পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
204
কটিয়াদী এ্যামবুশ, ৭ই আগস্ট, ১৬ আগস্টঃ

 পাকিস্তান সেনাবাহিনী বেলাবোতে জয়লাভের পর এক প্রকার বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তারা এমনি আত্মতৃপ্তি নিয়ে চলাফেরা করত যে, তারা মনে করেছিল যে তাদের চলাফেরায় বাধা দেবার আর কেই নেই। আমাদের সৈরিকরাও চুপ করে ছিল না। তারও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ৭ই আগস্ট থেকে আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। অবশেষে ১৬ই আগস্ট সে সুযোগ আসে। ঐদিন পাকিস্তানী সৈনিকরা কয়েকখানা মটর লঞ্চে করে কটিয়াদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের সৈনিকরাও নদীর পাড়ে তাদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে থাকে। সমস্ত মটর লঞ্চ যখন ঐ ফাঁদের ভিতরে চলে আসে তখন চারিদিক থেকে তাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করা হয়। এই গোলাগুলিতে বেশ কয়েকখানি লঞ্চ ডুবে যায় এবং বহু শত্রুসেনা হতাহত হয়। কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈনিক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং মনোহরদী রিইফোর্সমেণ্ট এসে আহতদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এই উদ্ধারকার্যের জন্য পাক সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। পরে জানা যায় যে, ১৪৩ জন নিহত এবং বহুসংখ্যক আহত হয়েছিল। এ এ্যামবুশে নেতৃত্ব দিয়েছিল হাবিলদার আকমল আলী। আমাদের সৈনিকরা এ যুদ্ধে বিশেষ সাহসের পরিচয় দেয় এবং বেলাবোতে আমাদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার প্রতিশোধ গ্রহণ করে।

মুকুন্দপুর এ্যামবুশ-১৩ই সেপ্টেম্বরঃ

 পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রেলপথে যাতায়তে বাধা সৃষ্টি করার জন্য আমরা রেলওয়ে লাইনে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাখতাম। এ ব্যাপারে পাকিস্তানীরা বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে। তারা রেলগাড়ির ইঞ্জিনের আগে দুটো কি তিনটে ওয়াগণ জুড়ে দিত। এতে ঐ ওয়াগনগুলোই প্রথম বিধ্বস্ত হত এবং ট্রেনের বিশেষ কোন ক্ষয়ক্ষতি হত না।

 তাদের এই ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অন্য কৌশল অবলম্বন করি, মাইন এমনভাবে ফাটে পাতে করে ট্রেনের বিশেষ অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই ট্যাংক বিধ্বংসী মাইনকে ফাটাবার জন্য আমরা বিদ্যুতের সাহায্য (ইলেকট্রিক ডেটোনেটিং সিস্টেম) আমাদের ইচ্ছামত মাইন ফাটাবার ব্যবস্থা নেই। পাকবাহিনী যখন 'আখাউড়া-সিলেট রেলগাড়ি চালু করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে, তখন আমরা কিছুদিন তাদের গতিবিধি এবং ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করি। এই পদ্ধতিতে ট্রেন ধ্বংস করার জন্য মুকুন্দপুর এলাকাতে এক এ্যমবুশ তৈরী করি। এ্যামবুশ লাগানো হয়েছিল দু'খানা এণ্টি ট্যাংক মাইন দিয়ে। তার সাথে বৈদ্যুতিক তার যোগ করে প্রায় ৩০০ গজ দূরে রিমোট কণ্ট্রোল স্থাপন করা হয় যেখান থেকে সুইচ টিপলে যেন মাইন ফেটে যায়। এই সুযোগ এসেছিল ১৩ই সেপ্টেম্বর। ঐ দিন পাক-বাহিনীর প্রায় এক কোম্পানী সৈন্যের ট্রেনে আখাউড়া থেকে মুকুন্দপুর হয়ে হরশপুর পর্যন্ত যাবার পরিকল্পনা ছিল। আমাদের ফাঁদ ছিল মুকুন্দপুর এবং হরশপুরের মাঝামাঝি জায়গায়, মুকুন্দপুরের নিকট ঐ ট্রেনে দু'জন পাকিস্তানী অফিসার ছিল।

 ট্রেনের সম্মুখভাবে দু'খানা বালি বোঝাই ওয়াগণ লাগানো ছিল। রাত তখন প্রায় চারটা। যখন ট্রেন মুকুন্দপুর থেকে হরশপুরের দিকে যাত্রা করে তখনই আমদের এ্যামবুশ পার্টি তৎপর হয়ে ওঠে। ট্রেন আস্তে আস্তে অগ্রসর হচ্ছিল। বালি বোঝাই ওয়াগন ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পার হবার পর যখন ইঞ্জিন এবং সৈন্য বেঝাই ওয়াগন মাইনের ইপরে আসে তখনই সুইচ টিপে মাইনকে ফাটানো হয়। এতে ইঞ্জিনখানা সৈন্য বোঝাই ওয়াগনসহ ধ্বংস হয়। এই অপারেশনে দু'জন অফিসারসহ ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয় বলে জনান যায়। তাছাড়া অনেক আহত হয়েছিল। এই এ্যামবুশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেঃ মোরশেদ। বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায় (সিস্টেম) ট্রেন ধ্বংস করার পদ্ধতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এটাই ছিল প্রথম।