পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
92

দলগুলিকে নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই নির্দেশ অনুযায়ী পরীক্ষার দিন সিদ্ধেশ্বরী স্কুল এবং আরো অন্যান্য স্কুলে পরীক্ষার ঠিক পুর্ব মুহূর্তে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করানো হয়। ফলে খুব কমসংখ্যক ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দেয়ার জন্য পরীক্ষা হলে আসে। ১৫ই জুলাই রাতে একটি গেরিলা দল বকশীবাজারে অবস্থিত বোর্ড অফিস আক্রমণ করে। ডিমোলিশন দিয়ে বোর্ড ভবনের বেশ কিছু অংশ দেয়া হয়। তার ফলে বোর্ড বেশকিছু দলিল এবং কাগজপত্র ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে এই পরীক্ষা প্রহসনে পরিণত হয় এবং অনেক ছাত্রছাত্রী ইচ্ছাকৃতভাবেই পরীক্ষা বর্জন করে।

 হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে আমাদের মুরাদনগরের দলটি ১৬ই জুলাই রাত ১টার সময় ইলিয়টগঞ্জের দেড় মাইল পশ্চিমে পুটিয়া গ্রামের সামনে কুমিল্লা দাউদকান্দি সড়কের উপর কয়েকটি এণ্টি- ট্যাংক মাইন পুঁতে রাখে। পরদিন সকালে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রনাধীনে একটি ওয়াপদা ট্রাক মাইনের উপর বিস্ফোরিত হয়। ফলে ট্রাকটি ধ্বংস হয়ে যায়। ট্রাকে অবস্থানরত একজন পাকসেনা, দুজন রাজাকার ও ড্রাইভারসহ সবাই নিহত হয়। ফলে ৫ জন পাকসেনা, ১ জন পাক মেজর ও ৬জন রাজাকার নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে কুমিল্লা থেকে পাকসেনারা ৩০টি গাড়ীতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পাকসেনাদের গাড়ীগুলি ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে এসে দাঁড়ায়।

 সামনের গাড়ী থেকে বেশ কিছুসংখ্যক পাকসেনা নেমে আস্তে আস্তে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। তারা রাস্তার পাশ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। অগ্রসর হবার সময় আমাদের পুঁতে রাখা এণ্টি-পার্সোনাল মপাইনের বিস্ফোরণে তাদের ৬/৭ জন নিহত হয় এবং আরও অনেক আহত হয়। এরপর পাকসেনারা আর সম্মুখে অগ্রসর হয়নি। সমস্ত দিন পাকসেনারা মাইন ডিটেকটরের সাহায্যে ঘটনাস্থলের চতুর্দিকে তন্ন তন্ন করে তল্লাশী চালায়। সমস্ত বেসামরিক যাতায়াতও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা পাশ্ববর্তী গ্রামগুলিতে মুক্তিবাহিনীর সন্ধানে যথেষ্ট তল্লাসী শুরু করে। হাবিলদার গিয়াসের দলের একজন নায়েক মোস্তফা কাপমাল স্থানীয় লোকদের সাথে মিশে পাকসেনাদের দুরবস্থা দেখে। দাউদকান্দি থেকে পশ্চিমে নারায়নগঞ্জে এবং দাউদকান্দি সড়কের উপর বাউসিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ছিল। এই সেতুটি সম্পূর্ণ কংক্রিটের তৈরী এবং বেশ মজবুত। এই সেতুটি ধ্বংস করার জন্য জুলাই মাসের প্রথমে আমি মোঃ রফিক নামে একজন বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাকে মনোণিত করি। তার সঙ্গে আরেকটি গেরিলাকে দিয়ে এই সেতুররেকি করার জন্য পাঠাই। মোঃ রফিক সেতুটি পুঙ্খানুপুঙ্করূপে রেকি করে এবং একটি নকশা বানিয়ে নিয়ে আসে। এরপর অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর ছেলে ভাষণের নেতৃত্বে ১০জনের একটি ডিমোলিশন পার্টিকে রফিককে সঙ্গে দিয়ে বাউসিয়া সেতুটি ধ্বংস করার জন্য পাঠিয়ে দেই। এই দলটি প্রথম মুরাদনগরে গিয়ে তাদের স্থায়ী ঘাঁটি করে। এর পরপর তারা গোমতী নদী পার হয়ে বাউসিয়াতে পৌঁছে। সেখানে একদিন থাকার পর স্থানীয় গেরিলাদের সাহায্যে নিয়ে ১২ই জুলাই রাতে বাউসিয়া সেতুতে ডেমোলিশন লাগায় কিন্তু ডেমোলিশন বিস্ফোরণের সময় ‘ইগনিশ’ ঠিকমত কাজ করে না। ইত্যবসরে স্থানীয় দালাল চেয়ারম্যান এবং রাজাকার পাক বাহিনীদের খবর। পাকবাহিনী এবং রাজাকার অকস্মাৎ ভাষণের ডিমোলিশন পার্টির উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ভাষণের দলের ৩জন গেরিলা গুরুতর ভাবে আহত হয়। এই ৩ জনের মধ্যে ১জন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক কোরাইশীও ছিল। গেরিলা দলটি ইগনিশনকাজ না করার দরুন সেতু উড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে পাক বাহিনীর আক্রমণের চাপে অবস্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। যদিও আহত গেরিলাদের সঙ্গে আনতে সক্ষম হয় কিন্তু যেসব বিস্ফোরক সেতুটি লাগানো হয়েছিল সেগুলি উঠিয়ে আনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়না এবং তারা ২৬০ পাউণ্ড আই-এন-টি সেখানেই ফেলে রেখে হেডকোয়ার্টারে ফেরত আসে। এত বিরাট পরিমাণ আই এনটির শত্রুর হাতে পড়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে একটা বিরাট ক্ষতির কারণ। ঐ সময়ে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আমাদের খুব কম ছিল। অনেক চেষ্টার পর হয়ত কিছু কিছু আমা যোগাড় করতে সক্ষম হতাম। ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তা বন্ধ করে দেয়া আমার লক্ষ ছিল। সেই লক্ষে এইভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় আমি যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং পরপরই আবার বিস্ফোক যোগাড়ের চেষ্টায় থাকি। ২/৩ সপ্তাহ পরে অনেক