দশরথের চোখ জলে ভরিয়া গেল। তিনি অনেক কষ্টে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “ভগবন, আমি আপনার পুত্র নহি। আমি ক্ষত্রিয়, আমার নাম দশরথ। আজ এই অভাগার বাণে আপনার পুত্রের মৃত্যু হইয়াছে। আমি জন্তু মারিবার জন্য সরযুর ধারে বসিয়াছিলাম। আপনার পুত্রের কলসীতে জল ভরার শব্দ শুনিয়া মনে করিলাম বুঝি হাতির শব্দ। অন্ধকারের ভিতরে সেই শব্দের দিকে বাণ ছুঁড়িলাম, তাহাতেই এই সর্বনাশ হইল। এখন এই পাপীর প্রতি আপনার যাহা ইচ্ছা হয় করুন।”
এই বলিয়া দশরথ ছল ছল চোখে জোড়হাতে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
মুনি এই দারুণ সংবাদ শুনিয়াও সাধারণ লোকের মতো ব্যস্ত হইলেন না, রাজাকে কোন কঠিন শাপও দিলেন না। তিনি কেবল একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন “মহারাজ। তুমি না জানিয়া এ কাজ করিয়াছ, তাই রক্ষা পাইলে, নাহলে আজ তোমার বংশসুদ্ধ নষ্ট হইত। এখন এক কাজ কর, আমরা আমাদের পুত্রের নিকট যাইতে চাহি, একটিবার আমাদিগকে সেখানে লইয়া চল।”
রাজা তখনই তাঁহাদের দুজনকে সরযুর ধারে লইয়া আসিলেন। তাঁহাদের চক্ষু নাই, সুতরাং জন্মের মতো একটিবার পুত্রের মুখ দেখিবার উপায় নাই। তাঁহারা কেবল তাঁহার দেহের উপর পড়িয়া বারবার তাঁহাকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। তারপর চিতা প্রস্তুত করিয়া সেই দেহ পোড়ান হইল।
তখন অন্ধ মুনি নিতান্ত দুঃখের সহিত রাজাকে বলিলেন, “মহারাজ। পুত্রের শোকে আমি এখন যে দুঃখ পাইতেছি, এইরূপ পুত্রশোক তোমাকেও পাইতে হইবে।”
এই বলিয়া তাঁহারা দুজনে সেই চিতায় ঝাঁপ দিয়া পড়িলেন, আর দেখিতে দেখিতে তাঁহাদের শরীর ভস্ম হইয়া গেল।
ইহার অনেক বৎসর পরে বৃদ্ধ বয়সে, কৈকেয়ীর ছলনায় দশরথ রামকে বনে দেন, আর সেই রামের শোকে তাঁহার মৃত্যু হয়। তখন অন্ধ মুনির সেই কথাগুলি তাহার মনে পড়িয়াছিল—
‘পুত্রব্যসনজং দুঃখং যদেতস্মম সাম্প্রতম্
এবং ত্বং পুত্রশোকেন রাজন্ কালং করিষ্যসি॥’
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/8/86/Rule_Segment_-_Fancy2_-_100px.svg/100px-Rule_Segment_-_Fancy2_-_100px.svg.png)