পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কুষ্টিয়ার পথে, ২৪ শে আগষ্ট, ১৮৯৪ | পদ্মাকে এখন খুব জাকালো দেখতে হয়েছে—একেবারে বুক ফুলিয়ে চলেছে— ওপারটা একটিমাত্র কাজলের নীলরেখার মত দেখা যায় । আমি এই জলের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবি, বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গতিটাকে যদি কেবল গতিভাবেই উপলব্ধি করতে ইচ্ছা করি তাহলে নদীর স্রোতে সেটি পাওয়া যায়। মানুষ পশুর মধ্যে যে চলাচল তাতে খানিকট চলা খানিকট না চলা, কিন্তু নদীর আগাগোড়াই চলুচে ; সেই জন্যে আমাদের মনের সঙ্গে আমাদের চেতনার সঙ্গে তার একটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আমাদের শরীর আংশিকভাবে পদচালনা করে, অঙ্গচালনা করে, আমাদের মনটার আগাগোড়াই চলেছে। সেই জন্যে এই ভাদ্রমাসের পদ্মাকে একটা প্রবল মানসশক্তির মত বোধ হয়—সে মনের ইচ্ছার মত ভাঙচে চুরচে এবং চলেছে,— মনের ইচ্ছার মত সে আপনাকে বিচিত্র তরঙ্গভঙ্গে এবং অস্ফুট কলসঙ্গীতে নানাপ্রকারে প্রকাশ করবার চেষ্টা করচে। বেগবান একাগ্ৰগামিনী নদী আমাদের ইচ্ছার মত আর বিচিত্ৰ শস্যশালিনী স্থির ভূমি আমাদের ইচ্ছার সামগ্রীর মত । আমাদের বোট ছেড়ে দিয়েছে। তীরটা এখন বামে পড়েছে। খুব নিবিড় প্রচুর সরস সবুজের উপর খুব ঘননীল সজল মেঘরাশি মাতৃস্নেহের মত অবনত হয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে গুরুগুরু মেঘ ডাক্‌চে । বৈষ্ণব পদাবলীতে বর্ষার যখুনাবর্ণনা মনে পড়ে। প্রকৃতির অনেক দৃশ্যই আমার মনে বৈষ্ণব কবির ছন্দঝঙ্কার এনে দেয়। তার প্রধান কারণ এই প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আমার কাছে শূন্য সৌন্দর্য্য নয়— এর মধ্যে একটি চিরন্তন হৃদয়ের লীলা অভিনীত হচ্চে—এর মধ্যে অনস্ত বৃন্দাবন । বৈষ্ণব পদাবলীর মৰ্ম্মের ভিতর যে প্রবেশ করেছে, সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে সে বৈষ্ণৰ কবিতার ধ্বনি শুনতে পায় ।