পাতা:দেবদাস - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেবদাস
৩৫

 বহুক্ষণ পরে দেবদাস পার্ব্বতীর মুখ তুলিয়া ধরিয়া বলিল, পারু, আমাকে ছাড়া কি তোমার উপায় নেই?

 পার্ব্বতী কথা কহিল না। তেমনি করিয়া পায়ের উপর মাথা পাতিয়া পড়িয়া রহিল। নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে শুধু তাহার অশ্রুব্যাকুল ঘন দীর্ঘশ্বাস দুলিয়া দুলিয়া, ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। টং টং করিয়া ঘড়িতে দুইটা বাজিয়া গেল। দেবদাস ডাকিল, পারু!

 পার্ব্বতী রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, কি?

 বাপ-মায়ের একেবারে অমত, তা শুনেচ?

 পার্ব্বতী মাথা নাড়িয়া জবাব দিল যে, সে শুনিয়াছে। তাহার পর দুইজনেই চুপ করিয়া রহিল। বহুক্ষণ অতিবাহিত হইবার পর দেবদাস দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিল, তবে আর কেন?

 জলে ডুবিয়া মানুষ যেমন করিয়া অন্ধভাবে মাটি চাপিয়া ধরে, সেটা কিছুতেই ছাড়িতে চাহে না, ঠিক তেমনি করিয়া পার্ব্বতী অজ্ঞানের মতো দেবদাসের পা দুটি চাপিয়া ধরিয়া রাখিল। মুখপানে চাহিয়া কহিল, আমি কিছুই জানতে চাইনে, দেবদা!

 পারু, বাপ-মায়ের অবাধ্য হব?

 দোষ কি? হও।

 তুমি তাহলে কোথায় থাকবে?

 পার্ব্বতী কাঁদিয়া বলিল, তোমার পায়ে—

 আবার দুইজনে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। ঘড়িতে চারিটা বাজিয়া গেল। গ্রীষ্মকালের রাত্রি, আর অল্পক্ষণেই প্রভাত হইবে দেখিয়া দেবদাস পার্ব্বতীর হাত ধরিয়া কহিল, চল, তোমাকে বাড়ি রেখে আসি—

 আমার সঙ্গে যাবে?

 ক্ষতি কি? যদি দুর্নাম রটে, হয়ত কতকটা উপায় হতে পারবে—

 তবে চল।

 উভয়ে নিঃশব্দ পদক্ষেপে বাহির হইয়া গেল।



সাত

 পরদিন পিতার সহিত দেবদাসের অল্পক্ষণের জন্য কথাবার্তা হইল।