পাতা:বিভূতি রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অপরাজিত ২১ না ? সেই যে সে-বার বলে গেলে জন্মাষ্টমীর সময় ? এক-আধ কথার জবাব পাইয়া ভাবিল সারাদিনের কণ্টে স্বামীর হয়ত ঘুম আসিতেছে । তখন সেও ঘমোইয়া পড়িল । দশমীর পরদিনই মারারি আসিয়া হাজির। জমাইকেও যাইতে হইবে, অপণার মা বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছেন, ইত্যাদি নানা পীড়াপীড়ি শরে করিল। অপ বলিল— পাগল । ছয়টি কোথায় যে যাব আমি ? বোনকে নিতে এসেছ, বোনকেই নিয়ে যাও ভাই— আমরা গরীব চাকরে লোক, তোমাদের মত জমিদার নই—আমাদের কি গেলে চলে ? অপণা বুঝিয়াছিল স্বামী চটিয়াছে, এ অবস্থায় তাহার যাইবার ইচ্ছা ছিল না আদেী, কিন্ত বড় ভাই লইতে আসিয়াছে সে কি করিয়াই বা ‘না’ বলে ? দো-টানার মধ্যে সে বড় মুশকিলে পড়িল । স্বামীকে বলিল—দ্যাখো, আমি যেতাম না। কিন্ত মরারি-দা এসেছেন, আমি কি কিছু বলতে পারি ?--রাগ করো না লক্ষীটি, তুমি এখন না যাও, কালীপ জোর ছয়টিতে অবিশ্যি করে যেও–ভুলো না যেন । অপণা চলিয়া যাইবার পর মনসাপোতা আর এক দিনও ভাল লাগিল না । কিন্ত বাধ্য হইয়া সে রাত্রিটা সেখানে কাটাইতে হইল, কারণ অপণারা গেল বৈকালের ট্রেনে। কোনদিন লচি হয় না কিন্ত দাদার কাছে স্বামীকে ছোট হইতে না হয়, এই ভাবিয়া অপণা দুইদিনই রাত্রে লুচির ব্যবস্থা করিয়াছিল—আজও স্বামীর খাবার আলাদা করিয়া ঘরের কোণে ঢাকিয়া রাখিয়া গিয়াছে । লুচি ক’খানা খাইয়াই অপর উদাস মনে জানালার কাছে আসিয়া বসিল । খুব জ্যোৎস্না উঠিয়াছে, বাড়ির উঠানের গাছে গাছে এখনও কি পাখি ডাকিতেছে, শান্য ঘর, শান্য শয্যাপ্রান্ত—অপর চোখে প্রায় জল আসিল । অপর্ণা সব বুঝিয়া তাহাকে এই কন্টের মধ্যে ফেলিয়া গেল। বড়লোকের মেয়ে কিনা ?--আচ্ছা বেশ ।- "অভিমানের মুখে সে একথা ভুলিয়া গেল যে, অপণা আজ ছ'মাস শুন্য বাড়িতে শুন্য শয্যায় তাহারই মুখ চাহিয়া কাটাইয়াছে ! পরদিন প্রত্যুষে অপু কলিকাতা রওনা হইল। সেখানে দিনচারেক পরেই অপণার এক পত্র আসিল,—অপর সে পরের কোনও জবাব দিল না । দিন পাঁচ-ছয় পরে অপণার আর একখানা চিঠি । উত্তর না পাইয়া ব্যস্ত আছে, শরীর ভাল আছে তো ? অসুখ-বিসখের সময়, কেমন আছে পত্রপাঠ যেন জানায়, নতুবা বড় দভাবনার মধ্যে থাকিতে হইতেছে । তাহারও কোন জবাব গেল না । মাসখানেক কাটিল । কাত্তিক মাসের শেষের দিকে একদিন একথানা দীঘ পত্র আসিল । অপণা লিখিয়াছে— ওগো, আমার বকে এমন পাষাণ চাপিয়ে আর কতদিন রাখবে, আমি এত কি অপরাধ করেছি তোমার কাছে ? “আজ একমাসের ওপর হ’ল তোমার একছত্র লেখা পাই নি, কি ক'রে দিন কাটাচ্ছি, তা কাকে জনাব ? দ্যাথো, যদি কোন দোষই করে থাকি, তুমি যদি আমার উপর রাগ করবে তবে ত্রিভুবনে আর কার কাছে দাঁড়াই বল তো ? অপর ভাবিল,—বেশ জব্দ, কেন যাও বাপের বাড়ি ?—আমাকে চাইবার দরকার কি, কে আমি ? সঙ্গে সঙ্গে একটা অপব্ব পালকের ভাব মনের কোণে দেখা দিল—পথে, ট্রামে, অফিসে, বাসায়, সব-সময়, সকল অবস্থ তেই মনে না হইয়া পারিল না ষে, পৃথিবীতে একজন কেহ আছে, যে সব্বদা তাহার জন্য ভাবিতেছে, তাহারই চিঠি না পাইলে সে-জনের দিন কাটিতে চাহে না, জীবন বিবাদ লাগে। . সে যে হঠাৎ এক সন্দরী তরণীর নিকট এতটা প্রয়োজনীয় হইয়া উঠিয়াছে—এ অভিজ্ঞতা সম্পণে অভিনব ও অদ্ভুত তাহার কাছে । অতএব তাহাকে আরও ভাবাও, আরও কীট দাও, তাহার রজনী আরও বিনিদ্র করিয়া তোল ।