পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৬৬

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
জোড়াসাঁকোর ধারে
৫৯

কর্তামশায়ের ছাতিমতলাটি। তাই তিনি এখানে নিজের একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করবার কল্পনা করেছিলেন। এ সমস্তই ছিল তখন শ্রীকণ্ঠবাবুর দখলে।

 তখনকার দিনে গুরুজনদের মান কি দেখতুম। আমদরবার বসেছে, খবর এল, কালীকৃষ্ণ ঠাকুর পাথুরেঘাটা থেকে দেখা করতে আসছেন। শুনে কি ব্যস্ত সবাই। তোল্‌ তোল্‌ হুঁকো কলকে সব তোল্‌, সরা এখান থেকে এসব। বাবামশায় ঢুকলেন ঘরে, পরিষ্কার জামাকাপড় পরে তৈরি। গুরুজন আসছেন, ভালোমানুষ সেজে সবাই অপেক্ষা করতে লাগলেন। ছোট ছেলেদের মত গুরুজনকে ভয় করতেন তাঁরা; গুরুজনরা এলে সমীহ করা, এটা ছিল। কর্তামশায় এসেছিলেন, বলেছি তো সে গল্প—তাড়াহুড়ো, দেউড়ি থেকে উপর পর্যন্ত ঝাড়পোঁছ, যেন বর আসছেন বাড়িতে।

 জোড়াসাঁকোর বাড়ির দক্ষিণ বারান্দার আবহাওয়া, এ যে কি জিনিস! সেই আবহাওয়াতেই মানুষ আমরা। এবাড়ির যেমন দক্ষিণের বারান্দা ওবাড়িরও তেমনি দক্ষিণের বারান্দা। পিসিমাদের মুখে শুনতুম ওবাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বিকেলে দাদামশায়ের বৈঠক বসত। যখন-তখন জুঁই আর বেলফুলের সুগন্ধে সমস্ত বাড়ি পাড়া তর্‌ হয়ে যেত। দাদামশায়ের শখ, বসে বসে ব্যাটারি চালাতেন। জলে টাকা ফেলে দিয়ে তুলতে বলতেন। একবার এক কাবুলিকে ঠকিয়েছিলেন এই করে। জলে টাকা ফেলে ব্যাটারি চার্জ করে দিলেন। কাবুলি টাকা তুলতে চায়, হাত ঘুরে এদিকে ওদিকে বেঁকে যায়, টাকা আর ধরতে পারে না কিছুতেই। তার পর জ্যেঠামশায়ের আমলে তিনি বসলেন সেখানে। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, বড় বড় পণ্ডিত ফিলজফার আসতেন। স্বপ্নপ্রয়াণ পড়া হবে, এ বারান্দা থেকে ছুটলেন বাবামশায়রা সে বারান্দায়। থেকে থেকে জ্যেঠামশায়ের হাসির ধ্বনি পাড়া মাৎ করে দিত। সে হাসির ধুম আমরাও কানে শুনতুম।

 তার পর আমাদের আমলে যখন বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বৈঠক বসবার বয়স হল তখন সেকালের যাঁরা ছিলেন, মতিবাবু, অক্ষয়বাবু, ঈশ্বরবাবু, নবীনবাবু— আর দাদামশায়ের বৈঠকের একটি বুড়ো, কি মুখুজ্যে, নামটা মনে আসছে না, তাঁর ছবি আঁকা আছে, চেহারা গান গলার স্বর সব ধরা আছে মনে, নামটা এরি মধ্যে হারিয়ে গেল, তিনি গাইতেন—দাদামশায়ের বৈঠকখানায়, মাঝে মাঝে আমাদেরও গান শোনাতেন, দাদামশায়ের গল্প বলতেন—এই তিন কালের তিন-চারটি বুড়ো নিয়ে আমরা তিন ভাই বৈঠক জমালেম।