়া, তৎসিংহাসনে আরোহণ করেন; কিন্তু তৎকালেই বঙ্গদেশ তৈমুরলঙ্গবংশীয়দিগের দণ্ডাধীন হয় নাই।

 যতদিন না মোগলসম্রাট্দিগের কুলতিলক আকবরের অভ্যুদয় হয়, ততদিন এ দেশে স্বাধীন পাঠানরাজগণ রাজত্ব করিতেছিলেন। কুক্ষণে নির্বোধ দাউদ খাঁ সুপ্ত সিংহের অঙ্গে হস্তক্ষেপণ করিলেন। আত্মকর্মফলে আকবরের সেনাপতি মনাইম খাঁ কর্তৃক পরাজিত হইয়া রাজ্যভ্রষ্ট হইলেন। দাউদ ৯৮২ হেঃ অব্দে সগণে উড়িষ্যায় পলায়ন করিলেন; বঙ্গরাজ্য মোগল ভূপালের কর-কবলিত হইল। পাঠানের উৎকলে সংস্থাপিত হইলে, তথা হইতে তাহাদিগের উচ্ছেদ করা মোগলদিগের কষ্টসাধ্য হইল। ৯৮৬ অব্দে দিল্লীশ্বরের প্রতিনিধি খাঁ জাঁহা খাঁ, পাঠানদিগকে দ্বিতীয়বার পরাজিত করিয়া, উৎকল-দেশ নিজ প্রভুর দণ্ডাধীন করিলেন। ইহার পর আর এক দারুণ উপদ্রব উপস্থিত হইছিল। আর-শাহ কর্তৃক বঙ্গদেশের রাজকর আদায়ের যে নূতন প্রাণী সংস্থাণিত হইল, তাহাতে জায়গীরদার প্রভৃতি ভূম্যধিকারিগণের গুরুতর অসন্তুষ্টি জন্মিল। তাঁহারা নিজ নিজ পূর্বাধিপত্য-রক্ষার্থ খড়্গহস্ত হইয়া উঠিলেন। অতি দুর্দন্য রাজবিদ্রোহ উপস্থিত হওয়াতে, সময় পাইয়া উড়িষ্যার পাঠানেরা পুনর্বার মস্তক উন্নত করিল, ও কতলু খাঁ নামক এক পাঠানকে আধিপত্যে বরণ করিয়া পুনরপি উড়িষ্যা স্বকরগ্রস্ত করিল। মেদিনীপুরও তাদের অধিকারভুক্ত হইল।

 কর্ম্মঠ রাজপ্রতিনিধি খাঁ আজিম, তৎপরে শাহবাজ খাঁ কেহই শত্রুবিজিত দেশ পুনরুদ্ধার করিতে পারিলেন না। পরিশেষে এই আয়াসসাধ্য-কার্যোদ্ধারজন্য একজন হিন্দু যোদ্ধা প্রেরিত হইলেন।

 মহামতি আকবর তাঁহার পূর্বগামী সম্রাট্দিগের হইতে সর্বাংশে বিজ্ঞ ছিলেন। তাঁহার হৃদয়ে বিশেষ প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, এতদ্দেশীয় রাজকার্যসম্পাদনে এতদ্দেশীয় লোকেই বিশেষ পটু; বিদেশীয়েরা তাদৃশ নহে; আর যুদ্ধে বা রাজ্যশাসনে রাজপুতগণ দক্ষাগ্রগণ্য, অতএব তিনি সর্ব্বদা এতদ্দেশীর বিশেষতঃ রাজপুতগণকে গুরুতর রাজকার্যে নিযুক্ত করিতেন।

 আখ্যায়িকাবর্ণিত কালে যে সকল রাজপুত উচ্চপদাভিষিক্ত ছিলেন, তন্মধ্যে মানসিংহ একজন প্রদান। তিনি স্বয়ং আক্বরের পুত্র সেলিমের শ্যালক। আজিম খাঁ ও শাহনাজ খাঁ উৎকলজয়ে অক্ষম হইলে, আর এই মহাত্মাকে বঙ্গ ও বেহারের শাসনকর্তা করিয়া পাঠাইলেন।

