পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আরণ্যক 8X বান্ধব পৰ্য্যন্ত ভুলাইবার যোগাড় করিয়া তুলিয়াছে। যাক্ মা ঘোড়া আন্তে বা জোরে, শৈলসাচুতে যতক্ষণ প্রথমে বসন্তে প্রস্ফুটিত রাঙা পলাশ ফুলের মেলা বসিয়াছে, পাহাড়ের নীচে, উপরে মাঠের সর্বত্র ঝুপ সি গাছের ডাল ঝাড় ঝাড় ধাতুপফুলের ভারে অবনত, গোলগোলি ফুলের নিম্পত্র দ্বন্ধগুদ্র কাণ্ডে হলুদ রঙের বড় বড় স্বৰ্য্যমুখী ফুলের মত ফুল মধ্যাহের রৌদ্রকে মুহ সুগন্ধে অলস করিয়া তুলিয়াছে—তখন কতটা পথ চলিল, কে রাখে তাহার হিসাব ? কিন্তু হিসাব খানিকটা যে রাধিতেই হইবে, নতুবা দিগন্ত্রান্ত ও পথভ্রান্ত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা, আমাদের জঙ্গলের সীমানা অতিক্রম করিবার পূৰ্ব্বেই এ সত্যটি ভাল করিয়া বুঝিলাম । কিছুদূর তখন অন্তমনস্ক ভাবে গিয়াছি, হঠাৎ দেখি সম্মুখে বহুদূরে একটা খুব বড় অরণ্যানীর ধূম্ৰনীল শীর্ষদেশ রেখাকারে দিগ বলয়ের সে-অংশে এ-প্রান্ত হইতে ও-প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। কোথা হইতে আসিল এত বড় বন এখানে ? কাছারিতে কেহ তো একথা বলে নাই যে, মৈষণ্ডির মেলার কাছাকাছি কোথাও আমন বিশাল অরণ্য বর্তমান ? পরক্ষণেই ঠাহর করিয়া বুঝিলাম, পথ হাবাইয়াছি, সম্মুখের বনরেখা মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্ট না হইয়া যায় না— যাহা আমাদের কাছারি হইতে খাড়া উত্তর-পূৰ্ব্ব কোণে অবস্থিত। এসব দিকে চলতি বাধাপথ বলিয়া কোন জিনিস নাই, লোকজনও কেহ বড়-একটা ইটে না । তাহার উপর চারিদিকে দেখিতে ঠিক একই রকম, সেই এক ধরণের ডাঙা, এক ধরণের গোলগোলি ও ধাতুপফুলের বন, সঙ্গে সঙ্গে আছে চড়া রৌদ্রের কম্পমান তাপ-তরঙ্গ। দিক ভুল হইতে বেশীক্ষণ লাগে না আনাড়ি লোকের পক্ষে । ঘোড়ার মুখ আমার ফিরাইলাম। হুশিয়ার হইয়া গন্তব্যস্থানের অবস্থান নির্ণয় করিয়া একটা দিকৃচিহ্ন দূর হইতে আন্দাজ করিয়া বাছিয়া লইলাম। অকুল সমুদ্রে জাহাজ ঠিক পথে চালনা, অনন্ত আকাশে এরোপ্লেনেল পাইলটের কাজ করা আর এই সব অজানা সুবিশাল পথহীন বনপ্রাস্তরে অশ্বচালনা করিয়া তাহাকে গন্তব্যস্থানে লইয়া যাওয়া প্রায় একই শ্রেণীর ব্যাপার । অভিজ্ঞতা যাহাদের আছে, তাহদের এ কথার সততা বুঝিতে বিলম্ব হইবে না। আবার রৌদ্রদগ্ধ নিম্পত্র গুল্মরাজি, আবার বনকুসুমের মৃদুমধুর গন্ধ, আবার অনাবৃত্ত শিলাস্তুপসদৃশ প্রতীয়মান গণ্ডশৈলমালা, আবার রক্তপলাশের শোভা। বেলা বেশ চড়িল ; জল থাইতে পাইলে ভাল হইত, ইহার মধ্যেই মনে হইল ; কারো নদী ছাড়া এ পথে কোথাও জল নাই, জানি ; এখনও আমাদের জঙ্গলেরই সীমা কতক্ষণে ছাড়াইব ঠিক নাই, কারো নদী তো বহুদূর—এ চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে তৃষ্ণ যেন হঠাৎ বাড়িয়া উঠিল। মুকুদি চক্লাদারকে বলিয়া দিয়াছিলাম আমাদের মহালের সীমানায় সীমানাজ্ঞাপক বাবলা কাঠের খুঁটি বা মহাবীরের ধ্বজার অনুরূপ যাহা হয় কিছু পুতিয়া রাখে। এ সীমানায়. কখনও আসি নাই, দেখিয়া বুঝলাম চাকৃলাদার সে আদেশ পালন করে নাই। ভাবিয়াছে, এই জঙ্গল ঠেলির কলিকাতার ম্যানেজারবাবু আর সীমানা পরিদর্শনে আসিয়াছেন, তুমিও যেমন ! কে খাটিরা মরে ? যেমন আছে তেমনিই থাকুক। পথের কিছুদূরে আমাদের সীমানা ছাড়াইয়া এক জায়গায় ধোয় উঠতেছে দেখিয়া