তা চাই বৈ কি! পথে আসিতে আসিতে দেবদাস জড়িতকণ্ঠে কহিল, সুন্দরী, আমাকে তুমি চেন?
চন্দ্রমুখী কহিল, চিনি।
দেবদাস গাহিয়া উঠিল,—অন্য লোকে ভুয়া দেয় ভাগ্যে আমি চিনি—তাহার পর গাড়িতে বসিয়া চন্দ্রমুখীর কাঁধে ভর দিয়া বাটী আসিয়া উপস্থিত হইল। দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া পকেটে হাত দিয়া কহিল, সুন্দরী! কুড়িয়ে তো আনলে, কিন্তু পকেটে যে কিছু নেই—
চন্দ্রমুখী নীরবে তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া আনিয়া একেবারে বিছানায় শোয়াইয়া দিয়া কহিল, ঘুমোও।
দেবদাসের যখন ঘুম ভাঙ্গিল তখন বেলা হইয়াছিল। ঘরে কেহ ছিল না।
চন্দ্রমুখী স্নান করিয়া নীচে রান্নার উদ্যোগে গিয়াছে। দেবদাস চাহিয়া দেখিল, এ ঘরে কখন সে আসে নাই, একটি জিনিসও চিনিতে পারিল না। তাহার গত রাত্রের কোন কথাই মনে পড়িল না; শুধু স্মরণ হইল কাহার একটা আন্তরিক সেবা। কে যেন বড় স্নেহ করিয়া টানিয়া আনিয়া ঘুম পাড়াইয়া দিয়াছিল। এই সময়ে চন্দ্রমুখী ঘরে প্রবেশ করিল। রাত্রের সাজসজ্জার সে অনেকখানি পরিবর্তন করিয়াছিল। গায়ে গহনাগুলি ছিল বটে, কিন্তু পরনে রঙ্গিন কাপড়, কপালে টিপ, মুখে পানের দাগ—এ-সকল ছিল না। নিতান্তই একখানি সাদাসিধা কাপড় পরিয়া ঘরে ঢুকিয়াছিল। দেবদাস মুখপানে চাহিয়া হাসিয়া উঠিল, কোথা থেকে কাল আমাকে ডাকাতি করে আনলে?
চন্দ্রমুখী বলিল, ডাকাতি করিনি—পথ থেকে শুধু কুড়িয়ে নেছিলাম।
দেবদাস হঠাৎ গম্ভীর হইয়া বলিয়া উঠিল, তা যেন হল, কিন্তু তোমার আবার এ-সব কি! কবে এলে? গায়ে যে গয়না ধরে না—দিলে কে?
চন্দ্রমুখী দেবদাসের মুখের প্রতি তীব্র দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, আবার!
দেবদাস হাসিয়া কহিল, না না—তা নয়; একটা তামাশা করতেও কি দোষ? এলে কবে? চন্দ্রমুখী বলিল, দেড়-মাস হল।
দেবদাস মনে মনে যেন কি হিসাব করিল। পরে কহিল, আমাদের বাড়ি যখন গিয়েছিলে, তার পরেই এসেচ?
চন্দ্রমুখী বিস্মিত হইয়া কহিল, তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম—কি করে জানলে?
দেবদাস কহিল, তুমি যাবার পরেই আমি বাড়ি গিয়েছিলাম। একজন দাসী—যে তোমাকে বৌঠাকরুনের কাছে নিয়ে গিয়েছিল, তার কাছেই শুনতে পাই,— কাল অশথঝুরি গাঁ থেকে একজন স্ত্রীলোক এসেছিল, সে ভারী সুন্দরী। আর কি বুঝতে বাকি থাকে! কিন্তু এত গয়না আবার গড়ালে কেন?
চন্দ্রমুখী বলিল, গড়াই নি, এ-সব গিল্টির গয়না, কলকাতায় এসে কিনেচি। তবুও দেখ দেখি, তোমার জন্য আমার কত বাজে খরচ করতে হল! অথচ কাল আমাকে তুমি চিনতেও পারলে না।
দেবদাস হাসিয়া উঠিল; বলিল, একেবারে চিনতে পারিনি, কিন্তু যত্নটি