পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
424

 ইতিমধ্যেই আমি খবর পাই লেঃ জিয়া সুন্দরবনে আছেন এবং মেজর জলিল তার কাছে আমার জন্য অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছেন। অস্ত্রশস্ত্র যোগাড়ের জন্য রুহুল আমিনকে নিয়ে আমি লেঃ জিয়ার কাছে সুন্দরবনে যাই। সুন্দরবনের বগীতে ফুল মিয়া একটা ঘাঁটি গেড়েছেন। সেখানে রুহুল আমিন নিয়ে আমি ফুল মিয়ার সাথে দেখা করি। জানতে পারি লেঃ জিয়া সুন্দরবনের অন্য ক্যাম্প মধুর ওখানে গেছেন। দুইদিন পর লেঃ জিয়া বগীতে ফিরে এলে তাঁকে আমার প্রয়োজনীয় কথা জানাই। লেঃ জিয়া আমাকে ৭টা এস-এল-আর, ২০টা ৩০৩ রাইফেল, ২টা এনারগা গ্রেনেড ও গোলাবারুদ দেন। এসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বুকাবুনিতে ফিরে আসি। ৬টি এলাকার দায়িত্ব যাদের দিয়েছিলাম, তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় রেকি করে বুকাবুনিয়ায় এসেছিল। তাদের প্রত্যেককে আমি ১টা করে এস-এল-আর ও ৬টা করে রাইফেল, গ্রেনেড ও গোলাবারুদ ভাগ করে দিই। তাদের আমি পাকবাহিনীর সাথে সরাসরি আক্রমণ যেতে নিষেধ করি। কেননা, সে সময়ে আমাদের শক্তি খুবই কম ছিল। পাকবাহিনীর পিছন দিক থেকে আক্রমণ করে ব্যস্ত রাখতে বলি। আমি তাদের আরও নির্দেশ দিই রাজাকার-আলবদরদের উপর হামলা করার জন্য। রাজাকার-আলবদররা আমাদের কার্যকলাপে বেশ বাধার সৃষ্টি করছিল এবং জনগনের উপর অত্যাচার করত। জনগনের সমর্থন পাবার জন্য আমাদের এসব কার্যকলাপের প্রয়োজন ছিল। আমি তাদের থানা আক্রমণ করার নির্দেশ দিই শত্রুদের ভীতসন্ত্রস্ত করার জন্য।

 জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমি প্রথম গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন চালাই। বুকাবুনিয়ার ভৌগোলিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পটুয়াখালী ও বরিশাল সীমান্তের মধ্যে পটুয়াখালীর বামনা ও বরিশালের মঠবাড়িয়া ও কাঁঠালিয়া থানার সীমান্তের মধ্যে অবস্থিত। বিশখালী নদী হয়ে কাঠালিয়া ও বামনা হয়ে বুকাবুনিয়া আসা যায়। বুকাবুনিয়া থেকে ১ মাইল দূরে রাজারহাট অবস্থিত। রাজারহাটে দালালদের প্রতিপত্তি ছিল খুব। আমি বুঝতে পারলাম। এদের উপর হামলা না করলে আমরা নিশ্চিন্তে কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পারব না। এইসব দালাল অনেক নিরীহ হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করেছিল। তাই একদিন আমরা অকস্মাৎ রাতে তাদের ঘাঁটিতে হামলা চালাই। আমাদের আক্রমণে তাদের ২ জন মারা যায় এবং ১৫ জনকে বন্দী করা হয়। এর ২/৩ দিন পর মঠবাড়িয়া থানা থেকে পুলিশ আসে। তারা কিছুদিন থেকে রাজারহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ আক্রমণের পর রাজারহাট আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। দালালদের কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের বুকাবুনিয়া ক্যাম্পও নিরাপদ হয়।

 মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রতিরোধের ফলে বুকাবুনিয়াতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায় এবং জনগণের মনোবলও বেড়ে যায়। আগে যে একটা গুজব ছিল যে বুকাবুনিয়াতে প্রায় ৪০০/৫০০ সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা আছে সেটা এখন সত্য বলে প্রমানিত হয়। আশপাশের থানার পুলিশরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। বুকাবুনিয়ার মুক্তিবাহিনী সদর দফতরের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।

 বামনা থানা থেকে পুলিশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকজন ও রাজাকাররা এক সাথে বামনা বাজারে যেত। তারা নিরীহ জনগনের উপর অত্যাচার চালাত। দোকানে মিষ্টি ও চা খেয়ে পয়সা দিত না। এ খবর পাবার পর আমি তাদের শাস্তি দিবার জন্য বামনা থানা ও বাজারের মধ্যে আগষ্টের প্রথম দিকের কোন একদিনে এ্যামবুশ পড়ে যায়। আমাদের আক্রমণে ওদের ৭/৮ জন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। ৫টা রাইফেল আমাদের হস্তগত হয়। এতে বামনা বাজারের লোকদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়।

 কাঁঠালিয়া থেকে ৩ মাইল দূর আমুয়াবাজার একটা গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। হাটের দিন পাকসেনারা কয়েকজন রাজাকারকে নিয়ে বাজরের লোকদের মাইকে বলে যে মুক্তিযোদ্ধাদের যেন সহযোগিতা করা না হয়। তাদেরকে আক্রমণ করার জন্য কাঁঠালিয়া-আমুয়াবাজারের মধ্যে এক সেতুর নিকটে এ্যামবুশ পাতা হয়। এ ঘটনাটি ঘটে জুলাই মাসের শেষে। সেদিন ৫ জন পাকসেনা ১০জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে সেতুর উপর উঠলে আমাদের এ্যামবুশ পড়ে যায়। এর ফলে ২ জন পাকসেনাসহ ৪জন নিহত হয়। আমরা ৪টা রাইফেল দখল করি। এই