 ৯৯৮ সালে মানসিংহ পাটনা নগরীতে উপনীত হইয়া প্রথমে অপরাপর উপদ্রবের শান্তি করিলেন। পর বৎসরে উৎকগবিজিগীষু হইয়া তদভিমুখে যাত্রা করিলেন। মানসিংহ প্রথমে পাটনায় উপস্থিত হইলে পর, নিজে তন্নগরীতে অবস্থিতি করিবার অভিপ্রায় কুরিয়া, বঙ্গপ্রদেশ-শাসনজন্য সৈদ খাঁকে নিজ প্রতিনিধি নিযুক্ত করিলেন। সৈদ খাঁ এই ভার প্রাপ্ত হইয়া, বঙ্গদেশের তাৎকালিক রাজধানী তণ্ডা নগরে অবস্থিতি করিতেছিলেন। এক্ষণে রণাশায় যাত্রা করিয়া মানসিংহ প্রতিনিধিকে যুদ্ধে আহ্বান করিলেন। সৈদ খাঁকে লিখিলেন যে, তিনি বর্দ্ধমানে তাঁহার সহিত সসৈন্য মিলিত হইতে চাহেন্।

 বর্ধমানে উপনীত হইয়া রাজা দেখিলেন যে, সৈদ খাঁ আসেন নাই, কেবলমাত্র দূত দ্বারা এই সংবাদ পাঠাইয়াছেন যে, সৈন্যাদি সংগ্রহ করিতে তাঁহার বিস্তর বিলম্ব-সম্ভাবনা, এমন কি তাঁহার সৈন্যসজ্জা করিয়া যাইতে বর্ষাকাল উপস্থিত হইবে; অতএব রাজা মানসিংহ আপাততঃ বর্ষাশেষপর্যন্ত শিবির-সংস্থাপন করিয়া থাকিলে, তিনি বর্ষাকাতে সেনাসমভিব্যাহারে রাজসন্নিধানে উপস্থিত হইবেন। রাজা মানসিংহ অগত্যা তৎপরামর্শানুবর্তী হইয়া, দারুকেশ্বরতীরে শিবির সংস্থাপন করিলেন। তথায় সৈদ খাঁর প্রতীক্ষায় রহিলেন।

 তথায় অবস্থিতিকালে লোকমুখে রাজা সংবাদ পাইলেন যে, কতলু খাঁ তাঁহার আলস্য দেখিয়া সাহসিক হইয়াছে; সেই সাহসে মান্দারণের অনতিদূর-মধ্যে সসৈন্যে আসিয়া দেশ লুঠ করিতেছে। রাজা উদ্বিগ্নচিত্ত হইয়া, শত্রুবল কোথায়, কি অভিপ্রায়ে আসিয়াছে, কি করিতেছে, এই সকল সংবাদ নিশ্চয় জানিবার জন্য, তাঁহার একজন প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষকে প্রেরণ করা উচিত বিবেচনা করিলেন। মানসিংহের সহিত তাঁহার প্রিয়তম পুত্র জগৎসিংহ যুদ্ধে আসিয়াছিলেন; জগৎসিংহ এই দুঃসাহসিক কার্যের ভার লইতে সোৎসুক জানিয়া, রাজা তাঁহাকেই শতেক অশ্বারোহী সেনা সমভিব্যাহারে শত্রুশিবিরোদ্দেশে প্রেরণ করিলেন। রাজকুমার কার্য সিদ্ধ করিয়া অচিরাৎ প্রত্যাবর্তন করিলেন। যৎকালে কার্যসমামা করিয়া শিবিরে প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, তখন প্রান্তরমধ্যে পাঠক মহাশয়ের সহিত তাঁহার পরিচয় হইয়াছে।