পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
437

জন্য এডজুট্যাণ্ট খোকনের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়। কবিরাজ বিল্ডিং রাজাকার ঘাঁটি দখল করার জন্য নায়েক সুবেদার মধুর উপর ভার দেয়া হয়। সুকুমার বাবুর দালানে রাজাকার ঘাঁটি দখলের জন্য সুবেদার আজিজকে ভার দেওয়া হয় এবং অম্বিকা চরণ হাইস্কুলে রাজাকার ঘাঁটি দখল করার জন্য মোতাহারকে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন জিয়া এবং আমি ২০ জন নিয়ে রিজার্ভে থাকি। ভোর ৪ টা একই সাথে আক্রমণ চালানো হয়। সকাল ৯ টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে, কিন্তু কোন ঘাঁটি দখল করা সম্ভব হয় না। ইতিমধ্যে রায়েন্দা থানা থেকে এক লঞ্চ রাজাকার আসে মোড়লগঞ্জে। ক্যাপ্টেন জিয়া প্রতিরোধ করেন, রাজাকাররা পিছু হটে। ৯ টার পর ক্যাপ্টেন জিয়া নিজেই আমাকে সহ অম্বিকা হাইস্কুলে আক্রমণ চালান। ওখানে গ্রেনেড ছুড়তে গেলে মুকুল (স্পেশাল গেরিলা কমাণ্ডো) এবং মোহরাবের হাত-পা ভেঙ্গে যায় রাজাকারদের গুলিতে। ক্যাপ্টেন জিয়া নিজে কাধেঁ করে তাদেরকে মোড়লঞ্জ কলেজে রেখে যান। আমি নিজে পশ্চিম দিকে এবং ক্যাপ্টেন জিয়া উত্তর দিক থেকে এল-এম-জি ব্রাশ চালিয়ে জানালা ভেঙ্গে ফেলি। আসাদ এবং হেলালকে বিল্ডিংয়ে উঠিয়ে দেওয়া হয়। ভেনটিলেটরের ভিতর দিয়ে ২ জন গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। গ্রেনেড ব্রাস্ট হলে বহু রাজাকার মরতে থাকে, তবু তারা আত্মসমর্পণ করেনি। পরবর্তীকালে ক্রমাগত ১০ টি গ্রেনেড ফেলা হয়। রাজাকাররা চিৎকার শুরু করে। ক্যাপ্টেন জিয়া উত্তর দিকের জনালা দিয়ে লাফিয়ে ঘরের ভিতর পড়ে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। ৫ জনের সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে। ২২ জনকে হ্যাণ্ডস আপ করিয়ে বাইরে নিয়ে আসেন। বাইরে আরও ২ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। স্কুলে তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা হচ্ছিলো। ৮০০ ছেলেকে বাইরে বের করে দেওয়া হয়। যাবতীয় কাগজপত্র পানিতে ফেলে দেয়া হয়। আমি এবং ক্যাপ্টেন জিয়া ছেলেদের সামনে ভাষণ দেই এবং বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য উপদেশ দেই। ছেলেরা সবাই ‘জয় বাংলা' শ্লোগান দিয়ে বাড়িতে চলে যায়। ওখানে জিয়া ৪ জন শিক্ষককে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। পথে আমি এবং ক্যাপ্টেন জিয়া এক স্থানে বিশ্রাম নেবার অবসরে ব্যক্তিগত শত্রুতা তাকায় নায়েক সুবেদার মধুর নির্দেশে ৪ জন শিক্ষক সহ ২২জন রাজাকারকে মধুর সহকারী অধিনায়ক আমজাদ মল্লিক গলা কেটে হত্যা করে। ক্যাপ্টেন জিয়া মধুকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেন। এই নিয়ে মধুর সাথে আমাদের বেশ কথাকাটাকাটি হয়। ফেরার পথে কুটিবাড়ি থেকে ২জন রাজাকার উলঙ্গ অবস্থায় পালাচ্ছিল, কিন্তু মাঠে কৃষকরা ধরে গরুর জোয়াল দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়। বেলা ১২ টার দিকে আমরা সবাই সুন্দরবনে যাত্রা করি। যাবার পথে প্রতিটি গ্রামের মানুষ আমাদের শুভেচ্ছা জানায় এবং চাল, ডাল, মুরগী, খাসি, দিয়ে আমাদের নৌকা ভর্তি করে দেয়। পথের মাঝে শুনলাম পাকসেনারা এসে গোলাগুলি চালাচ্ছে মোড়লগঞ্জে। একটি ক্যাম্প আমরা দখল করি এবং ৪৪ টি রাইফেল উদ্ধার করি।

 ১৭ ই আগষ্ট আমরা শুনলাম আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ আব্দুল মজিদ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মারুফ হোসেন, ভাসানী ন্যাপের থানা সহ-সভাপতি সাহের আলীকে পাকসেনারা ধরে এনে হত্যা করেছে। এছাড়া গ্রামের নিরীহ আরও বহুজনকে হত্যা করেছে ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঐ ক্যাম্পে জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কনফারেন্স ডাকেন এবং বরিশাল জেলার কয়েকটি থানা আক্রমণ করার জন্য কয়েকটি দল গঠন করেন। সুবেদার আজিজ এবং লতিফের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল ভাণ্ডারিয়া থানার জন্য, কমাণ্ডার হাবিবের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল কাউখালী থানার জন্য, সুবেদার রুস্তমের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল রাজাপুর থানার জন্য পাঠান হয়। এছাড়া ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি দল মঠবাড়িয়া থানা দখলের জন্য শরণখোলা রেঞ্জ অফিসে রওনা হয়। ভোরবেলায় পৌঁছাতেই গানবোটের শব্দ পাওয়া যায়। শরণখোলা রেঞ্জ অফিসে সুবেদার ফুলুর নেতৃত্বে ১০০জনের মত মুক্তিযোদ্ধা ছিল।

 ১৮ ই আগস্ট ভোরে ভোলা নদীর দু'পাড়ে মাত্র ১০ জন করে ২০ জন রেখে জিয়া সবাইকে সুন্দরবনের ভিতরে যাবার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ৭টি গানবোট ফরেস্ট অফিসের উত্তর দিকে এসে পড়ে। মোড়লগঞ্জে পাকসেনা এবং রাজাকাররা চরমভাবে মার খেলে তার প্রতিশোধ নেবার জন্য গানবোটগুলি পাঠানো হয়েছিল। ৪ খানা গানবোট শরণখোলা রেঞ্জ অফিস অতিক্রম করে উত্তর দিকে যাবার পরে পরবর্তীতে ৩ খানা গানবোটের উপর ভোলা নদীর দুই পার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করে। সুবেদার গফফার রকেট লাঞ্চার