পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
24

যুদ্ধ পরিকল্পনা

 নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই আমরা বেলুনিয়া থেকে শত্রুসেনাদের পুরোপুরি বিতাড়িত করি। পাকিস্তান রেডিও অবশ্য তখনো বেলুনিয়া তাদরে দখলে আছে বলে সমানে প্রচার করে চলেছিলো। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ একদিকে মিথ্যা প্রচার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিলো অপরদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ কেন্দ্র ফেনী থেকে ক্রমান্বয়ে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিচ্ছিলো।

 ২১শে নভেম্বর ঢাকা থেকে এপি প্রতিনিধি একটি বার্তায় বলেন, পাকবাহিনী এবং মুক্তিফৌজের মধ্যে মরণপণ লড়াই শুরু হয়েছে। এই লড়াইয়ে পাকিস্তনীদের যে শক্তি ক্ষয় হচ্ছে তাতে ভারতের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তারা যে কি করবে বোঝা যাচ্ছে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরে গেরিলাদের হামলায় পর্যুদস্ত পাকিস্তানিরা দিশেহারা। এ সময়ে মুক্তিফৌজ অন্তত সাতটি থানার ওপর আক্রমণ চালিয়ে থানাগুলোকে মুক্ত করেছে। দেশের অধিকাংশ স্থানে মুক্তিবাহিনী বিদ্যুৎ সরবরাহ চরমভাবে ব্যাহত করেছে। বন্দরে কাজকর্ম বন্ধ। শিল্প কারকানার শ্রমিকরা যে যার বাড়ির পথ ধরেছে। বিস্তীর্ণ পল্লী অঞ্চলে মুক্তিফৌজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সেখানে তারা নিজেদের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। রাজাকার এবং দালালদের বিচার শুরু হয়ে গেছে। মুক্তিফৌজের দ্রুত শক্তি বৃদ্ধি এবং অভিযানের তীব্রতায় ইয়াহিয়া কান এবং নিয়াজী বেসামাল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাকিস্তানিরা বিতাড়িত হচ্ছিলো, প্রতি মুহূর্তে লোকক্ষয়ের সংখ্যা বাড়ছিলো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, পূর্ব পাকিস্তান শিগগিরই হাতছাড়া হয়ে যাবে এই আশংকায় তারা ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আর এই আশংকা সত্য হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উৎকৃষ্ট কয়েকটি ডিভিশন তাদের হারাতে হবে দীর্ঘদিনের জন্য।

 ইতিমধ্যে পাকিস্তান কয়েকবারই পশ্চিম ফ্রণ্টে ভারতের আকাশসীমা লংঘন করে। পূর্ব ফ্রণ্টে নিয়াজী দুঃসাহসী একটা কিছু করে তার সৈন্যদরে মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা ২১শে নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটের নিকটবর্তী ভারতীয় বয়রা গ্রামে হামলা চালায়। ট্যাংক, কামান ও জঙ্গী বিমান তাদের সহযোগিতা করেছিল। এতে কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য নিহত। তবে বেশী মারা যায় বেসামরিক ব্যক্তিরাই বিপুল সংখ্যক লোক আহতও হয়। বরতের মাটিতেই যুদ্ধ হবে নিয়জী বোধ হয় তার এই দম্ভের যথার্থতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। ভারতীয় এলাকায় অনুপ্রবেশের অনুমতিও তিনি নিশ্চয়ই ইয়াহিয়ার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এর খেসারতও তাকে হাতে হাতে পেতে হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণে তারা শুধু পেছনেই হটে আসে না, ১৩টি শেফি ট্যাংক এবং ৩টি স্যাবর জেটকে এই সীমিত যুদ্ধে হারিয়ে ফিরে আসতে হয় নিজ এলাকায়। দুজন পাকিস্তানী পাইলট বন্দী হয় ভারতের হাতে।

 এসব উস্কানিতেও মিসেস গান্ধী ছিলেন স্থির। পাকিস্তানী কামানের গোলায় ভারতের বেসামরিক লোক হতাহত হচ্ছিল। বিষয় সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির ছিল প্রচুর। তা সত্ত্বেও ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল তীব্র ক্ষোভ প্রাশ করতে থাকে। মিসেস গান্ধি অবশ্য আশা করছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত কয়েকটি বৃহৎ শক্তির সুমতি হবে। তারা ইচ্ছা করলে ইয়াহিয়াকে দিয়ে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করিয়ে সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান করাতে পারবেন।

 ২১ নভেম্বর পাকিস্তান সমূহ বিপদ টের পেয়ে জাতিসংঘে এক নালিশ দায়ের করে বসে। তার বক্তব্য, ভারতীয় সেনাবাহিনী ১২টি ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানের চারটি সেক্টরে আক্রমণ শুরু করেছে। একই দিন ইয়াহিয়া সারা পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা জারি করেন। এর চারদিন পর অর্থাৎ ২৫শে নভেম্বর পাকিস্তান সফররত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক চীনা প্রতিনিধিদলের ভোজসভায় ইয়াহিয় বক্তৃতাচ্ছলে জানিয়ে দেন যে, হয়তো দিনদশেকের মধ্যে আমাকে আর এখানে নাও পাওয়া যেতে পারে কারণ আমাকে সম্ভবত যুদ্ধে যেতে হবে।

 ২৭শে নভেম্বর পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনী পশ্চিম দিনাজপুরের ভারতীয় শহর বালুরঘাটের উপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। কামানের গোলার ছত্রছায়ায় এক ব্রিগেড পাকসেনা হিলিতে ভারতীয় অবস্থানের ওপর আক্রমণ