পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শুরু করেন গাড়োয়ালের অলকানন্দা উপত্যকায়। এর মধ্যে একটিতে আমি ১৯৮১ সালে যোগ দিয়েছিলাম। দেখেছিলাম সেখানকার স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রামাবাসিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাটি আর জলের সংরক্ষণের কাজ করছে, পাথরের বেড়া দিচ্ছে, স্থানীয় মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ গাছের চারা লাগানোর কাজে হাত লাগাচ্ছে। ১৯৮০-র দশকে এই সাধারণ মানুষদের বৃক্ষরোপণ এবং তার আশেপাশের জমিতে বনদপ্তরের করা প্ল্যাণ্টেশানের মধ্যে তুলনামূলক মূল্যায়ণ করা হয়েছিল। আহমেদাবাদের Space Application Center, স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি এনেছিল। আমি এবং এস নরেন্দ্র প্রসাদ এ বিষয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষা করেছিলাম। মানুষের বৃক্ষরোপণ অনেক অনেক বেশি সফল হয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম যে মানুষের করা বৃক্ষরোপণে ৮০% চারা বেঁচেছিল, যেখানে বনদপ্তরের প্ল্যাণ্টেশানে চারা বেঁচেছিল ২০%।

 তাই, ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন বাহিনীর মুখ্য নিশানা হয়ে পড়ে চিপকো আন্দোলন এবং তার বন পঞ্চায়েতগুলো। বনদপ্তর চিপকো আন্দোলনের নেতৃত্বদের হেনস্থা করতেই থেকেছে, লতারেনি গ্রাম থেকে গৌরা দেবীকেও হেনস্থা করেছে। এস নরেন্দ্র প্রসাদ, যিনি আগে এইসব প্রকৃতি উন্নয়ন ক্যাম্পগুলোর স্বেচ্ছাসেবকদের অসাধারণ কর্মকাণ্ডের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন, উনি আবার এক দশক পরে সেই লোকালয়গুলিতে ফিরে যান। উনি জানান যে বনদপ্তরের অন্তর্ঘাতের কারণে ঐ অঞ্চলগুলোতে গোরাল (এক ধরণের ছাগল) এবং অন্যান্য জাবর-কাটা-প্রাণীদের বাসস্থানের ক্রমাবনতি হয়েছে। এইরকম ধ্বংসলীলা চলতে থাকলে মর্মান্তিক ফলাফলগুলোও চলতেই থাকবে। যেমন আমরা দেখেছি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে চামোলিতে ভয়ংকর ধস নেমেছিল। যে ধসে বন্যায় ভেসে গিয়েছিল গোটা চামোলি জেলা এবং মারা গিয়েছিল ২০৪ জন মানুষ।

 প্রকৃতিনির্ভর পর্যটন

 ব্রিটিশ অভিজাতদের নেতৃত্বে, ওয়র্ল্ড ওয়ইল্ডলাইফ ফাণ্ডের প্ররোচনায় এবং বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটির তত্ত্বাবধানে ১৯৭২ সালে WLPA-র প্রচারের সমান্তরালে প্রজেক্ট টাইগার বা ব্যাঘ্র প্রকল্প শুরু হল। তাদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে প্রকৃতিনির্ভর পর্যটনের লক্ষ্য ছিল পশ্চিমী বাণিজ্যিক স্বার্থে ফটোগ্রাফি, টেলিভিশন এবং আন্তর্জাতিক বিমান যাত্রার প্রসারের বন্দোবস্ত করা। দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব সাভানা এবং ভারতের পর্ণমোচী অরণ্য বন্যপ্রাণসম্বলিত অবস্থায় দেখার ক্ষেত্রে দারুণ সম্ভাবনাপূর্ণ ছিল। দক্ষিণ আমেরিকা বা পশ্চিম আফ্রিকার বৃষ্টি অরণ্য (রেইন ফরেস্ট) বন্যপ্রাণ দেখার উপযুক্ত ছিল না। এগুলি খনির জন্য নষ্ট করা হয়েছে। তাছাড়াও ইউরোপ এবং আমেরিকায় মাংস যোগান দেবার জন্য গবাদি পশুর খামার তৈরি করতে ধ্বংস করা হয়েছে। আর ভারতের সংরক্ষিত ব্যাঘ্র প্রকল্পের অঞ্চলগুলি WLPA, ১৯৭২ দ্বারা সমর্থিত। এগুলি কেনিয়ার মাসাই মারা সংরক্ষিত ক্রীড়াঙ্গনের আদলে তৈরি করা হয়েছে। আমি ১৯৭১ সালে মাসাই মারায় গিয়েছিলাম। ইউরোপীয় পর্যটকদের যত্নআত্তির লক্ষ্যেই ব্যবস্থাপনায় ইউরোপীয়দের একচ্ছত্র দাপট প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ২০১৯ সালে, আমার বন্ধু বিজয় এদলাবদকর মাসাই মারায় গিয়েছিলেন। ইউরোপীয় পর্যটন সংস্থার হয়ে কাজ করে এমন একজন ভারতীয় এজেণ্টের মাধ্যমেই উনি সমস্ত বুকিং করেছিলেন। ওঁর গোটা পর্যটনটাই খুব কড়াভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল পর্যটন সংস্থাটির দ্বারা। ওঁর মনে হয়েছিল যানচালক ছাড়া আর একজনও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে যাতে কথা বলার কোনো সুযোগ উনি না পান, সেটা নিশ্চিত করতেই এই কড়াকড়ি। আমার বন্ধু রাস্তার ধারের ফেরিওয়ালার থেকে সামান্য অলঙ্কার কিনতে

16