পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
126

সময় তারা নৌকার সাহয্যে খাল পার হয়ে বেইস-এ দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। পাকসেনারা নিকটে পৌঁছলে আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। দু'ঘণ্টার যুদ্ধে ১জন মেজরসহ ৩৭ জন পাকসেনা নিহত হয। খাল পার হতে না পেরে এবং অনেক হতাহতের ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমাদের কোম্পানীটা পরে সেখান থেকে নিরাপদে অন্য বেইস-এ চলে আসে।

 কুমিল্লার দক্ষিণে পাকসেনাদের কংসতলা ঘাঁটিটি আমাদের গেরিলা বাহিনীর যাতায়াতে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি করছিল। এই ঘাঁটি থেকে পাকসেনাদের টহলদার দল আমাদের যাতায়াত পথে বিশেষ তৎপরতা চালাতো। এই ঘাঁটিটিকে ধ্বংস করে দেবার জন্য ক্যাপ্টেন মাহবুবকে নির্দেশ দেয়া হয়। বিশেষ তথ্য অনুসন্ধান করে ৫০ জনের একটি দল ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ৩০ শে সেপ্টেম্বর রাত একটায় এই ঘাঁটিতে অনুপ্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর সুবেদার শাহজামান সহ ১৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। পাকসেনারা এই আক্রমণের ফলে এতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে, সেখান থেকে তারা তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে কুমিল্লায় চলে যেতে বাধ্য হয়। এর দু'দিন পর আমাদের ডিমোলিশন পার্টি পেপুলিয়া বাজারের নিকট লালমাই-সোনাজাজী সড়কের একটি সেতু বিস্ফোরক গিয়ে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা এই রাস্তাটিকে ট্যাঙ্ক এবং বারী গাড়ী চলাচলের জন্য পুনঃনির্মাণের চেষ্টা করছিল। সেতুটি ধ্বংস করে দেবার পর তারা রাস্তা মেরামতের কাজ বন্ধ করে দেয়। আমাদের আরেকটি গেরিলা দল চান্দিনার নিকটে দোতুলাতে রাস্তায় মাইন পুঁতে পাকসেনাদের একটি গাড়ী ধ্বংস করে দেয়। এছাড়াও কুমিল্লার দক্ষিণে ও উত্তরে ১লা অক্টোবর থেকে ৩রা অক্টোবর আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন সংঘর্ষে প্রাণছড়া, কোটেশ্বর, আজনাপুর, বিবিরবাজার, আমতলী প্রভৃতি জায়গায় ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়।

 আমাদের ৪১ জনের একটি গেরিলা দল ১লা অক্টোবর তাদের ট্রেনিং শেষ করে রাত ৮টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। কসবার দক্ষিণ দিক দিয়ে এই দুটি নৌকায় উজানের শাহ সেতুর নিকট পৌছে। পাকসেনাদের একটি টহলদারী দল রাত ১১টায় আমাদের দ্বিতীয় নৌকাটিকে দেখতে পায় এবং আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে আমাদের পাঁচজন গেরিলা শহীদ ও তিনজন আহত হয়। ১৫টি রাইফেল ও ৫টি স্টেসগান পানিতে পড়ে হারিয়ে যায়। বাকী গেরিলারা অতিকষ্টে শত্রুদের নাগালের বাইরে চলে আসতে সক্ষম হয়। এই ঘটনার তিনদিন পর লেঃ ইমামুজ্জামনের ৪ঠা অক্টোবর সকাল পাঁচটায় চৌদ্দগ্রামের ৫ মাইল উত্তরে হরিসর্দার বাজারে পাক অবস্থানের উপর ১০৬ এম এম আর আর ও ৮১ এম এম মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর ৭টি বাঙ্কার ধ্বংস করে ২৫ জন পাকসেনা ও ৭ জন রাজাকারকে হতাহত করে। মুক্তিযোদ্ধারা চৌদ্দগ্রামের তিন মাইল দক্ষিণে একটি সেতুও ধ্বংস করে দেয়। ৪ঠা ও ৫ই অক্টোবর কুমিল্লার উত্তরে আজনাপুর ও জামবাড়ি এলাকায় আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের বেশ কটি টহলদারী দলকে আক্রমণ করে ১৫ জনকে নিহত ও ২০ জনকে আহত করে। আমাদের ১ জন শহীদ ও ১ জন আহত হয় কুমিল্লাতে গোমতী বাঁধে মাইন পুঁতে পাকসেনাদের ১টি জীপ ধ্বংস করে দেয়া হয়। সেই সঙ্গে একজন অফিসারসহ তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়া রামচন্দ্রপুর এবং বাংগুরা ডাকঘর জ্বলিয়ে দেয়া হয়। হোমনা থাকায় অবস্থিত পাকসেনাদের একটি দলে সঙ্গে তিন তারিখ রাত সাড়ে তিনটার সময় আমাদের একটি গেরিলা দলের সংঘর্ষ হয়। ৬ ঘণ্টার যুদ্ধে পাকসেনারা সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের দ্বারা বন্দী ১৯ জন ব্যক্তিকে মুক্ত করে দেয় এবং ৯টি রাইফেল দখল করে। এরপর হোমনা এলাকা সম্পূর্ণরূপে আমাদের কর্তৃত্বে আসে। ৬ই অক্টোবর রাত ৩টার সময় পাকসেনাদের একটি দল দুর্লভপুরের নিকট আমাদের এ্যামবুশে পড়ে যায়। এই এ্যামবুশে একজন ইঞ্জিনিয়ার কোর-এর অফিসারসহ ১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা গোমতীর উত্তরে আবার তাদের আধিপত্য পুনরুদ্ধারের জন্য তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। পাকসেনাদের এই তৎপরতাকে বাধা দেবার জন্য ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম দু'টি প্লাটুন পানছাড়ার এবং মোহনপুরে পাঠায়। এই প্লাটুনগুলো পাকসেনাদের চলাচলের রাস্তায় এ্যামবুশ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। ৮ তারিখ রাতে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল গোমতী পার হয়ে পানছাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। সকাল ছ'টার সময় এই দলটি আমাদের এ্যামবুশের আওতায় আসে।