পাতা:চরিত্রহীন - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চরিত্রহীন
৫৫

 আমার মাইনের কথাটা বাবু?

 না, সে কথা নেই।

 টাকার কথা নাই শুনিয়া মোক্ষদা মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া চিঠির জন্য হাত বাড়াইয়া বলিল, তা থাকবে কেন, থাকবে যত-সব বাজে কথা! দিন চিঠি। কাল সাবিত্রী আমাকে একখানা জবাব লিখে দিস ত। হাঁ লা, বাবুর খাবার দিবি কখন? রাত কি এখনও হয়নি?

 সাবিত্রী বলিল, বামুন ঠাকুর সন্ধ্যে-আহ্নিক করবে না, অমনি খাবে?

 মোক্ষদা বিরক্ত হইয়াই ছিল আরো বিরক্ত হইয়া বলিল, শোনো কথা একবার। একি তোর পুরুতঠাকুর, না ভটচায্যি বামুন পেয়েছিস যে পূজো-আহ্নিক করতে যাবে?

 সতীশ হাসিয়া কহিল, ও কি ঝি, সব ভুলে গেলে? আমি ত চিরকালই সন্ধ্যে আহ্নিক করি।

 মোক্ষদার বোধ করি হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল। অপ্রতিভ হইয়া বলিল, ও মা, তাই ত!

 সাবিত্রীর দিকে ফিরিয়া বলিল, দে মা, শিগগীর বাবুর একটা জায়গা করে দে। তোর ঘরে ত সমস্তই ঠিক আছে। দে মা, দে, আর দেরি করিস নে—বলিতে বলিতে মোক্ষদা স্থানান্তরে চলিয়া গেল ।

 ঘণ্টাখানেক পরে, সতীশের আহারের সময় ঘরে কেহ উপস্থিত নাই — অন্ধকার বারান্দা হইতে মোক্ষদা ইহা লক্ষ্য করিয়া একেবারে জ্বলিয়া উঠিল । রান্নাঘরে আসিয়া দেখিল, সাবিত্রী চুপ করিয়া বসিয়া আছে। রুষ্টস্বরে বলিল, এ তোর কি রকম আক্কেল সাবিত্রী! এ কি কাঙ্গালী ভোজন হচ্ছে যে, যা হোক দুটো ফেলে দিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে বসে আছিস!

 সাবিত্রী কি ভাবিতেছিল, চমকিয়া বলিল, দরকার হলে উনি চেয়ে নেবেন।

 এমন বুদ্ধি না হলে আর দাসীবৃত্তি করতে যাস। কোথায় তুই নিজে দাসী চাকর রাখবি, না—

 সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, নিজেই দাসী হয়ে আছি। তাতেই বা দোষ কি মাসী, খেটে খেতে লজ্জা নেই।

 মোক্ষদা রাগিয়া বলিল, কে বললে নেই? আমার মত বয়সে না থাকতে পারে, কিন্তু তোর বয়সে আছে। তা থাক না থাক, বাবুকে যখন খেতে বলেছিস, তখন বসে থেকে খাওয়াগে যা। মানুষের কপাল ফিরে যেতে বেশী দেরী লাগে না!

 সাবিত্রী চলিতে উদ্যত হইয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, কি বকচো মাসী? উনি শুনতে পাবেন যে!

 মোক্ষদা তৎক্ষণাৎ এর নত করিয়া বলিল, না না, শুনতে পাবেন কেন! আর একটা কথা তোকে বলে রাখি বাছা। ভগবান কপালের মাঝখানে যে দুটো চোখ দিয়েছেন সে দুটো একটু খুলে রাখিস। ঘড়ি চেন, হীরের আংটি না থাকলেই