পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৭১

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৬৪
জোড়াসাঁকোর ধারে

শোনেন গুপুর বিধবা বউকে কোলের কাছে নিয়ে। ক্ষেত্রনাথ কথকের বলার ধরন চমৎকার, গলাও ছিল সুমিষ্ট। দক্ষিণের বারান্দার গায়ে নাচঘরটা তখন অস্তমিতমহিমা গন্ধৰ্বনগরের মত ম্লান শোভা ধারণ করেছে। তারই মধ্যে ক্ষেত্রনাথ কথক মায়ের মনের অবস্থানু্যায়ী এক-একটি কথা ভাগবত থেকে বলে চলেছেন, এই ভাবে গেল প্রায় এক বছর।

 তার পর রবিকা একদিন পরগণা থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘শিবুৰ্কীর্তনীয়াকে এনে গান শোনাও। ছোটবউঠানের ভালো লাগবে, তোমাদেরও ভালো লাগবে, ওরকম আমি আর শুনিনি।’ রবিকা ডেকে পাঠালেন তাকে, এল শিবুকীর্তনীয়া। সে যা জমালে। কীর্তনীয়া ছিল বটে, কিন্তু সে ছিল সত্যিই আর্টিস্ট। তার ছবি আছে, দাদা এঁকেছিলেন। মোটাসোটা চেহারা, ভাবছি এই চেহারায় কেমন করে সে রাখালবালকদের গোষ্ঠলীলা গাইবে। কিন্তু সে যখন ‘ওহে ওহে’ বলে সুর আরম্ভ ক’রে, ‘আবা আবা’ বলে রাখালবালক হয়ে গান ধরলে, তখন অবাক্‌। অনেকদিন চলেছিল গান, মাথুর থেকে আরম্ভ করে সমস্ত কৃষ্ণলীলা শুনিয়েছিল সে।

 সেই সময় ক্ষেত্রনাথ কথকের ছুটি হয়ে গেল। তিনি বলে গেলেন, ‘রবিবাবু এসে আমার জমাট আসরটা ভেঙে দিলেন।’ আমার কাছ থেকে একটি ছবি তিনি নিয়েছিলেন চেয়ে। তাঁরই বর্ণনামত এঁকেছি পদ্মফুলের উপরে দাঁড়িয়ে বালক কৃষ্ণ। তিনি বলেছিলেন পুজো করবেন। তাঁর সঙ্গে সেই ছবি কাশীতে গেল। তার পর তিনি মারা যাবার পর সে ছবি হাত ফিরতে ফিরতে কোথায় গেল জানিনে। সেদিন দেখি কোন্‌ এক কাগজে তা ছাপিয়েছে।

 তার পর একদিন মাও গেলেন। দাদাও গেলেন জোড়াসাঁকোর বাড়ি শূন্য করে।

 ক্রমে ক্রমে আমার দক্ষিণ বারান্দার জলসা বন্ধ হল। লক্ষ্ণৌতে গিয়েছিলুম রবিকার সঙ্গে। গোমতীর উপরে বাদশার আমদরবারের ভগ্ন স্তূপে বসে মনে পড়ত আমার দক্ষিণের বারান্দার আড্ডা। তার পর যখন সত্যিই সেই দক্ষিণের বারান্দা প্রায় ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে তখনো মায়া ছাড়তে পারিনি। ভাই বন্ধু সঙ্গী ছাত্র সব চলে গেছে; অতবড় খালি বাড়ির সেই দক্ষিণ বারান্দায় একা বসে আমি পুতুল গড়ি, বৈচিত্র্যহীন জীবনে ওইটুকু বৈচিত্র্য আছে তখনো।

 এমন সময়ে একদিন ফেলাবতী এসে হাজির। কোথা থেকে উঠে এলো এতটুকুন মেয়েটি, নেড়া ভোলা চেহারা; বললুম, ‘কে তুই?’