পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
420

 উত্তেজনাময়-ঐতিহাসিক। প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাস বিজয়ের আনন্দে মুখর। বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের ফলশ্রুতি। সবাইকে খুশী মনে হলো। কিন্তু অন্তর খুলে কেউ হাসতে পারলো না। মনের অস্থিরতায় সবাই আড়ষ্ট হয়ে এলো।

 জেনারেল দলবীর সিং-এর সাক্ষাৎ করলাম। তিনি অধীর আগ্রগে অপেক্ষা করছেন। কেননা, প্রধান স্টাফ অফিসার, আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী কমাণ্ডার নিয়ে ইতিমধ্যেই রওনা হয়েছেন। এখনও এসে পৌঁছাননি। সময় অতি মন্থর গতিতে চলতে লাগলো। এক-একটি মুহূর্ত যেন এক-একটি ঘণ্টা। মিত্রবাহিনীর ৯নং ডিভিশনের স্টাফ অফিসার কর্নেল দেশ পাণ্ডে জেনারেল দলবীর সিংকে বললেন, ব্রিগ্রেডিয়ার হায়াত খান ও তাঁর সাথের সাতজন লেঃ কর্নেল এসে পৌঁছে গেছেন।'

 উত্তেজনার চরম মুহূর্ত। জেনারেল দলবীর সিং গভীর স্বরে হুকুম দিলেন, ‘ওদের এখানে নিয়ে আসুন।' আমরা হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং-এর উপর তলায় বসা ছিলাম। নিচের দিকে চাইতেই দেখলাম সাংঘাতিক অবস্থা।সামরিক বাহিনী ফটোগ্রাফাররা আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী কমাণ্ডারদের ফটো নেয়ার জন্য, ওরা গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে ঘিরে ধরলো। এত ভীড় যে, নিয়ন্ত্রণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। উৎসাহী সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররা এতদিন ধরে পাগলের মত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।

 যাহোক, পাকিস্তানী কমাণ্ডারদের নিয়ে আসা হলো। আমি চারিদিকে তাকাচ্ছিলাম ওদের ভেতর আমার চেনা কেউ আছে কিনা। হ্যাঁ, ওদের ভেতর আমার চেনা দু'জন ছিল। একজনের নাম লেঃ কর্নেল ইমতিয়াজ ভয়ায়েচ। পাকিস্তানী মিলিটারী একাডেমীতে যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম তখন ওখানে তিনি ক্যাপ্টন ছিলেন। অপরজন লেঃ কর্নেল শামস্। তার সাথে আম জানা শোনা ছিল। ব্রিগেডিয়ার হায়াতকেও একবার কি দু'বার পশ্চিম পাকিস্তানে দেখেছি। তখন তাঁদের মনে হতো খুব ভদ্র, বিনয়ী। কিন্তু বাংলাদেশে তাঁরাই অভদ্র, অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে। বসতে তাঁদের চেয়ারে দেয়া হলো। জেনারেল দলবীর সিং অত্যন্ত সৌজন্যমূলক ব্যবহার করলেন তাদের সাথে। বিজয়ী ও বিজিতের কোন সামঞ্জস্য রাখলেন না। তিনি ওদের চা-পানে আপ্যায়িত করলেন। জেনারেল দলবীর সিং-এর মার্জিত রুচিবোধ ও ব্যবহার দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ব্রিগেডিয়ার হায়াতের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, 'এই যে ইনি হচ্ছেন মুক্তি- কমাণ্ডার। আগে আপনাদেরই একজন ছিলেন।'

 আত্মসমর্পণের খুঁটিনাটি বিষয় সমাপ্ত হলো। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তার ব্রিগেড মেজরকে ডেকে বললেন, মেজর ফিরোজ, তুমি এখনই চলে যাও এবং সৈন্যদের হুকুম শুনিয়ে দাও, যে যেখানে আছে সেখানেই অস্ত্র সম্বরণ করতে। ওদের বলে দিও আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।'

 শেষের কথাগুলো যখন তিনি উচ্চারণ করলেন, তখন তাঁর সারা মুখমণ্ডলে বেদনা ও গ্লানির উৎকট রেখাগুলো প্রকট হয়ে উঠলো। বেলা এগারটার সময় মেজর ফিরোজ তার সাথের অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে জীপে করে খুলনার দিকে রওনা হলেন। ঠিক তাঁর পিছনেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান। তাঁর পিছনে ৯নং ডিভিশনের একটা জীপে আমি ও লেঃ কর্নেল দত্ত পাশাপাশি বসা। মিঃ দত্তকে বেসামরিক গণসংযোগ অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমাদের জীপের পিছনে ক্যাপ্টন হুদা, মোস্তাফা ও ডাঃ শাজাহান।

 আত্মসমর্পণকারী পাক-সৈন্যরা রাস্তার দু'ধারে অবস্থান গেড়ে বসেছিল। এই রক্তপিপাসু নরখাদকরা আজ বন্দী। অবনত মস্তকে মন্থর গতিতে হেঁটে চলেছে।দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী ইতালীয় সৈন্যের মত হানাদাররা দীর্ঘ লাইন দিয়ে চলতে লাগলো। ধীরে ধীরে আমরা খুলনা নিউজপ্রিণ্ট মিলের ভেতর ঢুকলাম। এখানে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের হেডকোয়ার্টার। চারিদিক শান্ত, নীবর। মিত্রবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারের তত্তাবধানে আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদল মার্চ করে এগিয়ে এলো। চেয়ারে বসে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ভদ্রমহোদয়গণ, পূর্ব পাকিস্তানে বসে শেষবারের মত এক কাপ চা দিয়ে আপ্যায়ন করা ছাড়া দেবার মত আমার কিছুই নেই।'