পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/১১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৬
জোড়াসাঁকোর ধারে

 দ্বিতীয়বার যখন এলেন দশ বছর পরে, তখন আমি আর্টের লাইনে ঢুকেছি। প্রায়ই আমাদের জোড়াসাঁকোর স্টুডিয়োতে বসে শিল্প সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হত। নন্দলালদের তিনি আর্টের ট্র্যাডিশন অবসার্ভেশন ও ওরিজিনালিটি বোঝাতেন তিনটি দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে। দেবতার মত ভক্তি করত ওকাকুরাকে জাপানীরা। আমাদের ছিল এক জাপানী মালী। ওকাকুরা এসেছেন শুনে দেখা করবার খুব ইচ্ছে হল তার। স্টুডিয়োতে বসে আছেন ওকাকুরা, নন্দলালের সঙ্গে কথাবার্তা কইছেন, সে এসে দরজার পাশে দূর থেকে উকিঝুঁকি দিতে লাগল। বললুম, ‘এস ভিতরে।’ কিছুতেই আর আসে না, দূরে দাঁড়িয়েই কাঁচুমাচু করে। খানিক বাদে ওকাকুরার নজরে পড়তে তিনি ডান হাতের তর্জনী তুলে ভিতরের দিকে নির্দেশ করলে পর সে হাঁটু-মুড়ে সেখান থেকেই মাথা ঝুঁকতে, ঝুঁকতে ঘরে এল। ওকাকুরাও দু-একটা কথা জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। সে আবার সেই ভাবেই হাঁটু মুড়ে বেরিয়ে গেল। যতক্ষণ ঘরে ছিল সোজা হয়ে দাঁড়ায়নি। পরে তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমি ওভাবে ছিলে কেন?’ সে বললে, ‘বাবা! আমাদের দেশে ওঁর কাছে যাওয়া কি সহজ কথা? আমাদের কাছে উনি যে দেবতার মত।’

 সেবার ওকাকুরা ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে দেখবেন। অনেক জায়গা ঘোরা হয়ে গেছে, আর দু-চার জায়গা দেখা বাকি। বললুম, যাচ্ছ যখন, কোনারকের মন্দিরটা ঘুরে দেখে এস একবার। নয় তো ভারতবর্ষের আসল জিনিসই দেখা হবে না। ওকাকুরা বললেন, ‘পুরীর মন্দিরও দেখবার বড় ইচ্ছে আমার। ব্যবস্থা করে দিতে পার?’ তখন তিনি কঠিন রোগে ভুগছেন, ভাঙা শরীর; তাই নিয়েই এসেছেন বিদেশে বিভুঁয়ে ভারতের শিল্পকীর্তি দেখতে। জগন্নাথের ডাক পড়েছে আমার বিদেশী শিল্পী ভাইকে। কিন্তু জগন্নাথ ডাকেন তো ছড়িদার ছাড়ে না; লাটবেলাটকে পর্যন্ত বাধা দেয় এত বড় ক্ষমতা সে ধরে, তাকে কিভাবে এড়ানো যায়? শিল্পীতে শিল্পীতে মন্ত্রণা বসে গেল। চুপি চুপি পরামর্শটা হল বটে, কিন্তু বন্ধু গেলেন জগবন্ধু দর্শন করতে দিনের আলোতে রাজার মত। দ্বার খুলে গেল, প্রহরী সসম্মানে একপাশ হল, জাপানের শিল্পী দেখে এলেন ভারতের শিল্পীর হাতে গড়া দেবমন্দির, বৈকুণ্ঠ, আনন্দবাজার, মায় দেবতাকে পর্যন্ত।

 বড় খুশি হয়েছিলেন ওকাকুরা সেবারে কোনারক দেখে। বললেন, ‘কোনারক না দেখলে এবারকার আসাই আমার বৃথা হত। ভারতশিল্পের প্রাণের খবর মিলল আমার ওখানে।’ তাঁর বিদায়ের দিনের শেষ কথা আমার এখনও