পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
82

 এ অপারেশনের ফলে পাক বাহিনী তাদের গতিবিধি অনেকাংশে সীমিত করতে বাধ্য হয়। অপরদিকে এই অপারেশনের ফলে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সূদুর গ্রামাঞ্চলে তাদের গোপন অবস্থান বিপদমুক্ত রাখা সম্ভব হয় এবং তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পাকসেনাদের আক্রমণ চালাতে থাকে।

 ২রা জুলাই সকাল সাড়ে ৫টার সময় একটা দল মোঃ হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে শত্রুদের লাটুমুড়া অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে মর্টারের সাহায্যও নেয়া হয়। আক্রমণের ফলে ১২ জন পাকসেনা নিহত ও ৪ জন আহত হয়।

 কুমিল্লাতে আমাদের এ্যাকশন তীব্রতর হওয়ার জন্য পাকসেনারা কুমিল্লার উত্তরে গোমতী বাঁধের উপর তাদের অবস্থান তৈরী করে এবং এরপরে তারা তাদের কতৃত্ব আরও উত্তরে বাড়ানোর জন্য টহল দিতে শুরু করে। পাক সেনারা যাতে শহরের বাইরে তাদের কতৃত্ব পুনঃস্থাপন করতে না পারে সেজন্য আমি 'বি' কোম্পানীর দুটো প্লাটুনসহ কোটেশ্বর নামক স্থানে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলতে নির্দেশ দিই। পাকসেনারা ২/৩ দিন এই এলাকায় সম্মুখবর্তী জায়গায় তাদের টহল বজায় রাখে। এরপল ৪ ঠা জুলাই পাকসেনাদের একটি ভারী দল সকাল ৪ টার সময় আমাদের অবস্থানের আধামাইল পশ্চিমে কোটেশ্বর গ্রামের ভিতর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সকাল ৪টা ১৫ মিনিটে তারা আরো অগ্রসর হয়ে আমাদের ২০০/৩০০ গজের মধ্যে পৌঁছে। এ সময় আমাদের সৈন্যরা তাদের উপর গুলি চালায়। পাকসেনারা ২/৩ ঘণ্টা প্রবল চাপ চালিয়ে যায় অগ্রসর হবার জন্য কিন্তু আমাদের গুলির মুখে বারবারই পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এরপর তারা ৫০০/৬০০ গজ পিছু হটে গিয়ে আমাদের বামে ‘সারিপুরের' দিকে আবার অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। এবারও পাকসেনারা আমাদের গোলাগুলির সামনে টিকতে না পেরে সম্পুর্ন পর্যদুস্ত হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে পাক সেনাদের কমপক্ষে ৩০ জন হতাহত হয়। আমাদের ১ জন প্রাণ হারায়।

 হোমনা থানা পাকসেনাদের জন্য সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন স্থান ছিল। ঢাকাতে যেসব গেরিলাকে পাঠাতাম অপারেশনের জন্য, তারাও এই হোমনা দিয়ে যাতায়াত করত। সে জন্য পাকসেনারা লঞ্চে করে সব সময় দাউদকান্দি থেকে হোমনায় টহল দিতে আসত। আর হোমনার দালাল পুলিশেরা পাকসেনাদের মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে খবরাখবর দিত। এ পুলিশ ষ্টেশনটি আমার জন্য একটা বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেজন্য এ থানাটিকে দখল করে নেয়ার জন্য আমি হাবিলদার গিয়াসকে নির্দেশ দিই। হাবিলদার গিয়াস তার সেনাদল ও স্থানীয় গেরিলাদের নিয়ে থানাটি আক্রমণ করার প্রস্তুত নেয়। তারা খবর নিয়ে জানতে পারে যে, থানাতে বাঙালী পুলিশ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশও যথেষ্ট আছে। থানা রক্ষার্থে পুলিশ থানার চতুর্দিকে বাঙ্কার তৈরী করেছে এবং কয়েকটা হালকা মেশিনগানও তাদের কাছে আছে। সম্পূর্ণ খবরাখবর নিয়ে হাবিলদার গিয়াস থানা আক্রমণের একটি পরিকল্পনা নেয়। ১লা জুলাই রাত ১১টার সময় হাবিলদার গিয়াস তার গণবাহিনী ও নিয়মিত বাহিনীকে নিয়ে থানাটি অতর্কিতে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশেরা হালকা মেশিনগানের সাহায্যে বাধ দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যে আক্রমণের মুখে তারা সবাই নিহত হয়। হাবিলদার গিয়াস থানাটি দখল করে নেয়। এর ফলে থানার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র তার হস্তগত হয় এবং আমাদের ঢাকা যাবার রাস্তাও শত্রুমুক্ত হয়।

 আমাদের একটি প্লাটুন মিয়াবাজার থেকে ফুলতলীতে টহল দিতে যায়। রাত ৩টার সময় তারা দেখতে পায় পাকসেনাদের ১টি জিপ এবং ২টি ট্রাক কুমিল্লা থেকে দক্ষিণের দিকে টহল দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্লাটুনটি কুমিল্লা চট্টগ্রাম রাস্তার উপর এ্যামবুশ-এর জায়গায় তারা ১টি তারা ১টি মেশিনগান ও ৩টি হালকা মেশিনগান রাস্তার দুদিনক থেকে লাগিয়ে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করে। রাত সাড়ে ৪টায় পাকসেনাদের গাড়ীগুলি মিয়াবাজার অবস্থানে ফেরত আসে। আসার পথে গাড়ীগুলি আমাদের এ্যামবুশ-এ পড়ে যায়। এ্যামবুশ পার্টি খুব নিকটবর্তি স্থান থেক মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগানের গুলি চালিয়ে গাড়িগুলি ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। পাকসেনারা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করে কিন্তু এতেও তাদের অনেক লোক মেশিনগানের গুলিতে