পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
474

তার মাইন বিস্ফোরণে এই এলাকার পাক-বাহিনী খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এক সময় এক মাইন বিস্ফোরণে ৪৫জন খান সেনা আহত হয়।

 লেঃ কর্নেল তাহের এই হেলাল কোম্পানীর বিশেষ কৃতিত্ব দেখে নভেম্বর মাসে বক্সীগঞ্জ আক্রমণ করার জন্য পাঠান। এর মধ্যে কর্নঝোরাতে তিনি পাক বাহিনীর সঙ্গে এক তুমুল সংঘর্ষে ৪জন খানসেনাকে খতম করেন। বাকী খানসেনা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। ঐ সময় হলাল লেঃ কর্নেল তাহেরের নির্দেশে এই কোম্পানী ফিরে আসে এবং পরে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা সহকারে মেলান্দাহানার পাটের গুদাম ধ্বংস করার আদেশ পায়। হেলাল কোম্পানী এই নির্দেশ মেলান্দাহর দিকে যাত্রা করে। এর মধ্যে কোন এক নদীতে পাকবাহিনী দালালদের ১২০০ মণী নৌকা ধ্বংস করে এবং পাক বাহিনীর সঙ্গে এখানে এক সংঘর্ষ বাধে। তারা তিনদিক থেকে এই হেলাল কোম্পানীকে আক্রমণ করে। তরুন মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার অতি বিচক্ষণাতার সাথে আক্রমণ প্রতিহত করে ১৩জন শত্রুসেনাকে খতম করেন। পরে তার বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে মেলান্দহ যাত্রার পথি দুরমুরির পুল ধ্বংস করেন। পুল ধ্বংসের সময় পুলরক্ষী বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে এক সংঘর্ষে তিনি ১৭ জন রাজাকারকে খতম করে ৬টি রাইফেল উদ্ধার করে তাহেরের কাছে জমা দেন।

 তারপর ১৪ই নভেম্বর। এই ঘটনাটির কথা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পের কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাসহ এই এলাকার বাসিন্দা ইণ্ডিয়ার জনসাধারণ চিরদিন মনে রাখবে।

 ১৩ই নভেম্বর দিবাগত রাত্রি ৩-২০ মিনিট লেঃ কর্নেল তাহের মুক্তিফৌজ কোম্পানী কমাণ্ডার হেলাল, সাঈদ (লেঃ কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই), পান্না, লেঃ মান্নান, গোয়েন্দা অফিসার মোঃ মনিরুজ্জামান, আবেদীন, ভুইয়া- এদের সবাইকে ডাকলেন এবং বল্লেন, আজকে কামালপুরে শক্তিশালী আক্রমণ করা হবে। তিনি কিভাবে কোথা থেকে আক্রমণ করা হবে তা সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি কোম্পানী কমাণ্ডারদের মোট ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কামালপুরের আশেপাশের কোন এক গ্রামে এ্যামবুশ নিয়ে থাকতে বল্লেন কোনরকম সাড়াশব্দ ব্যতিরেকে। তিনি আরও বলে দিলেন, তার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেন কোন রকম গুলি বর্ষণ করা না হয় আর যদি পাক-বাহিনী পালাতে চেষ্টা করে, তবে যেন তাদেরকে ধরা হয়।

 যথাসময়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধ পরিচালনা করছেন লেঃ কর্নেল তাহের স্বয়ং। তিনি অয়ারলেসের মাধ্যমে মুক্তিফৌজের রণাঙ্গনের খবর রাখছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন। সকাল ৯-৩০ মিঃ হঠাৎ তুমুল সংঘর্ষ থেমে গেল। পাকবাহিনীর ওদিক থেকে কোন রকম গুরি আসছে না। সবাই মনে করলো ওরা সবাই খতম। মুক্তিফৌজের মনে দারুণ উৎফুলভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিলো সে সময়। এই মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনে কর্নেল তাহের একটি অয়ারলেস সেট নিয়ে দৌড়ে গেলেন, কি ব্যাপার। তখন তার সঙ্গে ছিল তার দুই ভাই বেলাল ও বাহার- তারা উভয়েই আসন্ন জয়ের জন্য খুবই আনন্দিত। লেঃ কর্নেল মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডারদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, ঠিক এই সময় লেঃ মিজান এস খবর দিল কামালপুর ক্যাম্প এখনই চার্জ করতে হবে। কর্নেল তাহের ভাবছেন কোন দিক থেকে কামালপুর চার্জ করা হবে। ঠিক এমন সময় একটি গোলা এসে তাঁর পায়ে লাগলো। আর্ত চিৎকারের সঙ্গে সব মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসে। এসে দেখতে পায় এক অসহণীয় করুণ দৃশ্য-তাহের রণনেতা কর্নেল তাহের চিরদিনের মত তার একটি পা হারিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিফৌজদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল যারা নাকি কিছুক্ষণ দুর্ধর্ষ পাক সৈন্যকে হত্যা করেছে- তারা সবাই শিশুর মত কাঁদছে। কিন্তু লেঃ কর্নেল তাহের, সেই অসীম সাহসী রণনেতা, এত বড়ো কঠিন আঘাত পেয়েও একটুও বিচলিত হননি। তখন তার মাত্র চারটি কথা ছিল, (১) যুদ্ধ চালিয়ে যাও- (২) ঐ জায়গা দখল কর (যে জায়গায় তিনি আহত হয়েছেন), (৩) কামালপুর দখল করতে হবে, (৪) আমি আসছি এবং এসে যেন দেখতে পাই কামালপুর থেকে ঢাকার রাস্তা পরিষ্কার। তারপর আহত লেঃ কর্নেলকে কাঁধে করে নিয়ে আসে অশ্রুসিক্ত চোখে মুক্তিযোদ্ধা মিঠু (এই মুক্তিযোদ্ধা খুবই কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কামালপুর রণাঙ্গনে), সুজা, লেঃ মিজান ভূইয়া ও আবেদীন। তারা গারোডোবা পর্যন্ত নিয়ে আসে তাঁকে। ওখান থেকে হেলিকপ্টারে লেঃ