সেখানে কত না উক্তি আছে, কত না জাতি আছে। আদি আর্য্য ভাষায় পৃথিবীকে মানবের ও অন্য সমস্ত প্রাণীর “মাতা” ৰ’লে উল্লেখ করা হ’ত—"পৃথিবী মাতা, দেী বা আকাশ পিতা", এটি মূল আর্য-জাতির একটি অতি সাধারণ ধারণা— সংস্কৃতে, গ্রীকে আর অন্য আর্য্য ভাষায় পাওয়া যায়। ভারতের অতি প্রাচীন আদিবাসী নিষাদ (কোল) সাওঁতাল-জাতির কাছেও তেমনি “সের্মা-অতে” অর্থাৎ “আকাশ আর পৃথিবী” হচ্ছে মানুষের “আপা-এঙ্গা” অর্থাৎ, “পিতা ও মাতা।” অথর্ববেদের “ভূমি-সুক্ত” পৃথিবী-সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতীয় আর্য্য জাতির শ্রদ্ধা আর প্রীতির নিদর্শন এক অপূর্ব পৃথিবী-স্তুতি;— এই পৃথিবীর প্রতি, যে পৃথিবী ছিল আদিযুগের “অহল্যা” পৃথিবী— মানবের দ্বারা হল বা লাঙ্গল আর পশুর সাহায্যে খাদ্যের জন্য কর্ষিতা হ'য়ে, এখনকার মত ক্রমবর্ধমান, বুভুক্ষা আর লোভের বশবর্তী, সুষ্ঠু-সংখ্যা-সীমা অতিক্রমিষ্ণু, দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানব-অক্ষৌহিণীর দ্বারা বিজিতা, নিপীড়িতা ও ধৰ্ষিতা হয় নি— বিভূতিভূষণের সমস্ত সাহিত্য-সর্জনার মধ্যে, মানব-জাতির স্নেহময়ী মাতৃস্বরূপিনী এমন পৃথিবীর প্রতি যে অপার শ্রদ্ধা আর ভালবাসা প্রকাশিত হ’য়েছে, তার এক জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাত উৎস আমরা অথর্ববেদের এই ভূমি-সুক্তের মত প্রাচীন সাহিত্য-রচনায় যেন পাচ্ছি। বিভূতিভূষণের মত আধুনিক কালের প্রকৃতি ও পৃথিবীর উদ্গাতা, তাদের পক্ষে যাঁরা ছিলেন পূজ্য, পুর্ব্য, পূর্বজ আর পথিকৃৎ কবিঋষি, তাদের মধ্যে, অথর্ববেদের দ্বাদশ কাণ্ডের ভূমি-সুক্তের দ্রষ্টা অথর্বা ঋষি ছিলেন অন্যতম। তাঁর রচিত কাব্যময় এই পৃথিবী-বন্দনা থেকে কতকগুলি মন্ত্র উদ্ধার ক’রে পাঠ ক’রলে, প্রাচীনের সঙ্গে আধুনিকের আশ্চর্য্য যোগ-সুত্র বা ভাব-সাদৃশ্য ধ'রতে পারা যায়। বাঙলার বিভূতিভূষণ তঁর বিভিন্ন রচনায় যেন ছিলেন আরণ্য-সুক্তের বা ভূমি-সুক্তের দ্রষ্টা দিব্যতাবযুক্ত এযুগের এক নবীন ঋষি। বিভূতিভূষণের প্রশস্তিতে রচিত এই নিবন্ধে, তাঁরই প্রতি শ্রদ্ধা-নিবেদনের উদ্দেশ্যে, অথর্ববেদের দ্বাদশ কাণ্ডের তেষট্টিটি মন্ত্রে গ্রথিত প্রথম সুক্ত এই ভূমি-সূক্ত থেকে নির্বাচিত ছাব্বিশটি মন্ত্র, মূল বৈদিক পাঠ সমেত বাঙলা অনুবাদে, বিভূতিভূষণের অনুরাগী পাঠকদের সামনে তাঁদের চিত্তপ্রসাদনের জন্য উপস্থাপিত ক’রে দেওয়া গেল। *** ২। অসমবাধং বধ্যতো মানবানাং যস্যা উদ্বতঃ প্রবতঃ সমম্ বহু। নানাবীর্যা ওষধীর্যা বিভর্তি পৃথিবী নঃ প্রথতাং রাধ্যতাং নঃ॥ “যে পৃথিবী মনুপুত্র মানবজাতির চাপে মানবের দ্বারা (এখনও) আচ্ছন্ন বা আবৃত হন নি; যে পৃথিবীতে বহু উঁচু-নীচু আর সমতল ভূমি আছে, যে পৃথিবী নানা গুণ বা শক্তির নিধান বহু ওষধি ধারণ করেন- সেই পৃথিবী আমাদের জন্য বিস্তীর্ণা হোন, আমাদের কৃপা করুন।” ৩। যস্যাং সমুদ্র উত সিন্ধুরাপো যস্যামন্নং কৃষ্টয়ঃ সম্ বভূবুঃ। যস্যামিদং জিয়তি প্রাণাদেজং সা নো ভূমিঃ পূৰ্বপেয়ে দধাতু॥ “যে পৃথিবীতে সমুদ্র, সিন্ধু ও সমস্ত জল বিদ্যমান, এবং যাতেই সমস্ত অন্ন ও কৃষ্টি সমুদ্ভুত
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).djvu/২১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।