পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১১০

১১০

১৯।৩।২৭ তারিখে বর্মার তদানীন্তন গভর্নরকে লিখিত পত্র

মহামান্য বর্মার গভর্নর সমীপেষু—

 রেঙ্গুন জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট ও আই জি অব প্রিজন্‌স্

মারফৎ প্রেরিত—

 আজ সকালে যে ঘটনাটি ঘটিয়া গিয়াছে এবং যাহাতে আমি গভীর বেদনা বােধ করিয়াছি। উহার প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। আমি চীফ জেলার মিঃ সলােমনকে সকাল বেলা নিম্নলিখিত চিরকুটখানি পাঠাই—

 “মিঃ সলােমন,

 অনুগ্রহপূর্ব্বক ১৪ ও ১৫ই মার্চ্চ তারিখের ইংলিশম্যান আনাইবার ব্যবস্থা করিবেন এবং উহা যাহাতে আপনি প্রাতঃরাশের জন্য অফিস ত্যাগ করিবার পূর্ব্বেই আমার নিকট পৌঁছায় অনুগ্রহপূর্ব্বক সেদিকে লক্ষ্য রাখিবেন।—এস সি বােস। ১৯।৩।২৭।”

 প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বাদে চিরকুটখানি আমার নিকট ফেরত আসে। উহার তলায় সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের হস্তাক্ষরে স্বাক্ষরসহ নিম্নলিখিত কথাগুলি লেখা ছিল—

 “মিঃ বােসকে অনুরােধ করা হইতেছে যেন তিনি আমার চীফ জেলারকে হুকুম না করেন।

স্বাঃ আর ই ফ্লাওয়ারডিউ
১৯।৩।২৭”

 (স্বাক্ষর যদিও অস্পষ্ট তবু আমার মনে হয় আমি ঠিকই উদ্ধার করিয়াছি।)

 আমি চীফ জেলার মিঃ সলােমনকে যে পত্রখানি পাঠাইয়াছিলাম উহার ভাষা উদ্ধত বা অসৌজন্যমূলক ছিল বলিয়া আমার বােধ হয় না। প্রায় আড়াই বৎসর যাবৎ বেঙ্গল অর্ডিনান্সে আমাকে আটক করিয়া রাখা হইয়াছে এবং বাঙ্গলা ও বর্মা দেশের বিভিন্ন জেলে আমাকে কাটাইতে হইয়াছে। আজ সকালে মিঃ সলােমনকে যেভাবে লিখিয়া পাঠাই ঐ ভাবেই অন্যান্য জেলের কর্ত্তৃপক্ষের নিকটও আমার প্রয়ােজনের কথা বরাবর লিখিয়া আসিয়াছি। এমন কি রেঙ্গুন জেলেও, যেখানে আমাকে দেড় মাসের উপর থাকিতে হইয়াছে, সেখানেও আমি প্রায় প্রত্যহই ঐ একই ভাবে লিখিয়া পাঠাইয়াছি। কিন্তু কেহ এরূপ মন্তব্য করিয়াছেন বলিয়া আমি কখনও শুনি নাই বা দেখি নাই যে, আমার ভাষা অসৌজন্যমূলক কিংবা Major Flowerdew যাহাকে হুকুম বলিয়াছেন সেরূপ ‘হুকুম’ আমি কখনও কাহাকেও করিয়াছি।

 আমি বিনীতভাবেই একথা বলিতে চাই যে, আমার ইংরাজী ভাষার জ্ঞান একেবারে সামান্য নহে; নতুবা আমি ১৯২০ সালে আই সি এস-এর মত একটা প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষায় ইংরাজী রচনায় প্রথম স্থান অধিকার করিতে পারিতাম না। ইহা বলিলেও বোধহয় অন্যায় হইবে না যে যদিও Major Flowerdew জাতিতে ইংরাজ তবু ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞান তাঁহার অপেক্ষা আমার অনেক বেশী।

