পাতা:পথের সঞ্চয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পথের সঞ্চয়

 মনের আনন্দে চলিতেছি। ভয় ছিল, সমুদ্রের দোলা আমার শরীরে সহিবে না। সে ভয় কাটিয়া গেছে। যেটুকু নাড়া খাইতেছি তাহাতে আঘাত করিতেছে না, যেন আদর করিতেছে। সমুদ্র আমাকে কোলে করিয়া বহিয়া চলিয়াছে— রুগ্ন বালককে তাহার পিতা যেমন করিয়া লইয়া যায় তেমনি সাবধানে। এইজন্য এ যাত্রায় এখন পর্যন্ত আমার চলিবার কোনো পীড়া নাই, চলিবার আনন্দই ভোগ করিতেছি।

 কেবলমাত্র এই চলিবার আনন্দটুকুই পাইব বলিয়া আমি বাহির হইয়াছি। অনেক দিন হইতে এই চলিবার, এই বাহির হইয়া পড়িবার, একটা বেগ আমাকে উতলা করিয়া তুলিতেছিল! অনেক দিন আমাদের আশ্রমের বাড়িতে দোতলার বারান্দায় একলা বসিয়া যখন আমাদের সামনের শালগাছগুলার উপরের আকাশের দিকে তাকাইয়াছি, তখন সেই আকাশ দূরের দিকে তাহার তর্জনী বাড়াইয়া দিয়া আমাকে সংকেত করিয়াছে। যদিও সেই আকাশটি নীরব তবু দেশদেশান্তরের যত অপরিচিত গিরিনদী-অরণ্যের আহ্বান কত দিগ্‌দিগন্তর হইতে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়া এই আকাশের নীলিমাকে পরিপূর্ণ করিয়াছে। নিঃশব্দ আকাশ বহু দূরের সেই-সমস্ত মর্মরধ্বনি, সেই-সমস্ত কলগুঞ্জন, আমার কাছে বহন করিয়া আনিত। আমাকে কেবলই বলিত, ‘চলো, চলো, বাহির হইয়া এসো।’ সে কোনো প্রয়োজনের চলা নহে, চলার আনন্দেই চলা।

 প্রাণ আপনি চায় চলিতে; সেই তাহার ধর্ম। চলিলে সে যে মৃত্যুতে গিয়া ঠেকে। এইজন্য নানা প্রয়োজনের ও খেলার ছুতায় সে কেবল চলে। পদ্মার চরে শরতের সময়ে তো হাঁসের দল দেখিয়াছ। তাহারা কোন্ দুর্গম হিমালয়ের শিখরবেষ্টিত নির্জন

৫৪