পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৭২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

689 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড হাজার হাজার গ্রামে মাঠে প্রান্তরে বনে জঙ্গলে নদীতে ছড়িয়ে টেনে বিস্তৃত করা যায়, তবেই শত্রপক্ষের সাপ্লাই লাইনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, তাকে জলে কাদাতে পাঁকে জঙ্গলে কবর দেওয়া সম্ভব হবে। শত্ৰপক্ষই চেয়েছিল একপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ও যাবে শত্রপক্ষের বিপদ তত বাড়তে থাকবে। বর্ষা এসে গেলে শত্রপক্ষের ক্যান্টনমেন্ট-ঘাঁটি থেকে বের হওয়াও বিপজ্জনক হবে। ততদিনে জনসাধারণের শক্তির পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের কাজ অনেকটা গুছিয়ে আনা সম্ভব হবে, কেন্দ্রীয় কম্যান্ড পুনর্গঠিত হবে, ভারত ও পৃথিবীর সাহায্য পাওয়া সম্ভব হবে। তখন, এমনকি ক্যান্টনমেন্ট বা ঘাঁটিতে আবদ্ধ ও আশ্রিত শত্রসৈন্যদের উপর গ্রাম দেশ থেকে-চারিদিক থেকে-প্রতিআক্রমণ সংগঠিত করাও সম্ভব হতে পারে। মর্টার জাতীয় আগ্নেয় অস্ত্রের সাহায্যে এই ঘাঁটিগুলিকে চূর্ণ করে দেওয়াও অসম্ভব হবে না। আমেরিকার মত একটা সুপার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকেই যদি ভিয়েতনামে এমন আবদ্ধ ও নাজেহাল হতে হয়, তবে এই ক্ষুদে সাম্রাজ্যবাদীরা-ইয়াহিয়া-ভুট্টো খানেরা-কতদিন সে শক্তির মোকাবিলা করতে পারবে? ততদিনে পৃথবীর জনমতও সোচ্চার হতে বাধ্য। এত বড় হত্যাকান্ড- যে পৃথিবীতে কোথাও ঘটেনি- তার বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া না হয়েই পারে না। গণতান্ত্রিক পশ্চিমীরা, স্বাধীনতাকামী আফ্রো-এশীয় দেশবাসীরা, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির রাষ্ট্রসমূহ আজও তেমন সোচ্চার নয় দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এইসব দেশের রাষ্ট্র নায়কেরাই তাদের নিজ নিজ ক্ষুদ্র স্বাৰ্থ বুদ্ধির খাতিরে তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে না, প্রকৃত সংবাদও তাদের নিজ নিজ দেশের লোকদের পরিবেশন করছে না। এইসব রাষ্ট্রের ভীরুতা ও সুবিধাবাদী নীরবতা তদেশীয় জনসাধারণ খুব বেশীদিন সহ্য করবেন, এমন মনে করার কারণ নেই। সুখের বিষয় বা আশার কথা এই যে ভারতের সব রাজ্যের সকল জনতা এত বড় হত্যাকান্ড ও বিশ্বাসঘাতক তাকে আজ বরদাস্ত করতে প্রস্তুত নয়। ভারতের প্রতি কোণে কোণে তীব্র প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে উঠছে। পূর্ব বঙ্গের লোকদের সাহায্য করার জন্য প্রাণ কেঁদে উঠছে। এদেশের সরকারের পক্ষেও তা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। প্রায় তিন হাজার মাইল যে সীমান্ত আছে তার এপারে সর্বত্র এদেশের জনসাধারণ পূর্ববঙ্গের লোকদের প্রাণে মারবার চক্রান্ত ব্যর্থ করবেই। যদি আমাদের কোন রাষ্ট্র বলে শক্তি থেকে থাকে, সে রাষ্ট্রের যদি সামরিক কিছু শক্তি থেকে থাকে- তা যদি এত বড় হত্যাকান্ডের প্রতিরোধে কোন কাজে না লাগে তবে সে রাষ্ট্রের ও সে সামরিক শক্তির কি প্রয়োজন, মানবতার উপর এমন বিশ্বাসঘাতকতা, গণতন্ত্রের উপরে এমন নির্মম আঘাত, আর এত বড় হত্যাকান্ড আমাদের হাতের সামনেই ঘটবে, আমাদের হাতখানাও তার প্রতিবাদে বাড়ানো হবে না-এই কি সভ্যতার দায়িত্ব ? কোন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ, বড় বড় শক্তিগুলির অনুমতির জন্য প্রতীক্ষা, রাষ্টসঙ্ঘ নামক একটা অপদার্থ নপুংসক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা অনিচ্ছা-ইত্যাদি কোন কিছুর দোহাই দিয়েই আমরা আমাদের মানবিক কর্তব্যকে এড়িয়ে যেতে পারি না। এ দায়িত্ব এড়ালে, রাষ্টসঙ্ঘ যা-ই বলুক, বড় বড় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলির ভয়ে যদি আমরা আমাদের কর্তব্য পালন না করি, তবে আমাদের নিজেদের স্বাধীনতারও কোন ঐতিহাসিক অধিকার থাকে না, থাকা উচিত নয়। আমাদের রাষ্ট্র যদি কিছু নাও করে ভারতের জনসাধারণ নিজেদের হাতে সে দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং করছে। সেদিন (গত রবিবার) পেট্রোলের সীমান্ত অতিক্রম করে লক্ষ লক্ষ (সত্যি লক্ষাধিক) নরনারী যশোহরের সংগ্রামী বাঙালী ভাইদের দেখতে যেভাবে অগ্রসর হয়েছিল, এপারের সীমান্তরক্ষীরা সে জনস্রোতকে বন্ধ করতে সাহস পায়নি। সেই লক্ষাধিক নরনারীরা হাতে কিছু না কিছু সাহায্য-খাদ্য বস্ত্র তেল ইত্যাদি ছিল। প্রত্যেকে নিজের হাতে সে সামান্য সামগ্রী ওপারের যোদ্ধাদের হাতে হাতে পৌছে দেবার সে অপূর্ব দৃশ্য যাঁরাই দেখেছেন তাঁরা অভিভূত হয়েছেন। এতে হয়তো সীমান্তের আইন লঙ্ঘন করা হয়েছিল, কিন্তু মানবিকতার চিরন্তন আইন তাতেই রক্ষিত হয়েছিল। আর কিসের আইন? আজকে পূর্ব বঙ্গে কোন রাষ্ট্র আছে, না তার কোন আইন আছে। একদল নরঘাতক দস্য অকাতরে নিরস্ত্র জনতার প্রাণ হননে ব্যস্ত সেখানে। এ সভ্যতার উপরে আক্রমণ, এ কোন দেশের কথা নয়। পৃথিবীর সকল মানুষের এখানে দায়িত্ব ও অধিকার আসে।