 ইহা দুঃখের সঙ্গেই স্বীকার করিতে হইতেছে যে, আমার সামাজিক মর্য্যাদা বা দেশসেবকরূপে আমার ভূমিকা যাহাই হউক না কেন প্রাচীরবেষ্টিত এই জেলের সীমানার মধ্যে আমাকে সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট হইতে সুরু করিয়া নিম্নতম কর্ম্মচারী পর্য্যন্ত জেলের প্রত্যেক কর্ম্মচারীর অনুগ্রহের উপরই অধিক মাত্রায় নির্ভর করিতে হয়। যদিও গভর্ণমেণ্টের নির্দ্দেশানুসারে আমাকে সর্ব্বপ্রকার প্রয়োজনীয় দ্রব্য (সংবাদপত্র সহ) সরবরাহ জেল কর্ম্মচারিগণের অবশ্য কর্ত্তব্য এবং যদিও আমি জানি যে, গভর্ণমেণ্ট যে সব কাজের জন্য তাহাদের মাহিনা দিয়া থাকেন তাহার মধ্যে আমার সুখ-সুবিধা বিধানও অন্যতম তথাপি আমি এরূপ অবিবেচক নহি যে তাহাদের হুকুম করিব। কলিকাতা কর্পোরেশনের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসাররূপে নিম্নতম কর্ম্মচারীদের সহিত আমাকে যেরূপ ব্যবহার করিতে হইয়াছে সেই অভিজ্ঞতা হইতেই একথা বলিতে পারি। আপনি হয়তো অবগত আছেন যে, সেখানে আমার নিম্নতম কর্ম্মচারীদের মধ্যে অনেক উচ্চশিক্ষিত ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইউরোপীয় ছিলেন; তাঁহাদের কেহ কেহ Major Flowerdew-র দ্বিগুণ মাহিনা পাইয়া থাকেন। সুতরাং ইহা আমার জানা প্রয়োজন যে, কিরূপে ও কি ভাষায় নিম্নতম কর্ম্মচারীদের নিকট নির্দ্দেশ পাঠাইতে হয় এবং আমার ঐ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি দ্বিধাহীনভাবে বলিতে পারি কোনও বিবেকবান ব্যক্তিই একথা স্বীকার করিবেন না যে, চীফ জেলার মিঃ সলোমনকে উপরোক্ত পত্র পাঠাইয়া আমি কোনও “হুকুম করিয়াছি”।

 পত্র শেষ করিবার পূর্ব্বে ব্যক্তিগত কৈফিয়ৎ হিসাবে আমি আরও কয়েকটি কথা আপনাকে জানাইতে চাই। আইনানুসারে কলিকাতা হইতে প্রকাশিত ইংলিশম্যান পত্রিকাখানি আমি পাইয়া থাকি এবং জেল কর্ত্তৃপক্ষেরই উহা পাঠানোর কথা। যখন আমি মান্দালয় জেলে ছিলাম তখন উহা নিয়মিতই পাইয়া আসিয়াছি। ইহার জন্য কাহাকেও কোনও দিন কিছু বলিতে হয় নাই। কিন্তু এ বিষয়ে রেঙ্গুন জেলের কর্ত্তৃপক্ষের অবহেলা অত্যধিক; ফলে কলিকাতার ডাক আসিলে প্রতিবারই তাহাদের ঐ পত্রিকাখানির কথা স্মরণ করাইয়া দিতে হয়। অভিজ্ঞতা হইতে বুঝিয়াছি যে, যখনই আমি তাহাদের এ বিষয়ে স্মরণ করাই নাই তাহারা আমাকে পত্রিকাখানি পাঠান নাই। এই পত্রিকা পাঠানোর ব্যাপারে কর্ত্তব্যে অবহেলার জন্য আমাকে কয়েকবারই জেলারদের কাছে অভিযোগ করিতে হইয়াছে এবং এ বিষয়ে আমি নিজেই একবার অন্ততঃ Major Flowerdew-কে বলিয়াছিলাম। এই সব অসুবিধার দরুন কলিকাতার ডাক আসামাত্র প্রত্যেক বারই চীফ জেলারকে পত্র লেখা আমার অভ্যাসে দাঁড়াইয়া গিয়াছে এবং আজ সকাল পর্য্যন্তও ইহাতেই বেশ ভাল ভাবে কাজ চলিয়া যাইতেছিল।

 সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট, ডেপুটি সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট, চীফ জেলার ও জেলের অন্যান্য কর্ম্মচারী কাহারও নিকটেই ইহা অজ্ঞাত নয় যে, আমাকে কিরূপ একাকী ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় এখানে দিন কাটাইতে হয় এবং সংবাদপত্র পাঠ করিয়া কোন রকমে সময় কাটানো ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নাই। একথাও তাঁহারা জানেন যে, আমার কাছে বই ও সাময়িক পত্র খুব বেশী নাই। কেন না, মান্দালয় জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট আমাকে বলিয়াছিলেন যে, দুই-তিন দিন থাকিতে গেলে যাহা প্রয়োজন তাহার অতিরিক্ত কিছু যেন আমি সঙ্গে না লই। অতএব জেল কর্ম্মচারীদের অনুগ্রহে যখন যে পত্রিকা সংগ্রহ করিতে পারি উহার সাহায্যেই আমাকে সময় কাটাইতে হয়। চীফ জেলার মিঃ সলোমনকে পত্র লেখার সময় আমি খুব নিঃসঙ্গ বোধ করিতেছিলাম এবং সেই কারণেই প্রাতঃরাশের জন্য তিনি অফিস ত্যাগ করিবার পূর্ব্বেই (অর্থাৎ সকাল সাড়ে এগারোটার মধ্যে) পত্রিকা দুইটি পাঠাইবার জন্য তাঁহাকে অনুবোধ করিয়াছিলাম।

 আমার যেটুকু কাণ্ডজ্ঞান আছে তাহাতে বলিতে পারি, যদি আমার চীফ জেলারকে হুকুম করার কোনও ইচ্ছাই থাকিত তাহা হইলে একই বাক্যে দুইবার “অনুগ্রহপূর্বক” শব্দটি কষ্ট করিয়া লিখিতাম না। তাছাড়া আমি মিঃ সলোমনকে ব্যক্তিগত পত্র পাঠাইয়াছি; সেরূপ কোনও অভিপ্রায় থাকিলে আমি মিঃ সলোমনকে না লিখিয়া যাহা তাহার সরকারী পদ সেই চীফ জেলারকেই পত্র দিতাম।

 আইনানুসারে একজন রাজবন্দী হিসাবে আমার পদমর্য্যাদার অনুরূপ ব্যবহার পাইবার আমি অধিকারী। সুতরাং রেঙ্গুন জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট Major Flowerdew উক্ত পত্র লিখিয়া অন্যায়ভাবে আমার সম্মানবোধে আঘাত করিয়াছেন এবং অন্যান্য কর্ম্মচারীদের নিকট আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করিয়াছেন বলিয়া আমার বোধ হইতেছে। যে কোনও সহৃদয় ও যুক্তিবাদী লোকই ইহাকে শিষ্টাচার-বর্জ্জিত বা অপমানজনক বলিয়া স্বীকার করিবেন। বর্ত্তমানে আমি ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতেছি না কিভাবে জেল কর্ম্মচারীদের সহিত পত্রালাপ করিতে হইবে; ফলে আশঙ্কা হইতেছে যে, এভাবে পত্র লিখিয়া পুনরায় অপমানিত হওয়া অপেক্ষা আমাকে হয়তো বা প্রয়োজনের জিনিসগুলি ছাড়াই চালাইয়া নিতে হইবে।

 আমার ক্ষোভ যে অসঙ্গত নয় তাহা আপনি ইহা হইতেই বুঝিতে পারিবেন যে, গত আড়াই বৎসরের মধ্যে এই দ্বিতীয়বার একজন I.M.S. অফিসারের অসৌজন্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আমাকে অভিযোগ করিতে হইতেছে। অতএব প্রার্থনা এই যে, Major Flowerdew-কে তাহার মন্তব্য প্রত্যাহার করিয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে নির্দ্দেশ দিয়া আপনি আমার প্রতি সুবিচার করিবেন। ইতি—

আপনার একান্ত অনুগত
এস সি বােস, বি-এ (ক্যাণ্টাব),
রেঙ্গুন জেল
কলিকাতা কর্পোরেশনের চীফ
তারিখ—১৯শে মার্চ্চ, ১৯২৭
এক্সিকিউটিভ অফিসার ও
বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য।

(ইংরাজী হইতে অনূদিত)