পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তনু রায়, একবার কঙ্কাবতীকে ডাকিয়া চুপি-চুপি বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! বোধ হইতেছে যে, জামাতা আমার প্রকৃত ব্যাঘ্র নন। বনের শিকড় মাথায় দিয়া মানুষে যে, সেই বাঘ হয়, ইনি বোধ হয়, তাই! আমি ইহাকে নানারূপ সুখাদ্য খাইতে বলিলাম। আমার গোয়ালের বুড়ো গরুটিকে খাইতে বলিলাম, নিরঞ্জনকে খাইতে বলিলাম, গোয়ালিনীকে খাইতে বলিলাম, কিন্তু ইনি ইহার একটিকেও খাইলেন না। যথার্থ বাঘ হইলে কি এসব লোভ সামলাইতে পারিতেন? তাই আমার বোধ হইতেছে, ইনি প্রকৃত বাঘ নন। তুমি দেখিও দেখি? ইঁহার মাথায় কোনওরূপ শিকড় আছে কি না? যদি শিকড় পাও, তাহা হইলে সেই শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিবে। যদি লোকে মন্দ করিয়া থাকে, তো শিকড়টি পোড়াইলে ভাল হইয়া যাইবে। যে কারণেই কেন বাঘ হইয়া থাকুন না, শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিলেই সব ভাল হইয়া যাইবে। তখন পুনরায় মানুষ হইয়া ইনি লোকালয়ে আসিবেন।”

 পিতার এই উপদেশ পাইয়া কঙ্কাবতী যখন পুনরায় মা'র নিকট আসিলেন, তখন মা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “উনি তোমাকে চুপি-চুপি কি বলিলেন?”

 পিতা যেরূপ উপদেশ দিলেন, কঙ্কাবতী সে সমস্ত কথা মার নিকট ব্যক্ত করিলেন।

 মা সেই কথা শুনিয়া বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! তুমি একাজ কখনও করিবে না। করিলে নিশ্চয় মন্দ হইবে। খেতু অতি ধীর ও সুবুদ্ধি। খেতু যাহা করিতেছেন, তাহা ভালর জন্যই করিতেছেন। খেতুর আজ্ঞা তুমি কোনমতেই অমান্য করিও না। সাবধান, কঙ্কাবতী! আমি যাহা বলিলাম, মনে যেন থাকে!”

 রাত্রি অবসান প্রায় হইলে, খেতু ও কঙ্কাবতী পুনরায় খেতু পূর্ব্বের মত কঙ্কাবতীকে চক্ষু বুজিতে বলিলেন, সুড়ঙ্গ দ্বারে পূর্ব্বের মত কঙ্কাবতী সেই বিকট হাসি শুনিলেন। অট্টালিকায় উপস্থিত হইয়া পূর্ব্বের মত ইহারা দিনযাপন করিতে লাগিলেন।


নবম পরিচ্ছেদ

শিকড়

আর একমাস গত হইয়া গেল।

 খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! কেবল আর একমাস রহিল! এই একমাস পরে আমরা স্বাধীন হইব। আর একমাস গত হইয়া যাইলে, আমাদিগকে আর বনবাসী হইয়া থাকিতে হইবে না। এই বিপুল বিভব লইয়া আমরা তখন দেশে যাইব।”

 এক একটি দিন যায়, আর খেতু বলেন,— “কক্কাবতী! আর উনত্রিশ দিন রহিল; কঙ্কাবতী! আর আটাইশ দিন রহিল; কঙ্কাবতী! আর সাতাইশ দিন রহিল।”

 এইরূপে কুড়ি দিন গত হইয়া গেল। কেবল আর দশ দিন রহিল। দশ দিন পরে কঙ্কাবতীকে লইয়া দেশে যাইবেন, সেজন্য খেতুর মনে অসীম আনন্দের উদয় হইল। খেতুর মুখে সদাই হাসি!

 খেতু বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! তুমি এক কর্ম্ম কর? কয়লা দ্বারা এই প্রাচীরের গায়ে দশটি দাগ দিয়া রাখা। প্রতিদিন প্রাতঃকালে উঠিয়া একটি করিয়া দাগ পুঁছিয়া ফেলিব, তাহা হইলে

৬৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