পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেবদাস
১০৭

 ভোর হইল। সকালবেলা জমিদারবাটী হইতে লোক বাহির হইল,— এক আশ্চর্য দৃশ্য। গাছতলায় একজন লোক মরিতেছে। ভদ্রলোক। গায়ে শাল, পায়ে চকচকে জুতো, হাতে আংটি। একে একে অনেক লোক জমা হইল। ক্রমে ভুবনবাবুর কানে এ কথা গেল, তিনি ডাক্তার আনিতে বলিয়া নিজে উপস্থিত হইলেন। দেবদাস সকলের পানে চাহিয়া দেখিল; কিন্তু তাহার কণ্ঠরোধ হইয়াছিল— একটা কথাও বলিতে পারিল না, শুধু চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। গাড়োয়ান যতদূর জানে বলিল, কিন্তু তাহাতে সুবিধা হইল না। ডাক্তার আসিয়া কহিল, শ্বাস উঠেছে, এখনই মরবে।

 সকলেই কহিল, আহা!

 উপরে বসিয়া পার্ব্বতী এ কাহিনী শুনিয়া বলিল, আহা!

 কে একজন দয়া করিয়া মুখে একফোঁটা জল দিয়ে গেল। দেবদাস তাহার পানে করুণদৃষ্টিতে একবার চাহিয়া দেখিল, তাহার পর চক্ষু মুদিল। আরও কিছুক্ষণ বাঁচিয়া ছিল, তাহার পরে সব ফুরাইল। এখন কে দাহ করিবে, কে ছুঁইবে, কি জাত ইত্যাদি লইয়া তর্ক উঠিল। ভুবনবাবু নিকটস্থ পুলিশ-স্টেশনে সংবাদ দিলেন। ইন্‌স্পেক্টর আসিয়া তদন্ত করিতে লাগিল। প্লীহা-লিভারে মৃত্যু। মুখে রক্তের দাগ। পকেট হইতে দুইখানা পত্র বাহির হইল। একখানা তালসোনাপুরের দ্বিজদাস মুখুয্যে বোম্বায়ের দেবদাসকে লিখিতেছে—টাকা পাঠান এখন সম্ভব নয়। আর একটা কাশীর হরিমতী দেবী উক্ত দেবদাস মুখুয্যেকে লিখিতেছে—কেমন আছ?


 বাঁ হাতে উলকি দিয়া ইংরাজী অক্ষরে নামের আদ্যাক্ষর লেখা আছে। ইন্‌স্পেক্টরবাবু তদন্ত করিয়া কহিলেন, হ্যাঁ, লোকটা দেবদাস বটে।

 হাতে নীলপাথর দেওয়া আংটি—দাম আন্দাজ দেড় শ', গায়ে একজোড়া শাল—দাম আন্দাজ দুই শ'। জামাকাপড় ইত্যাদি সমস্তই লিখিয়া লইলেন। চৌধুরীমহাশয় ও মহেন্দ্রনাথ উভয়েই উপস্থিত ছিলেন। তালসোনাপুর নাম শুনিয়া মহেন্দ্র কহিল, ছোটমার বাপের বাড়ির লোক, তিনি দেখলে—

 চৌধুরীমহাশয় তাড়া দিলেন, সে কি এখানে মড়া সনাক্ত করতে আসবে নাকি?