পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
386

 প্রথমে ইস্টার্ন কমাণ্ডের ইনটেলিজেন্স অফিসার কর্নেল খেরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমাকে অনেক প্রশ্ন করলেনঃ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন আমি কোথায় কোথায় ছিলাম। কি কি করেছি ইত্যাদি। তিনি যা প্রশ্ন করলেন সবগুলোরই উত্তর দিতে হলো আমাকে। একটা লোক তাঁর কানে কানে কি বলতেই আমাকে পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সাক্ষাৎ পেলাম। তাঁর স্মিত হাসি ও আন্তরিক ভদ্রতা আমাদের ভেতর ‘পদের' বাধা মুছে ফেললো। আমার মনে ভরসা এলো। তাই কোন সংশয় না করে বা কোন কথা গোপন না করে তার কাছে মনের কথা সব কিছু খুলে বললাম। এর ফলে আমার উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হলো। একটা মানচিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের কোথায় আমার গেরিলা ঘাঁটি আছে তাঁকে দেখালাম। দেখে মৃদু হাসলেন এবং বললেন, খুব ভাল। সাথে কর্নেল খেরাকে নির্দেশ দিলেন আমাকে প্রয়োজনীয় সব রকম সাহায্য করতে। এখানে কর্নেল খেরার সাথে আমাকে পুরো তিনটা দিন থাকতে হয়। সামরিক বাহিনীতে অন্যান্য গোয়েন্দা অফিসারের মত তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনটা আমার সম্বন্ধে খুব উৎসুক হয়ে উঠলো। বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগের লোক হিসেবে খুব সতর্কতার সাথে কথা বললেন, নানা রকম প্রশ্ন করে নিশ্চিত হতে চাইলেন যে, আমি সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা কিনা। আমার পরিকল্পিত কাজের বিলম্ব হওয়াতে এই কয়টা দিন আমি ভয়ানক অস্থিরতার ভেতর কটিয়েছিলাম। যাহোক, আমর বিরক্তি সত্ত্বেও তাঁর ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা ও দেশের জন্য নিরাপত্তা বোধের আন্তরিক প্রশংসা না করে পারছি না। এখানেই তার কাছে প্রথম শুনলাম, ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানী দস্যুদের হাতে বরিশাল-ফরিদপুরের পতন হয়েছে। হতাশায় মনটা ভেঙ্গে পড়লো। এই জিলাগুলিকে রক্ষা করার পূর্ব পরিকল্পনা আমার সাময়িকভাবে ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও কঠিন সংকল্প নিলাম যে, যেভাবেই হোক এইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই হবে। অস্ত্র তুলে দিতে হবে মুক্তিসংগ্রামীদের হাতে। আমার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওরা। আমার বিলম্ব হবার আরও একটা কারণ হলোঃ সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম যে, কর্নেল এম এ জি ওসমানী যেভাবেই হোক আমার সাথে কোলকাতায় সাক্ষাৎ করতে চান।

 ৫ই মে পর্যন্ত আমি তাঁর অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু তাঁর ফিরে আসার কোন লক্ষণই দেখলাম না। কেউ বলতে পারলো না কখন তিনি ফিরে আসবেন। তিনি তখন সীমান্তবর্তী অন্যান্য সেক্টর কমাণ্ডারদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কঠোর চেষ্টা করছিলেন। এই বিলম্বে ভয়ানক চিন্তান্বিত হয়ে স্থির করলাম আরদ্ধ কাজ সমাধা করার জন্য আমাকে এখনই রওয়ানা হয়ে যেতে হবে। ঠিক এই সময় মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জু, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদা পরিবার-পরিজন নিয়ে হাসনাবাদে পৌছলো। বরিশালের পতন হওয়াতে তারা চলে এসেছে।

 ক্যাপ্টেন হুদাকে নির্দেশ দিলাম যে, যখন আমি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকবো, তখন যেন বাহকেরমাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরিস্থিতি অনুকূল মনে হলে সরবরাহ ব্যবস্থা যেন অব্যাহত রাখে। আমাদের ক্যাম্পের দিকেও লক্ষ্য রাখতে বললাম। এই ক্যাম্পে মিঃ মঞ্জু, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদার পরিবার-পরিজনও থাকতো।

 সবাই মিলে মোট চল্লিশজন লোক দুটো লঞ্চে করে যাত্রা করলাম। আমাদের ভেতর চারজন নিয়মিত সেনাবাহিনীর লোক ছিল। বাকী সব ছাত্র। আমাদের গন্তব্যস্থানের রাস্তাঘাট আমার নিজেরও জানা ছিল না। লঞ্চে এরকম একটা দুঃসাহসিক যাত্রায় মোটেই ভরসা পাচ্ছিলাম না। যে কোন সময় বিপর্যয় আসতে পারে। যেহেতু যাওয়ার পথে শত্রুরা চারদিকে ওঁৎ পেতে বসেছিল, আমরা সবাই লঞ্চের পাইলটের উপর নির্ভর করলাম। পাইলটরা তাদের অনেক বছরে অভিজ্ঞতার বড়াই করে আশ্বাস দিল যে, তারা আমাদের নিরাপদে পৌছে দেবে। ওদের দুঃসাহসিক কথাবার্তা ও আত্মবিশ্বাসের জোর দেখে স্বভাবতই আমি আদেশ করা থেকে বিরত রইলাম, যেহেতু যাওয়ার প্রকৃত রাস্তাঘাট সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত। রাস্তা সম্পর্কে আমার ম্যাপ দেখা অস্পষ্ট ধারণা ছিল মাত্র। তৎসত্ত্বেও একটা সংক্ষিপ্ত 'অপারেশন প্ল্যান' তৈরী' করলাম। প্রাথমিক পর্যায়ে