পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
৩৭

 আশা আস্তে আস্তে আপনাকে ছাড়াইয়া লইয়া আঁচল শূন্য করিয়া বকুলগুলা ফেলিয়া দিল। কহিল, “আর কেন। ছি ছি! তুমি শীঘ্র যাও, মাকে ফিরাইয়া আনো গে।”


 এমন সময় দোতলা হইতে “মহিনদা মহিনদা” রব উঠিল। “আরে কে হে, এসো এসো” বলিয়া মহেন্দ্র জবাব দিল। বিহারীর সাড়া পাইয়া মহেন্দ্রের চিত্ত উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। বিবাহের পর বিহারী মাঝে মাঝে তাহাদের সুখের বাধাস্বরূপ আসিয়াছে— আজ সেই বাধাই সুখের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয় বলিয়া বোধ হইল।

 আশাও বিহারীর আগমনে আরাম বোধ করিল। মাথায় কাপড় দিয়া সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল দেখিয়া মহেন্দ্র কহিল, “যাও কোথায়। আর তো কেহ নয়, বিহারী আসিতেছে।”

 আশা কহিল, “ঠাকুরপোর জলখাবারের বন্দোবস্ত করিয়া দিই গে।”

 একটা-কিছু কর্ম করিবার উপলক্ষ আসিয়া উপস্থিত হওয়াতে আশার অবসাদ কতকটা লঘু হইয়া গেল।

 আশা শাশুড়ির সংবাদ জানিবার জন্য মাথায় কাপড় দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বিহারীর সহিত এখনো সে কথা কয় না।

 বিহারী প্রবেশ করিয়াই কহিল, “আ সর্বনাশ! কী কবিত্বের মাঝখানেই পা ফেলিলাম। ভয় নাই বৌঠান, তুমি বোসো, আমি পালাই।”

 আশা মহেন্দ্রের মুখে চাহিল। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারী, মার কী খবর।”

 বিহারী কহিল, “মা-খুড়ির কথা আজ কেন ভাই। সে ঢের সময় আছে। Such a night was not made for sleep, nor for mothers and aunts!”

 বলিয়া বিহারী ফিরিতে উদ্যত হইলে মহেন্দ্র তাহাকে জোর করিয়া টানিয়া আনিয়া বসাইল। বিহারী কহিল, “বৌঠান, দেখো, আমার অপরাধ নাই— আমাকে জোর করিয়া আনিল— পাপ করিল মহিনদা, তাহার অভিশাপটা আমার উপরে যেন না পড়ে।”

 কোনো জবাব দিতে পারে না বলিয়াই এই-সব কথায় আশা অত্যন্ত বিরক্ত হয়; বিহারী ইচ্ছা করিয়া তাহাকে জ্বালাতন করে।

 বিহারী কহিল, “বাড়ির শ্রী তো দেখিতেছি— মাকে এখনো আনাইবার কি সময় হয় নাই।”