পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/৫৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মহাভারতের কথা
৫৯৫

চাহিতে গেলে, আগে এই বন্দীর সহিত তর্ক না করিয়া, সে রাজার সহিত দেখা করিতে পাইত না। তর্কের নিয়ম এই ছিল যে, ‘যে হারিবে তাহাকেই জলে ডুবাইয়া দেওয়া হইবে।’ লোকটি এমনি অসম্ভব রকমের ঠ্যাটা যে কি বলিব! কাহারো সাধ্য ছিল না যে, তাঁহাকে তর্কে হারায়। কাজেই এ পর্যন্ত যতলোক আসিয়াছে, তাঁহার হাতে পড়িয়া সকলেই মারা গিয়াছে। বেচারা কহোড়ের টাকা ভিক্ষা করিতে আসিয়া সেই দশাই হইল।

এ ঘটনার কথা অষ্টাবক্রকে জানিতে দেওয়া হয় নাই। তিনি মনে করিতেন, উদ্দালক তাঁহার পিতা আর শ্বেতকেতু তাঁহার ভাই। শ্বেতকেতু আর অষ্টাবক্র প্রায় এক বয়সী ছিলেন। তাই তাঁহাদের খেলান বেড়ান সকলই এক সঙ্গে হইত। মাঝে মাঝে ঝগড়াও যে না হইত, এমন নহে।

 এমনি করিয়া বার বৎসর কাটিয়া গেল। ইহার মধ্যে একদিন অষ্টাবক্র উদ্দালকের কোলে বসিয়াছিলেন, তাহাতে শেতকেতুর হিংসা হওয়াতে, তিনি আসিয়া তাঁহার হাত ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিলেন। ইহাতে অষ্টাবক্র কাঁদিতে আরম্ভ করিলে, শ্বেতকেতু বলিলেন, ‘উহা ত তোমার পিতার কোল নহে, তুমি কেন ওখানে বসিবে?’

 এ কথায় অষ্টাবক্র নিতান্ত দুঃখিত হইয়া নিজের মাতার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা কবিলেন, ‘মা, আমার বাবা কোথায়?’

 তখন সুজাতা আর কি করেন? কাঁদিতে কাঁদিতে অষ্টাবক্রকে তাঁহার পিতার মৃত্যুর কথা শুনাইলেন। সে সংবাদ শুনিয়া অষ্টাবক্র তখন কিছু বলিলেন না, কিন্তু রাত্রিতে শ্বেতকেতুর সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁহার অনেক পরামর্শ হইল।

 অষ্টাবক্র শ্বেতকেতুকে বলিলেন, “চল, আমবা কাল মিথিলায় যাই।”

 শ্বেতকেতু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মিথিলায় যাইব কেন? সেখানে কি আছে?”

 অষ্টাবক্র বলিলেন, ‘সেখানে জনক রাজা যজ্ঞ করিতেছেন, তাহাতে পৃথিবীর যত মুনি ঋষি আর ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সকালেই আসিয়াছেন। ইঁহাদের মধ্যে তর্ক উপস্থিত হইলে, দেখিতে বড়ই চমৎকার হইবে। সেখানে গেলে আমরা সেই তর্কের তামাশাও দেখিতে পাইব, বেদগানও শুনিতে পাইব, আর তাহার উপরে বিস্তর টাকাকড়ি লইয়া ঘরে ফিরতে পারিব।’

 তখন শ্বেতকেতু উৎসাহের সহিত বলিলেন, ‘তবে চল যাই।’

 পরদিন ভোরে উঠিয়া দুইজনে মিথিলায় যাত্রা করিলেন। পথের শোভা দেখিয়া আর যজ্ঞের কথা কহিয়া মনের আনন্দে তাঁহাদের সময় কাটিয়া গেল, সুতরাং মিথিলায় উপস্থিত হইতে তাঁহাদের কোন কষ্টই হইল না। সে সময়ে স্বয়ং মহারাজা জনক রাজপথ দিয়া যজ্ঞস্থানে যাইতেছিলেন, রাজার সিপাহীরা দূর হইতে চিৎকার পূর্বক লোক সরাইয়া পথ পরিষ্কার রাখিতেছিল। অষ্টাবক্র আর শ্বেতকেতুকেও তাহারা সরিয়া যাইতে বলিল। কিন্তু অষ্টাবক্র তাহাদের কথায় কান না দিয়া বলিলেন, “মহারাজ! পথের মধ্যে যতক্ষণ ব্রাহ্মণ আসিয়া উপস্থিত না হন, ততক্ষণ সকলের আগে অন্ধ, তারপর বধির, তারপর স্ত্রীলোক, তারপর মোট মাথায় মুটে, তারপর রাজা পথ পাইবেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ আসিলে সকলের আগে তাঁহাকে পথ ছাড়িয়া দিতে হইবে। সুতরাং আমাদিগকে তাড়াইয়া দিয়া আপনার যাওয়া কেমন হয়?’

 ইহাতে জনক আশ্চর্য এবং সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, ‘ইনি যথার্থই কহিয়াছেন, ব্রাহ্মণ শিশু