পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○88 গল্পগুচ্ছ মতো তর তর করিয়া চড়িতে পারিত, আজ বড়া শরীর লইয়া সে গাছে কিছতেই উঠিতে পারিল না; নিচেকার একটা কচি ডাল ধরিবামাত্র সেটা তাহার শরীরের ভারে ভাঙিয়া গেল এবং বড় সাশীল ধপ করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। কাছে রাস্তা দিয়া লোক চলিতেছিল, তাহারা বড়াকে ছেলেমানষের মতো গাছে চড়িতে ও পড়িতে দেখিয়া হাসিয়া অস্থির হইয়া গেল। সুশীলচন্দ্র লজ্জায় মুখ নিচু করিয়া আবার সেই দাওয়ায় মাদরে আসিয়া বসিল। চাকরকে বলিল, "ওরে, বাজার থেকে এক টাকার লজঞ্জস কিনে আন ।” * লজঞ্জসের প্রতি সশীলচন্দ্রের বড়ো লোভ ছিল । স্কুলের ধারে দোকানে সে রোজ নানা রঙের লজঞ্জস সাজানো দেখিত ; দু-চার পয়সা যাহা পাইত, তাহাতেই লজঞ্জলস ভরিয়া লজঞ্জস কিনিবে এবং খাইবে। আজ চাকর এক টাকায় একরাশ লজঞ্জলস কিনিয়া আনিয়া দিল; তাহারই একটা লইয়া সে দন্তহীন মুখের মধ্যে পরিয়া চুষিতে লাগিল; কিন্তু বড়ার মুখে ছেলেমানষের লজঞ্জস কিছুতেই ভালো লাগিল না। একবার ভাবিল, এগুলো আমার ছেলেমানষে বাবাকে খাইতে দেওয়া যাক ; আবার তখনই মনে হইল, না কাজ নাই, এত লজঞ্জস খাইলে উহার আবার অসুখ করিবে । কাল পর্যন্ত যে-সকল ছেলে সশীলচন্দ্রের সঙ্গে কপাটি খেলিয়াছে, আজ তাহারা সশীলের সন্ধানে আসিয়া বড়ো সশীলকে দেখিয়া দরে ছটিয়া গেল। সশীল ভাবিয়াছিল, বাপের মতো স্বাধীন হইলে তাহার সমস্ত ছেলে-বন্ধদের সঙ্গে সমস্তদিন ধরিয়া কেবলই ডুডু ডুডু শব্দে কপাটি খেলিয়া বেড়াইবে ; কিন্তু আজ রাখাল গোপাল অক্ষয় নিবারণ হরিশ এবং নন্দকে দেখিয়া মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠিল; ভাবিল, চুপচাপ করিয়া বসিয়া আছি, এখনই বুঝি ছোঁড়াগুলো গোলমাল বাধাইয়া দিবে। আগেই বলিয়াছি, বাবা সবেলচন্দ্র প্রতিদিন দাওয়ায মাদর পাতিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতেন, যখন ছোটো ছিলাম তখন দটোমি করিয়া সমষ নষ্ট করিয়াছি, ছেলেবয়স ফিরিয়া পাইলে সমস্তদিন শান্ত শিষ্ট হইয়া, ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া বসিয়া, কেবলই বই লইয়া পড়া মুখস্থ করি। এমন কি, সন্ধ্যার পরে ঠাকুরমার কাছে গল্প শোনাও বন্ধ করিয়া প্রদীপ জালিয়া রাত্রি দশটা এগারোটা পৰ্যন্ত পড়া তৈয়ারি করি। কিন্তু ছেলেবয়স ফিরিয়া পাইয়া সবলচন্দ্র কিছুতেই স্কুলম খো হইতে চাহেন না। সশীল বিরক্ত হইয়া আসিয়া বলিত, “বাবা, ইস্কুলে যাবে না?” সবল মাথা চুলকাইয়া মুখ নিচু করিয়া আস্তে আস্তে বলিতেন, “আজ আমার পেট কামড়াচ্ছে, আমি ইস্কুলে যেতে পারব না।” সশীল রাগ করিয়া বলিত, “পারবে না বইকি ! ইস্কুলে যাবার সময় আমারও অমন ঢের পেট কামড়েছে, আমি ও-সব জানি।” বাস্তবিক সশীল এতরকম উপায়ে স্কুল পলাইত এবং সে এত অলপদিনের কথা যে, তাহাকে ফকি দেওয়া তাহার বাপের কম নহে। সশীল জোর করিয়া ক্ষুদ্র বাপটিকে স্কুলে পাঠাইতে আরম্ভ করিল। স্কুলের ছয়টির পরে সবল বাড়ি আসিয়া খুব একচোট ছাটাছটি করিয়া খেলিয়া বেড়াইবার জন্য অস্থির হইয়া পড়িতেন; কিন্তু ঠিক সেই সময়টিতে বন্ধ সশীলচন্দ্র চোখে চশমা দিয়া একখানা কৃত্তিবাসের রামায়ণ লইয়া সরে করিয়া করিয়া পড়িত, সবলের ছাটাছুটি-গোলমালে তাহার পড়ার