পাতা:প্রকৃতি বনাম মানুষঃ একটি পরিকল্পিত সংঘাত - মাধব গাডগিল.pdf/৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গ্রহণ করবে। তিনি গ্রামবাসীদের পক্ষে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। বহু আধিকারিকও সেসময়ে তাঁকে সমর্থন করেছিলেন। তাই, মাদ্রাজের রাজস্ব দপ্তর রাষ্ট্রের জঙ্গল অধিগ্রহণকে ‘সংরক্ষণ নয়, বরং বাজেয়াপ্তকরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। স্থানান্তরী কৃষি (shifting cultivation) ছিল বিবাদের আরও একটি মূল জায়গা। এ সময়ে এইধরণের কৃষি বেশ প্রচলিত ছিল পাহাড়ি অঞ্চলে এবং ম্যালেরিয়াপ্রবণ অঞ্চলে। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ গাছ বাদ দিয়ে, বেড়ে ওঠা গাছ পরিষ্কার ক’রে, ঝোপঝাড় কেটে, পরপর ২/৩ বছর মানুষ বাজরা বা মিলেট জাতীয় শস্য চাষ করতেন। তারপর চলে যেতেন অন্য কোনো একটুকরো জমির খোঁজে, আর এই জমি প’ড়ে থাকত ১৫-২০ বছর, বনাচ্ছাদন বেড়ে ওঠার জন্য। বহু ব্রিটিশ আধিকারিকের মতে, এটি গরিব মানুষের জীবনধারণের ভালো বন্দোবস্ত ছিল। তাছাড়া, তারা সমস্ত বন ধ্বংসও করতো না; আম, মহুয়া, হরিতকি এবং অন্যান্য মূল্যবান গাছ রেখে দিত। কিন্তু ব্রিটিশ চা-কফি এস্টেট (বাগিচা)-এর মালিকেরা এই স্থানান্তরী কৃষি চালিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করলো। তারা বলেছিল, জোর করে স্থানান্তরী কৃষি বন্ধ না করলে, তারা তাদের এস্টেটের জন্য মজুর পাবে না। এই এস্টেট মালিকরা এমন মজুর চাইত, যাদের ক্রীতদাসের মতো খাটানো যায়। আসলে, তাদের আত্মীয়স্বজন সকলেই ১৮৬০-এ উত্তর আমেরিকায় কার্পাস চাষে বিপুল পরিমাণ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসকে ভয়ানক শোষণ করেই ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। সবমিলিয়ে, ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল সাধারণ মানুষকে সম্পদহীন ক’রে শুধুমাত্র তাদের সেনাবাহিনী ও নির্মাণকাজের প্রয়োজনে কাঠ উৎপাদনের জন্য জঙ্গলকে উৎসর্গ করা। তাই, তারা স্থানান্তরী কৃষির সঙ্গে সঙ্গে কৌম মালিকানাকেই বেআইনি ক’রে দেয়; ব্র্যাণ্ডিসকে অগ্রাহ্য করেই সমস্ত কৌম-জমিকে রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করে।

 বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটি

 আসামের দুই চা প্ল্যাণ্টার এবং পরবর্তীতে দক্ষিণ ভারতের কফি প্ল্যাণ্টার ই পি গী এবং এম সি মরিস ছিলেন বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটির (BNHS) দুই প্রভাবশালী সদস্য ও সেলিম আলীর কাছের বন্ধু। সেই সেলিম আলী, যিনি স্বাধীন ভারতের অরণ্য ও বন্যপ্রাণ ব্যবস্থাপনা নীতি রূপায়নে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। দু’জনেই ছিলেন প্রথমসারির প্রকৃতিবিদ। যাদের লেখা আমি স্কুলজীবনে বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটির জার্নালে বেশ মনযোগ দিয়ে পড়েছি। ১৯৭৫-এ আমি কর্ণাটকের মাইসোর জেলায় বিলিগিরিরাঙা পাহাড়ে গিয়েছিলাম, তার চূড়োয় থাকা ১১৮ ফুট লম্বা প্রাচীন বৃক্ষকে এক ঝলক দেখতে। বিপুলাকার বৃক্ষটি কান্নাড়ি জনগণের কাছে মিচেলিয়া চম্পক নামে বিখ্যাত, সোলিদাস জনজাতির কাছে পবিত্র। সেলিম আলির তুতো-ভাই জাফর ফুটহেলি আমায় একটা কফি এস্টেটের অতিথিশালায় থাকার বন্দোবস্ত ক’রে দিয়েছিলেন, যা আগে মরিসের মালিকানায় ছিল। এস্টেটের তৎকালীন ম্যানেজারের যেহেতু পাহাড়ের সৌন্দর্য্য বা বন্যপ্রাণ নিয়ে কোনোরকম উৎসাহই ছিল না, অগত্যা আমি সুপারভাইজার মুকাদামের সঙ্গে আলাপ জমাই। মুকাদাম মরিস পরিবারে বহু বছর ধ’রে কর্মরত ছিল; পরিবারটি এস্টেট বেচে দিয়ে একেবারে ইংল্যাণ্ড ফেরা পর্যন্ত। উনিই বলেছিলেন যে ব্রিটিশ রাজত্বের সেইসব পুরনো দিনের কথা তার খুব মনে পড়ে; যখন তার হাতের চাবুকটাই ব’লে দিত মজুরদের কতটা খাটনি খাটা উচিত। এখন চাবুক বিদেয় হবার ফলে অনেক বেশি খাটানোর জন্য অনেকটা পরিশ্রম করতে হয়। প্রাথমিকভাবে আমি একটু ধাক্কা খেলেও তেমন অবাক হইনি। আমি তখন রাজা রাও-এর উপন্যাস ‘কণ্ঠপুরা’ পড়ছিলাম। সেখানে

8