পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
184

তারপর....। আবার যাত্রা শুরু হলো। আগের পথ চলার অভিজ্ঞতাগুলো আবার ডিঙ্গিয়ে চলাম। বেলা বাড়ছে। মাথার উপর সূর্যের তাপ ক্রমশ বাড়ছে। আমরা প্রায় পাহাড়ের শেষপ্রান্তে। আর একটু এগুলোই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।

 দুপুর ১২টা বেজে ৫ মিনিট। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছে গেলাম। শত্ররা তখন হাটহাজারী পুলিশ স্টেশনে ছিল। আমরা এখানে পৌঁছেই শত্রুদের প্রকৃত অবস্থা জানতে তৎপর হলাম। ওরা কি পরিমাণে, কোথায় কোথায় কি ধরনের শক্তি নিয়ে আছে, সর্বাগ্রে তা আমাদের জানা দরকার। কিন্তু তক্ষণাৎ সেটা জানতে চেষ্টা করা ঠিক হবে না। তাই চুপচাপ নিজেদের অবস্থা সুদৃঢ় করতে লাগলাম। আমরা সেখানে বাক্কার করে পজিশন নিয়ে বসতে শুরু করলাম। ইতিপূর্বে চতুর্থ বেঙ্গলের যে দল চিটাগাং-রাঙ্গামাটি রোড ধরে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হয়েছিল তারা কোথায়, কদ্দূর অগ্রসর হয়েছে তা জানার জন্য আমি তিনজন লোকের একটা দলকে গোপনে সে রাস্তা ধরে পাঠালাম। বেশীক্ষণ লাগলো না। ওরা খবর নিয়ে এলো। ওরাও হাটহাজারীর প্রায় ৩/৪ মাইল দূরে ঘাঁটি ফেলেছে। আমি তখন ওদের সাথে যোগাযোগ করলাম এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী পরস্পরের সাথে আদান-প্রদান করলাম। ক্রমে রাত হয়ে আসছিল। আমরা চুপচাপ রাতটা কাটানো মনস্থ করলাম। বুঝতে পারলাম ওরা আমাদের অবস্থা সম্বন্ধে কিছু জানতে পারেনি। চুপচাপ ১৪ ডিসেম্বরের রাত কেটে গেল। আমরা সকাল হওয়ার সাথে সাথেই শত্রুদের প্রতিউত্তর আসলো। বোঝা গেল ওরা বেশ মজবুত ভাবেই হাটহাজারীতে ঘাঁটি করেছে। আমরাও তাই দুপুর নাগাদ ওদের উপর আক্রমণ চালালাম। ওরা আমাদের আক্রমণের প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মসমর্পণ করতে রাজী হলো। ২৪-এফএফএর 'বি' কোম্পানীর মেজর হাদীসহ সবাই আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। আমরা তখন হাটহাজারী ছাড়িয়ে গিয়ে নয়াপাড়া ক্যাণ্টনমেণ্টের উপর প্রচণ্ড চাপ দিতে লাগলাম। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন গফফারের অধীনে পরিচালিত চতুর্থ বেঙ্গলের দলটিও আমাদের সাথে এসে মিলিত হলো। ওদিকে মিত্রবাহিনী ও লেঃ দিদারের অধীনে ১০ম বেঙ্গলের যে চার্লি কোম্পানী ছিল তারা ১৫ই ডিসেম্বর কুমীরার উপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। কুমীরার শত্রুরা এ আক্রমণের মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। তারা পালিয়ে তাদের পরবর্তী ঘাঁটি ফৌজদারহাটে গিয়ে মিলিত হলো। আমাদের চার্লি কোম্পানী ও মিত্রবাহিনী আরো এগিয়ে গেল। আমাদের মত তারাও ফৌজদারহাটের শত্রুদের উপর প্রচণ্ড চাপ দিতে থাকে। তখন সময়টা ছিল ১৫ই ডিসেম্বরের রাত। আমরা যেভাবে নয়াপাড়া ক্যাণ্টনমেণ্টের উপর চাপ দিতে লাগলাম তেমনি কুমীরা থেকেও আমাদের চার্লি কোম্পানী ও মিত্রবাহিনী ফৌজদারহাটের উপর চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো। বার বার তাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য ঘোষণা করতে লাগলাম। কিন্তু তবুও আত্মসমর্পণ করতে রাজী হলো না। কিন্তু আমরা জানতাম আত্মসমর্পণ ওদের করতেই হবে। এছাড়া ওদের কোন পথই নেই।

 ১৬ই ডিসেম্বর সকাল। নিয়াজীকে নির্দিষ্ট সময় দেয় হলো আত্মসমর্পণের। আমরাও বার বার শত্রুদের নির্দেশ দিয়ে চললাম আত্মসমর্পণের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছু পরে নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলো। বাংলাদেশের প্রত্যেক রণাঙ্গনেই মিত্র ও আমাদের মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কদের হাতে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করলো।

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান[১]

 ৩রা জুন: বজরার কুখ্যাত দালাল পাক সামরিক বাহিনীর অন্যতম সাহায্যকারী, নিরীহ গ্রামবাসীর ধনসম্পদ লুণ্ঠনকারী দানব সেরাজুল ইসলাম (ছেরু মিয়া-বজরা) এর অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে তারই প্রভাবে এতদঞ্চলে বহু নিরীহ জনগণ রাজাকারে পরিণত হয়। তাই মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফ সাহেবের নির্দেশক্রমে ৩রা জুন রাতে বজরা স্কুলের পূর্ব দিকে তার গোপন আড্ডাখানায় অতর্কিত আক্রমণ করি।


  1. ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে এ সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়।